আনিসুর রহমান তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থে এমন এক অন্ধকার জগতের ছবি এঁকেছেন, বাংলাদেশের ছোটগল্পে সম্ভবত এর জুড়ি মিলবে না। ৯টি গল্পের একটি ‘সিসিফাস শ্রম’। এ নামেই গ্রন্থটির নামকরণ। বলতেই হবে, নামটি সার্থক হয়েছে। এ গল্প তো বটেই, বাকি গল্পগুলোতেও অন্ধকারেরই রাজত্ব। হতাশা, শারীরিক-মানসিক বিষাদ, অক্ষমতা, বিকট দেশ-কাল এবং এক সামগ্রিক অর্থহীনতা গল্পগুলোকে অধিকার করে আছে। এ যেন জগতের ও জীবনের অনিবার্য নিয়তি।
‘সেলিব্রেটিং সেঞ্চুরি উইথ আদুরী’ গল্পে শতাব্দীর সাক্ষী হিসেবে আদুরী চরিত্রের বিশেষ রূপ খুব যত্নে নির্মিত হলেও একে ব্যক্তির গল্প বলা যাবে না। কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনার লক্ষণাধর্মী উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে এখানে বরং দুনিয়াদারির বেইনসাফির কথাটাই বড় হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ‘মাস্টারপিস’ গল্পটাও ব্যক্তির নয়, যদিও আনিসের অন্য সব গল্পের মতো এখানেও ব্যক্তির উপস্থাপনায় দারুণ চমক আছে। সড়ক দুর্ঘটনার মতো এক বারোয়ারি সংকট তীক্ষ্ণ রঙ্গরসের প্রশ্রয়ে আলোকিত হয়েছে এ গল্পে। দুর্ঘটনায় দুমড়েমুচড়ে যাওয়া মানবদেহকে উৎকৃষ্ট শিল্পকর্ম হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য আনিস যে কুশলতায় রূপকল্প গড়েছেন, তা রীতিমতো উল্লেখযোগ্য।
মোহাম্মদ আজম
সিসিফাস শ্রম
আনিসুর রহমান
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০২৪; প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল; ৮০ পৃষ্ঠা; দাম: ২৫০ টাকা।
এ ধরনের ব্যতিক্রম বাদ দিলে এ বইয়ের বেশির ভাগ লেখা আদতে ব্যক্তির কথকতা। ব্যক্তিদের মধ্যে ৯০ বছরের বৃদ্ধ যেমন আছে, তেমনি আছে তাগড়া তরুণ। গরিব-ছাপোষা বান্দার পাশাপাশি আছে খুব সফল ব্যবসায়ী বা চৌকস করপোরেট যুবক। কিন্তু ধরন তাদের যা-ই হোক, প্রত্যেকেই ব্যতিক্রমহীনভাবে অর্থহীনতায় ভোগে। জীবনের তাৎপর্য এরা খুঁজে পায়নি, এটাই অর্থহীনতার মূল কারণ নয়; বরং তাৎপর্য বলে কিছু আছে, এমন ইশারাও খুব বিরল। ১৯৯০-এর দশকে জন্ম নেওয়া এক গল্পকারের জন্য এ রকম নিখিল নাস্তি প্রায় বিস্ময়কর।
আনিসের গল্পের চরিত্রেরা সংখ্যায় কম এবং প্রায় প্রত্যেকেই খুব নিঃসঙ্গ। অধিকাংশ সময় তারা নিজের সঙ্গে কথা বলেই নিগূঢ় সিদ্ধান্তগুলো নেয়। তবে অন্ধকার, হতাশা, বিপর্যয় আর তাৎপর্যহীনতাকে তারা কোনো ঘটনাপরম্পরায় আবিষ্কার করে না; ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত ওসব সত্য নতুন করে বা নিখুঁতভাবে উপলব্ধি করে মাত্র। ‘আগর আলীর