চোখ

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

হামাসের প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে ১৬ অক্টোবর হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।

ধারণা করা হয়, গত বছর ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামলার পরিকল্পনাটি ছিল সিনওয়ারের। ১৯৬২ সালে খান ইউনিসের শরণার্থীশিবিরে জন্ম নেওয়া সিনওয়ারের যৌবন কেটেছে ইসরায়েলি কারাগারে। ২০১১ সালে মুক্তির পর গাজায় হামাসের প্রধান ব্যক্তিত্বে পরিণত হন তিনি। ২৩ বছরের বন্দিজীবনে তিনি হিব্রু ভাষা শেখেন। হিব্রু থেকে গোয়েন্দা সংস্থা শিন-বেতের দুই প্রধানের তিনটি বই অনুবাদ করেন তিনি। এ ছাড়া লেখেন আরও দুটি গবেষণা বই, একটি আখ্যান ও একটি উপন্যাস। উপন্যাসের নাম আশ-শাওক ওয়াল কারানফুল। বাংলা অনুবাদে উপন্যাসটির নাম কাঁটা ও ফুল, যার প্রচ্ছদে লেখা আছে, ‘কারাগারের সঙ্গীরা প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে লেখাগুলো গোপনে কপি করেন এবং যেকোনো উপায়ে সবার কাছে পৌঁছে দেন—এভাবে তারা পিঁপড়ার মতো খেটে বইটি আলোর মুখে এনেছেন।’

আশ-শাওক ওয়াল কারানফুল উপন্যাসে সিনওয়ার ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ থেকে শুরু করে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের, বিশেষত গাজার দুর্দশাপীড়িত জনজীবন, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছেন। এখানে থাকল উপন্যাসের ১৭ ও ১৮ অধ্যায়ের কিছু অংশ, যাতে উঠে এসেছে গোয়েন্দাসংকুল গাজার মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন।

ক্যাম্পাসে যাওয়া-আসার পথে শরণার্থীশিবিরের প্রতিবেশী এক মেয়ের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়। সে-ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের ক্যাম্পাস ও ক্লাসরুম সম্পূর্ণ আলাদা। শুধু যাওয়া-আসার পথ, বাসস্ট্যান্ড ও যানবাহনে একে অপরের দেখা হতে পারে। রাস্তায় দেখলে কখনো না চাইলেও তার দিকে চোখ পড়ে যায়। সে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। নির্দ্বিধ আত্মবিশ্বাসী পায়ে হাঁটে। আমি মুগ্ধ হয়ে ভাবি, এই মেয়ে তো সত্যিই পূর্ণিমার চাঁদ। মাঝেমধ্যে একপলক দেখে নিই, কিন্তু সালাম দেওয়ার সাহস হয় না—লজ্জা আর ভয়ে।

একদিন হঠাৎ আমাদের চোখের মিলন হয়। সারা শরীর শিউরে ওঠে আমার এবং হৃদয়ে প্রবল অনুভূতির স্রোত বয়ে যায়। মাত্র একপলকের দৃষ্টি বিনিময়, সঙ্গে সঙ্গেই সে তার চোখ নামিয়ে নেয়। এর পর থেকে ইচ্ছা করেই সেই পথ দিয়ে যাই, যে পথে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করে। তার দিকে না তাকাই, কথা না বলি তবু শুধু পথে তার আভাস পাওয়াই মনে কেমন যেন শান্তি এনে দেয়!

নিজেকে প্রশ্ন করি বারবার, এটা কি সেই প্রেম, যার কথা সবাই বলে? তৃতীয়বার দৃষ্টি বিনিময় হওয়ার দিন আমি একটু মুচকি হাসি। তার মুখ লজ্জায় এমন লাল হয়ে ওঠে, যেন বেদানার মতো ফেটে যাবে। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে সে দ্রুত পা চালিয়ে চলে যায়। কিন্তু আমি আমার সীমা জানি, তাই একমাত্র চাওয়া ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকানোর আগে বা পরে যেন যথানিয়মে তার পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারি। আর বেশি কিছু নয়, কেননা এটাই আমরা পরিবার থেকে শিখেছি।

আমাদের পরিবারে চাচাতো ভাই হাসানের ব্যাপারটা তত দিনে ইব্রাহিমকে নিদারুণ উদ্বেগে ফেলেছে। প্রায়ই সে আমাকে হাসানের কথা বলে। হাসানের কার্যকলাপের সত্যতা যাচাই করতে নিয়ে যায়। হাসানকে বহুবার গোয়েন্দা অফিসার আবু ওদাইর অফিসে দেখা গেছে। সে গেটের দারোয়ানকে একটি বিশেষ কার্ড দেখায় এবং এক বা একাধিক ঘণ্টা পর বেরিয়ে আসে। এ ছাড়া সে এমন অনেক দোকানে যায়, যেগুলোর মালিকেরা পরিচিত গুপ্তচর। রাস্তায় সে মেয়েদের দিকে অশ্লীল মন্তব্য ছোড়ে। কখনো কোনো বারবনিতাকে গাড়িতে বসিয়ে দূরের কোথাও চলে যায়।

