কেন মানুষ আমার বই পছন্দ করে

এ সময়ের জনপ্রিয় লেখক মহিউদ্দিন আহমদ। নন–ফিকশনধর্মী বই লিখে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাঠকপ্রিয় লেখক হয়ে উঠেছেন তিনি। তিনি কীভাবে বই লেখেন? কেন তাঁর বই মানুষ পছন্দ করেন? পাঠকদের সঙ্গে এই লেখকের কী ধরনের কথাবার্তা হয়?—এসব জানাতে এবার নিজেই কলম ধরেছেন মহিউদ্দিন আহমদ

মহিউদ্দিন আহমদ
ছবি: প্রথম আলো

আমার বই পড়ে কেউ যদি বলেন, ভাই, খুব ভালো লিখেছেন, এসব তো আগে জানতাম না, আপনি খুব নির্মোহভাবে লেখেন, তখন খুশিতে মনটা ভরে যায়। আবার কেউ যদি বলেন, রাবিশ, আপনার মতলব খারাপ, আপনি বায়াসড, আপনি ইতিহাস নয়, আধা উপন্যাস লিখেছেন, তখন খারাপ লাগে।

লেখালেখির কাজটা খুব পরিশ্রমের। বিশেষ করে আমি যে ধরনের বই লিখি। একেকটা বই লিখতে গেলে আরও এক শ বই পড়তে হয়, ৫০ জনের সঙ্গে কথা বলতে হয়। সব তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করে তারপর লিখতে বসি। একটা বই লিখতে সময় লাগে তিন মাস থেকে তিন বছর। কিন্তু তার পাঠপ্রতিক্রিয়া খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পেয়ে যাই।

চার-পাঁচ ঘণ্টা রান্নাঘরে থেকে কাটা-বাছা করে, চুলার আঁচে দাঁড়িয়ে একজন রান্না করলেন। সেই খাবার ১০ মিনিটে সাবাড় করে একজন মন্তব্য করতেই পারেন, স্বাদ ভালো হয়েছে কিংবা হয়নি। লেখালেখির ব্যাপার অনেকটা এ রকম।

প্রথমা প্রকাশনসহ অন্যান্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত মহিউদ্দিন আহমদের কয়েকটি বই

নানান বয়সী, নানান শ্রেণির, নানান মেজাজের পাঠক আছেন। একেক জনের মানসিক গঠন, অভিজ্ঞতা, রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি, আকাঙ্ক্ষা একেক রকম। নন-ফিকশন লিখে তাঁদের সবাইকে খুশি করা বলতে গেলে অসম্ভব। সেই কঠিন কাজটি করে আমি অনেককে আনন্দ দিতে পারছি, অনেক বিতর্কের মধ্যেও পড়তে হচ্ছে।

জনতুষ্টির জন্য লিখলে পাঠকের খড়্গ ঘাড়ের ওপর পড়ার আশঙ্কা কম। কিন্তু আমার কারবার তো বাস্তব ঘটনা নিয়ে। সেখানে মনগড়া কথা বলার কিংবা চালাকি করার সুযোগ নেই। আমার লেখার মধ্যে দুটি জিনিস থাকে। প্রথমত, আমি ব্রেকিং নিউজ টাইপের নতুন কিছু তথ্য দিতে চেষ্টা করি। আমাকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এসব তথ্য জানতে হয়। সবটা বলে বোঝানো যাবে না। এ নিয়ে আস্ত একটা একটা বই লিখে ফেলা যায়, কীভাবে আমি আমার বইয়ের কনটেন্ট জোগাড় করি, সাজাই।

নন-ফিকশন বইয়ের একটা বড় বদনাম হলো, এগুলো বোরিং—বিরক্তিকর। ভাষা কাঠখোট্টা। একনাগাড়ে বেশিক্ষণ পড়া যায় না। অথচ একটা উপন্যাস কেমন তরতরিয়ে এগিয়ে যায়। এক বসাতেই পড়া শেষ করে ফেলা যায়।

যখন বই লিখব বলে মনস্থ করলাম, তখন নিজের কাছে আমার একটা চ্যালেঞ্জ ছিল, তথ্য দেব, বিনোদনও দেব। অর্থাৎ আমার লেখা পড়ে কেউ বিরক্ত হবেন না, বই শেষ না হওয়া পর্যন্ত পড়ার আগ্রহ হারাবেন না, আনন্দের সঙ্গে পড়বেন। ঠিক এ কারণেই হয়তো আমি অনেকের প্রিয় লেখক। তাঁরা তাঁদের ভালো লাগার কথা, মুগ্ধতার কথা আমাকে জানান।