প্রাতর্ভ্রমণ’ গল্পের ‘সবচেয়ে নিঃসঙ্গ মানুষ’ আগর অবশ্য চারপাশের কিছু কিছু মানুষকে ‘সুখী’ দেখে। তার নিজের গভীর অসুখের বাইরে সুখের একটা উদ্ভাস এতে পাওয়া যায়। অন্য বেশির ভাগ গল্পে এটুকুও নেই। ‘অক্টোবরের শেষ বিকেল’ গল্পটির কথাই ধরা যাক। ৯০তম জন্মদিনে মোবাশ্বের আলী যেভাবে জীবনের তাবৎ মুহূর্ত আর প্রতিজ্ঞাকে ভ্রান্তি আর মূঢ়তা বলে ঘোষণা করার নিঃসংশয় যুক্তি পেশ করে, তাতে শুধু ওই বৃদ্ধনিবাসের জীবন-খোয়ানো বৃদ্ধরা নয়, খোদ মানবজন্মই নিমজ্জিত হতে থাকে অন্তহীন খাদের গহিনে। শ্রোতা চরিত্রটি ঈষৎ ভিন্নমত জানিয়ে সবকিছু নিরর্থকতায় পর্যবসিত হওয়ার আগে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে চায় বটে, কিন্তু তাতে নিখিল নাস্তি ফিকে হয় না। ‘অচেনা মানুষ’ গল্পের চরিত্রটি আরও এককাঠি সরস। একই সঙ্গে ‘সাম্যবাদী, শোষক ও ক্রীতদাস’ হয়ে জীবনানন্দ-ভক্ত লোকটি দুনিয়ার স্বাভাবিক হালচালকেই যেন মূর্ত করে তোলে নিজের মধ্যে।
আনিসুর রহমান গল্পে কাহিনি তৈরি করেন না। ক্ষেত্রবিশেষে এমনকি কাহিনিরেখাও নয়। তিনি ব্যক্ত করেন অনুভূতি। আরও ভালো হয় বললে, তিনি উপলব্ধির কারবার করেন। তাঁর গল্পে মুহূর্ত খুব গুরুতর ব্যাপার। মুহূর্তকে বিশ্লেষণাত্মক কায়দায় মূর্ত করাই তার প্রধান কারবার। তার চরিত্ররা ওই বিশেষ মুহূর্তে জীবনের অর্থহীনতা আবিষ্কার করে। শুরুর ‘এপিটাফ’ গল্পকে বলা যায় এ আবিষ্কারের প্রস্তাবনা। ‘জন্মের পঁচিশতম বছরে আমি মরে গেলাম।’ এ রকম ঘোষণা দিয়ে শরীর ও মনের মৃত্যুকে এখানে খুব প্রকাশ্যেই আলাদা করা হয়েছে। এ রকম প্রকাশ্য না হলেও প্রাণহীন যান্ত্রিক জীবনের আবহ আছে প্রায় সব কটি গল্পে।
ঘোরতর মডার্নিস্টদের প্রবল নাস্তির প্রকাশে আর অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে লেখক বেশ কার্যকর মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। আবার ভাবনা, অনুভব ও উপলব্ধিকে চিত্র বানিয়ে—কখনো কখনো প্রায় উদ্ভট চিত্রে সমর্পিত করে, এমন পরিস্থিতিও হরহামেশাই তৈরি করেছেন, যেখানে জাদুবাস্তবতার আমেজ পাওয়া যায়। গল্পগুলোকে অবশ্য এ দুই অভিধার কোনোটিতেই আঁটিয়ে ফেলা যাবে না। বরং এখানে ভাষা বয়ে গেছে এ দুইয়ের মধ্যবর্তী প্রাঙ্গণ বেয়ে। তাতে নগরের বর্তমানময়তা আর গ্রামীণ শৈশবের অভিজ্ঞতা খুব ন্যাংটোভাবে মিশেছে। আনিসের গল্পভাষা যুগপৎ সূক্ষ্ম ও বীভৎস। সময়ের লম্বা পর্বকে মুহূর্তের বিন্দুতে বন্দী করা তার অন্যতম কৌশল। এ পুরো আয়োজনে গল্পরসের কমতি আছে বলে মনে হতেও পারে, কিন্তু এ তরুণ গল্পকার গল্প বলার যেসব জটিল কায়দা রপ্ত করেছেন, সেগুলো উপাদেয় না হওয়ার কোনো কারণ নেই।