মা রাতে আমাদের বেশি সময় বাইরে থাকতে দেন না। কেউ দেরি করে বাড়ি ফিরলে বা রাতে বাড়ির বাইরে যেতে চাইলে খুব কড়াকড়ি করেন। দরজার কাছে গেলেই ডাক দেন, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ, আহমেদ?’ তার প্রশ্নের বন্যা থেকে তখন কেউ রক্ষা করতে পারে না। আমরা ঠিক করি, বাড়িতে সময়মতো ফিরব, পড়াশোনা করে তাড়াতাড়ি ঘুমাব, তারপর মাঝরাতে ইব্রাহিমকে বের হতে সাহায্য করব। সপ্তাহে এক বা দুবার সে বের হয়, ফিরে এসে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘুমাতে যায়। কখনো জিজ্ঞেস করি না, কোথায় ছিল সে বা কী করেছে এতক্ষণ। এক রাতে ফিরে আসে ভীষণ বিমর্ষ চেহারায়, স্পষ্টতই কঠিন ধকল গেছে তার ওপর দিয়ে। পোশাক বদলে শুয়ে পড়ে। আমরা কোনো কথা বিনিময় করি না। সেই রাতের পর ইব্রাহিম আর হাসানের ওপর নজরদারি করতে যায় না। রাতে বাড়ির বাইরেও বের হয় না।

কিছুদিন পরের এক রাতে আমি একটু দেরি করে ফিরছি। গলিতে ঢুকে দেখি, রাস্তার পাশে গোয়েন্দা অফিসার আবু ওদাইয়ের গাড়ি। বেসামরিক পোশাক পরে সে মসজিদের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো। হাতের কিছু একটা দিয়ে দেয়ালের দিকে ইঙ্গিত করছে। আমি পাশের গলিতে ঢুকে অপেক্ষা করি। চলে যাওয়ার পর গলিতে হাঁটতে হাঁটতে দেখি, দেয়ালে কয়েকটা চিহ্ন আঁকা, আর নানান সংখ্যা।

বাড়িতে ফিরে ইব্রাহিমকে সম্পূর্ণ ঘটনা জানাই। সে তার বিছানায় বসে ক্লাসের পড়া পড়ছিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘দেরি না হলে এখনই দেখতে বের হতাম।’ ফজরের নামাজে মসজিদের যাওয়ার পথে ইব্রাহিম সাবধান করে দেয়, যেন দেয়ালের দিকে আঙুল না তুলি। প্রথমে ভেবেছি, পৌরসভার চিহ্ন—গ্যাসলাইন বা বিদ্যুৎ বিভাগের নম্বর হবে। এখন বুঝতে পারছি, এগুলো হয়তো খুব গোপন ও বিপজ্জনক গুপ্তচরদের জন্য তৈরি কোড, যাদের পরিচয় এখনো ফাঁস হয়নি।

সেদিন বিকেলে ইব্রাহিম আমাকে খাতা-কলম নিয়ে গাড়িতে উঠতে বলে। আমরা শরণার্থীশিবিরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরি। কোনো দেয়ালে চিহ্ন দেখলেই গতি কমিয়ে টুকে রাখি। শিবিরের বাইরের কয়েক এলাকায়ও একই চিহ্ন দেখা যায়। সন্ধ্যার নামাজ শেষে ইব্রাহিম খাতার বিভিন্ন নম্বর তুলনা করতে থাকে। এই সংখ্যা তারিখ হবে, যেহেতু সব নম্বরই ১ থেকে ৩১-এর মধ্যে। দ্বিতীয় নম্বরটা ঘণ্টা, এটা ১ থেকে ২৪-এর মধ্যে। আর এই ছোট ছোট সংখ্যা মিনিট

আমরা ঘুমাতে যাই, ইব্রাহিম সাবধানে সব কাগজ ধ্বংস করে ফেলে।

গভীর রাতে কোলাহলের শব্দে ঘুম ভাঙে। চোখ কচলাতে কচলাতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে তিনটা। মা চিৎকার করে বলছেন, ‘তোমরা কী চাও?’

আমি আর ইব্রাহিম বিছানা ছেড়ে উঠতে যাচ্ছি, প্রচণ্ড আঘাতে দরজাটা উড়ে যায়। অনেকগুলো বন্দুকের নল তাক করা। শুনি আবু ওদাইয়ের গলা, ‘একদম নড়বে না, জায়গায় থাকো।’

কয়েকজন সেনা ঘরে ঢোকে। আবু ওদাই ইব্রাহিমের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, ‘তুমি ইব্রাহিম?’

‘হ্যাঁ, কী চাও?’

আবু ওদাই হাসে, ‘এত তাড়াহুড়ো কেন?’ আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি আহমেদ?’