আমার প্রতিটি বইয়েই আমার ব্যক্তিগত ই-মেইল দেওয়া থাকে। অনেকেই আমার ফেসবুকে যুক্ত আছেন। সেখানে তাঁরা লেখেন, আজ রাত জেগে পড়া শেষ করেছি, খুব ভালো লেগেছে। এই ভালো লাগাটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

কেউ কেউ আমার লেখা পড়ে অতিপ্রতিক্রিয়া দেখান, গালমন্দ করেন। বুঝতে পারি, আমি তাঁর বিশ্বাসে আঘাত দিয়েছি। আগে তাঁদের মন্তব্য পড়ে আগে আমি খেপে যেতাম, তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতাম। এখন বেশ রয়েসয়ে মন্তব্য করি। নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া কিংবা গালাগালও এক অর্থে আমার জন্য আশীর্বাদ। তাঁরা আমার বইটা পড়ছেন বা আমার লেখা নিয়ে আলোচনা করছেন—এটাই–বা কম কিসের!

অনেক পাঠক প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেন। নাম, তারিখ, ঘটনা লিখতে গিয়ে তাড়াহুড়ায় কিংবা অনির্ভরযোগ্য সূত্র ব্যবহারের কারণে অনেক সময় ভুল হয়ে যায়। তখন পাঠক আমাকে সেই ভুল শুধরে নিতে সাহায্য করেন।

কেউ কেউ আমার লেখা পড়ে অতিপ্রতিক্রিয়া দেখান, গালমন্দ করেন। বুঝতে পারি, আমি তাঁর বিশ্বাসে আঘাত দিয়েছি। আগে তাঁদের মন্তব্য পড়ে আগে আমি খেপে যেতাম, তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতাম। এখন বেশ রয়েসয়ে মন্তব্য করি। নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া কিংবা গালাগালও এক অর্থে আমার জন্য আশীর্বাদ। তাঁরা আমার বইটা পড়ছেন বা আমার লেখা নিয়ে আলোচনা করছেন—এটাই–বা কম কিসের!

বই বড় হয়ে গেলে তার প্রকাশনা খরচ বাড়ে, দাম বেশি পড়ে। আমার কয়েকটা বইয়ের মুদ্রিত মূল্য হাজার টাকা কিংবা তারও বেশি। যাঁরা বই কেনার সময় দাম বিবেচনা করেন না, অর্থাৎ বইটি তিনি সংগ্রহ করবেনই, এমন পণ করেন, তাঁরা একটু চাপে পড়ে যান। এ বছর আমার দুটো বই ছিল হাজার টাকা দামের। কেউ কেউ বলেছেন, ‘ভাই, আপনার বই কিনতে কিনতে তো ফতুর হয়ে গেলাম!’ এটা আমার জন্য এক দিকে কষ্টের, অন্য দিকে আনন্দের। যত দামই হোক, তাঁরা আমার বই তো কিনছেন, পড়ছেন। এটা অবশ্যই বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার।

মহিউদ্দিন আহমদ

অনেকেই বই কিনতে চান না, পিডিএফ কপি চান। এমন নয় যে তাঁদের টাকা নেই। তাঁরা দৈনন্দিন অন্য সবকিছুই কেনেন, শুধু  বইয়ের ক্ষেত্রেই পিডিএফ চান। এ ব্যাপারে এত কার্পণ্য কেন! আসলে বই কেনা একটা স্বভাব বা অভ্যাস। এই অভ্যাস যাঁদের আছে, তাঁরা টাকার হিসাব করে বই কেনেন না। চিত্তের ক্ষুধা মেটাতে বই হলো তাঁদের নিত্যদিনের খোরাক।

সবচেয়ে ভালো লাগে, যখন ফেসবুকে আমার ১০-১২টা বইয়ের ছবি কেউ দেখিয়ে বলেন, আপনার সব বই আমার সংগ্রহে আছে, কী যে আনন্দ লাগে তখন! ইচ্ছে হয় তাঁদের সবাইকে নিয়ে কোনো একটা রেস্তোরাঁয় বসি, আড্ডা দিই, খাওয়াদাওয়া করি। কোনো পাঠক যদি এই উদ্যোগটা নেন, সবাইকে জড়ো করেন, খুব খুশি হব।

মহিউদ্দিন আহমদ–এর বইগুলো কিনতে ভিজিট করুন Prothoma.com