অধিবাসীদের কাছে ঢাকা শহর যেন এক বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকা। এ শহর সবাইকে কাছে টানে মাসুদ রানার মতোই, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় কেবল অল্প কয়েকজনকে। বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র হয়েও তাই ঢাকার ইতিহাস আমাদের কাছে মোটাদাগে অস্বচ্ছ। ব্যক্তিগত আগ্রহে আমি অবশ্য সুযোগ পেলেই ঢাকার ইতিহাসসংক্রান্ত বইপত্র পড়ার চেষ্টা করি। তারেক আজিজের অতীত ঢাকার আশ্চর্য ইতিহাস: কফি হাউস থেকে কলের গাড়ি শিরোনামের বইটাও সেই আগ্রহ থেকেই পড়া।
নাতিদীর্ঘ কয়েকটি প্রবন্ধকে সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে আলোচ্য সংকলন। স্বল্পায়তনের প্রবন্ধগুলোর ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্যের সমাহার ঘটিয়েছেন লেখক। তথ্যভারাক্রান্ত করতে গিয়ে ইতিহাসবেত্তারা প্রায়ই রচনার রস ক্ষুণ্ন করেন। তারেক আজিজ সেদিক দিয়ে উতরে গেছেন।
সুহান রিজওয়ান
অতীত ঢাকার আশ্চর্য ইতিহাস: কফি হাউস থেকে কলের গাড়ি
তারেক আজিজ
প্রকাশক: কথাপ্রকাশ, ঢাকা; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪; প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা; ১১২ পৃষ্ঠা; দাম: ৩০০ টাকা।
১৮০৮ সালে জলাজঙ্গলে ছেয়ে যাওয়া এই ঢাকা শহরে কালেক্টর হিসেবে চার্লস ডয়লির যোগদানের প্রসঙ্গ বর্ণনা করে শুরু হয়েছে বইটি। আর এর শেষ প্রবন্ধটি থেমেছে বিংশ শতাব্দীর মধ্যবিন্দুকে পেরিয়ে গিয়ে, যখন বইয়ের দোকান ‘হুইলার অ্যান্ড কোম্পানি’র ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের শাখাটি বন্ধ হয় ১৯৬৮ সালে। সেই বিবেচনায় বলা যায়, বইটি মোটাদাগে ধারণ করেছে ঢাকা শহরের দেড় শ বছরের টুকরো ইতিহাস। আর উল্লিখিত ওই দুই প্রবন্ধের মাঝখানের ১০টি প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে এই শহরে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা (ভোলানাথ চন্দ্রের ঢাকা ভ্রমণ কিংবা ঢাকায় কলের গাড়ির আগমন), এই শহরের জন্য কাজ করা কিছু মানুষ (মিটফোর্ড হাসপাতালকে পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করা চিকিৎসক আলেকজান্ডার সিম্পসন কিংবা রমনা উদ্যানকে দ্বিতীয় প্যারিস করে তুলতে চাওয়া রবার্ট প্রাউডলক) এবং কিছু নাগরিক অনুষঙ্গ (ঢাকায় কফিপানের সূচনা কিংবা ঢাকার বিজ্ঞাপনী সাইনবোর্ড) নিয়ে।
সত্যি বলতে কি, ঢাকার ইতিহাস নিয়ে আগ্রহীদের মধ্যে যাঁরা, এমনকি আধা মনোযোগ দিয়েও পড়েছেন মুনতাসীর মামুনকে, উদ্দিষ্ট বইয়ের বহু চরিত্র কিংবা ঘটনার অনেকাংশই তাঁদের জানা। এখানে বলতে হবে মীজানুর রহমানের ঢাকা পুরাণ-এর কথাও, সেখানেও তিলোত্তমা ঢাকার অতীতের বহু খুচরা তথ্যের উল্লেখ আছে, যাদের পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা যায় উদ্দিষ্ট সংকলনেও।
তবে তারেক আজিজের বইয়ের সার্থকতা এ–ই যে আগের বইগুলোয় পাওয়া তথ্যের সঙ্গে তা প্রায়ই নতুন একটা-দুটি তথ্য যোগ করে। যেমন পাগলা সাহেব চার্লস ডজের হাতে রেসকোর্স নির্মাণের কথা। ওইটুকু তথ্য ঢাকার ইতিহাসে আগ্রহীদের ভালোই জানা। উদ্দিষ্ট বই থেকে জানা গেল, “ডজ’স ফলি” ছিল ঢাকাবাসী কফিপায়ীদের প্রথম সমাবেশস্থল। বলা যায়, ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের হুইলারের বইয়ের দোকানের প্রসঙ্গও। মীজানুর রহমানের লেখায় হালকা উঠে এলেও তারেক আজিজ বিস্তারিত জানালেন হুইলারের আদ্যোপান্ত।
ঢাকাই ইতিহাসে আগ্রহী পর্যটক হিসেবে বেশ নতুন লাগে তিনটি প্রবন্ধকে। একটি প্রবন্ধ প্রখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী ডাল্টন হুকারের ঢাকা ভ্রমণ নিয়ে, একটি পোগোজ স্কুলের এককালীন প্রধান শিক্ষক ও আরমানিটোলা গির্জার ‘দ্য লাস্ট সাপার’ নামক চিত্রকর্মের শিল্পী চার্লস পোটকে নিয়ে, আর একটি প্রবন্ধ ঢাকাই বজরার ইতিহাস নিয়ে। বিশেষত শেষ প্রবন্ধটি দারুণ মুনশিয়ানায় অতি সংক্ষেপে তুলে ধরে ঢাকাই বজরার ৪০০ বছরের বিবর্তন।
লেখার সঙ্গে কিছু আলোকচিত্র আর অলংকরণ সমৃদ্ধ করেছে বইয়ের সৌন্দর্য। উল্লেখ করতে হয় প্রতিটি প্রবন্ধের শেষে যুক্ত করা তথ্যসূত্রদের কথাও। ঢাকা নিয়ে ভবিষ্যতে কেউ ঘাঁটতে গেলে উদ্দিষ্ট সূত্রগুলো তাঁর জন্য রীতিমতো স্বর্ণখনির কাজ করবে।
সবচেয়ে বড় কথা, ঐতিহাসিকের খুঁতখুঁতানির চেয়ে পুরো বইয়ে পাঠককে মুগ্ধ করে ঢাকার অতীতের প্রতি রচয়িতার একরকম মমত্ববোধ। টিকটক-রিলসের এই গতিময় যুগে মনোরম অথচ মনোটোনাস ঢাকা নগরীর দেড় শ বছরকে প্যানোরামা ছবি করে তোলা বড় সহজ কথা নয়। ঢাকা শহরের ইতিহাসকে ভালোবাসা নিয়ে প্রস্থচ্ছেদ করতে চান যে পাঠক, তাঁর জন্য বইটি অবশ্যপাঠ্য।