আমাদের দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো হয়। সৈন্যরা ঘরটা চষে ফেলে, আবু ওদাই নিজেও তল্লাশি করে, ইব্রাহিমের সব কাগজ উল্টেপাল্টে দেখে। সন্দেহজনক সবকিছু এক জায়গায় জড়ো করে।

ইয়াহিয়া সিনওয়ার

মা তখনো চিৎকার করছেন, ‘ঘরটা ধ্বংস করে দিলে, আল্লাহ তোমাদের ধ্বংস করুক!’

প্রায় দুই ঘণ্টা তল্লাশির পর আমাদের দুজনকে পিছমোড়া করে বেঁধে চোখ কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়। মা ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছেন, ‘তোমরা ওদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’ ...তারা আমাকে জিপে এমনভাবে ছুড়ে ফেলে, যেন আলুর বস্তা। টের পাই, আরেকটা বস্তা আমার গায়ে পড়েছে—এটা ইব্রাহিম।

আমি ভয়ে কাঁপছি। ইব্রাহিম ফিসফিস করে বলে, ‘কাঁপছ কেন, শক্ত হও! কিছুই হবে না! কয়েক দিন পর আমরা আবার বাড়িতে ফিরে আসব।’ 

সারায়ায় (গোয়েন্দা অফিস) পৌঁছানোর পর গাড়ি থেকে আমাদের টেনেহিঁচড়ে নামানো হয়। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। শুধু দরজা খোলা আর বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনছি। আরবি–জানা এক লোক আমাকে একটা ঘরের ভেতর ঠেলে দিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দেয়। নিজেকে আবিষ্কার করি ছোট্ট একটা কক্ষের দুয়ারে। ভেতরে একটা টেবিল, ওপাশে বেসামরিক পোশাকের এক যুবক বসা। হাসিমুখে বলে, ‘বসো।’

সামনের চেয়ারটায় বসি। হাত এখনো পেছনে বাঁধা। প্রশ্ন করে, ‘হাসান কোথায়?’

আমি অবাক হয়ে বলি, ‘বাড়িতে?’

‘কোন বাড়িতে?’

‘আমাদের বাড়িতে।’

সে আরও অবাক, ‘তোমাদের বাড়িতে?’

‘হ্যাঁ।’

টেবিলের কাগজপত্রের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোমাদের বাড়ির হাসান কে?’

‘আমার ভাই হাসান।’

সে বুঝতে পারে। ‘ওহ! আমি তোমার চাচাতো ভাই হাসানের কথা বলছি। সে কোথায়?’

‘জানি না।’

সে হতাশ, ‘কীভাবে জানো না?’

‘বহু বছর ধরে আমাদের সঙ্গে থাকে না।’

‘তাকে শেষ কবে দেখেছ?’

‘মনে নেই।’

‘আনুমানিক কবে?’

‘অনেক বছর হয়েছে।’

‘তোমরা শেষ কবে বাড়িতে তার নাম উল্লেখ করেছ?’

‘মনে নেই।’

‘তুমি কি শুনেছ, বছরখানেক আগে তাকে আক্রমণ করা হয়েছিল এবং সে মাস দুই হাসপাতালে ছিল?’

‘হ্যাঁ, শুনেছি।’

‘তার ওপর কে হামলা করেছে?’

‘আমি কীভাবে জানব?’

‘তোমার কী ধারণা?’

‘জানি না। হতে পারে এমন কেউ, যার সঙ্গে তার বিরোধ। হয়তো কোনো মেয়ের পরিবার, যাকে সে হয়রানি করেছে।’

‘বিশেষ কারও কথা বলতে পারো?’

‘না, যেহেতু সে আমাদের কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না।’

‘তাহলে তুমি সত্যিই জানো না, সে এখন কোথায়?’

‘না, আমি জানি না, জানতে চাইও না।’

সে লোক ডেকে পাঠায়। মাথায় আবার মোটা কাপড়ের ব্যাগ পরিয়ে টেনে বাইরে নিয়ে যায়। আবার দেয়ালের পাশে দাঁড় করানো হয়। হঠাৎ লাগাতার চড় আর লাথি আমার ধৈর্য ও ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। পা দুটো আমাকে ধরে রাখতে পারছিল না। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ি। সৈন্যরা ছুটে এসে মারতে শুরু করে, চিৎকার করে উঠে দাঁড়াতে বলে। আমি এত ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত যে তাদের মারধর আর গায়ে লাগে না। বহুবার মারে, দাঁড় করাতে চায়, কিন্তু আমি চাইলেও আর দাঁড়াতে পারি না। কাঁধ ধরে দাঁড় করালে আবার বসে পড়ি। আবারও মারধর করে, দাঁড় করায়, আবারও পড়ে যাই।

একসময় মনে হয়, পুরো তদন্তকেন্দ্রটি প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আন্দাজ করি, এটি নতুন দিনের সূচনা। একটি ঘরে নিয়ে আমার মাথার বস্তা খুলে দেওয়া হয়। দেখি সামনে সাত-আটজন বসা। কিছু বোঝার আগেই একজন পায়ে লাথি মারে, আরেকজন বুকে ধাক্কা দেয়, আমি মেