আবুল মোমেনের শিক্ষার শত শিখা বইটি ভূমিকা থেকে উপসংহারের দিকে এগিয়েছে সময়ের নাড়ি টিপে টিপে। এ সময় অতীত যাত্রা থেকে শুরু করে বর্তমানকে ফুঁড়ে ভবিষ্যৎকে ধরেছে। পঠন-পাঠন মানুষ ও অন্য প্রাণীর মধ্যে ভেদরেখা টেনে দিয়েছে। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে নিজের অস্তিত্বের খাতিরেই মানুষের পঠন-পাঠনের রূপপ্রকৃতির পরিবর্তন করা জরুরি। এই বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতেই লেখক এই মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় গ্রন্থ রচনা করেন। ভূমিকায় লেখক বইটি রচনার পেছনের অনুপ্রেরণার কথা উল্লেখ করেছেন, ‘শিক্ষার শিখা এ দেশে বহুকাল ধরে জ্বললেও তা আজ উদ্দীপ্ত নয়, ম্লান’। এই উপলব্ধি তো আজ বাংলাদেশের সবার। বইটির শক্তির জায়গা এখানেই। এখানে বইটির সারবস্তু বিষয়ের আত্মতা ছাপিয়ে সর্বজনীনতায় উন্নীত হয়েছে।
বইটি এগোয় বিশেষ এক পথে, গাণিতিক সংখ্যা ধরে। এই সংখ্যা ১ থেকে ১০০। এটি প্রাসঙ্গিকও বটে। ১০০ জন মনীষী, ভাবুক, শিক্ষাবিদ, চিন্তক, দার্শনিক ও রাজনীতিকের ১০০টি উদ্ধৃতির উল্লেখ রয়েছে এতে। প্রতিটি উদ্ধৃতির সঙ্গে লেখক তাঁর জীবনাভিজ্ঞতা ও কর্মাভিজ্ঞতার আলোকে অত্যন্ত প্রাজ্ঞতার সঙ্গে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ জুড়ে দিয়েছেন। তবে মাঝেমধ্যে এই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বক্তব্য বলে মনে হয়। তবু এই বৈশিষ্ট্য গ্রন্থটিকে এর মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করে না।
উদ্ধৃতি নির্বাচনে লেখক একজন দক্ষ সম্পাদক ও সংকলকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। কনফুসিয়াস, সেনেকা, প্লুটার্ক, হজরত মুহাম্মদ (সা.) হয়ে আমাদের এই ভূখণ্ডের রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, রাধাকৃষ্ণান, আবুল ফজল, আনিসুজ্জামান ও জামাল নজরুল ইসলামকে পর্যন্ত লেখক তাঁর গভীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্যানভাসে ধরেছেন। মানবসভ্যতার নানান পর্যায়ের বিস্তৃত বহুবর্ণিল ও বহুবল্লভ জ্ঞানকাণ্ডের চাবি–ব্যক্তিত্বদের শিক্ষাভাবনার নির্যাস বেছে বেছে সংগ্রহ ও তা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা একটি জটিল কাজ, যা লেখক খুব দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করেছেন।
আরেকটি বিষয়, যা এই পাঠককে বইটির মধ্যে সাবলীলভাবে প্রবেশ করতে সাহায্য করে, তা হলো প্রতিটি উদ্ধৃতি বিশ্লেষণের পর লেখক ওই উদ্ধৃতিকারের জীবনী সংক্ষিপ্তাকারে হাজির করেছেন। এটি যেমন শিক্ষাভাবনার বিবর্তনের ইতিহাস পাঠকের সামনে হাজির করে, তেমনি পাঠক ওই উদ্ধৃতিকারদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা, অবস্থান ও প্রেক্ষিত কীভাবে তাঁদের ভাবনার সঙ্গে আন্তগ্রন্থিকতা তৈরি করেছে, তা বুঝতে সাহায্য করে। তবে এ কাজ করতে লেখক সময়ক্রম মানেননি। মানলে ভালো হতো।
একটি কথা না বললেই নয়; সেটি হলো, বইটি লেখা হয়েছে অনেকাংশে বৈঠকি ঢঙে। পাঠক এটি পড়তে গেলে অনুভব করবেন যেন লেখক তাঁর সামনে বসে উদ্ধৃতিগুলো ব্যাখ্যা করছেন। কখনো কখনো লেখক পাঠককে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন, বিশেষ কিছু কর্মে যুক্ত হতে প্রণোদিত করছেন; নিষেধও করছেন। এ বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় এ কথা বলাই যায় যে বইটি লেখক ও পাঠকের মধ্যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি প্রাণবন্ত দ্বিরালাপ তৈরি করে। নতুন নতুন চিন্তার উদ্রেক ও উদ্ভব ঘটানোর জন্য যেকোনো উৎকৃষ্ট গ্রন্থের এটি একটি বড় বৈশিষ্ট্য। তবে লেখক তাঁর লেখায় কোনো রকম আড়াল ছাড়া হাজির হলে যে বিপত্তি ঘটে তা হলো, পাঠকের মনে হতে পারে, লেখক তাঁর নিজস্ব ধ্যানধারণা পাঠকের ওপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু আবুল মোমেন তাঁর মচমচে ও সাবলীল বাংলা ভাষার ব্যবহার করে এবং বইটিজুড়ে দ্বিরালাপীয় আবহ সৃষ্টি করে এ পরিস্থিতি অনেকটাই উতরে গেছেন।
আবার বেশ কিছুসংখ্যক উদ্ধৃতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে লেখক অনেকগুলো ঐতিহাসিক চরিত্রের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের দৃষ্টান্ত হাজির করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, জন ডিউইয়ের উদ্ধৃতি বিশ্লেষণে তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের জীবনযাপনপদ্ধতির কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছেন। এই ইন্টারটেক্সুয়ালিটি বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তথ্যসূত্রের উল্লেখ ছাড়া ইতিহাস পৌরাণিক কাহিনি বা মিথে পরিণত হতে বাধ্য। তাই এ রকম ক্ষেত্রে তথ্যসূত্রের উল্লেখ থাকলে ভালো হতো।
তবে সব মিলিয়ে এ কথা জোর দিয়েই বলা যায় যে বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যখন চারপাশে গভীর হতাশা, ক্ষোভ ও রাগের উদ্গীরণ চলছে, তখন ইতিহাস-ঐতিহ্য ও নৈতিকতার সমন্বয়ে যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে পরিবর্তনশীল চাকরির বাজারের চাহিদা মোতাবেক দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে আমাদের করণীয় দায়িত্ব, কর্তব্য ও উদ্যোগের কথা উপলব্ধি করতে গ্রন্থটি আমাদের বাস্তবসম্মতভাবে সাহায্য করতে পারে।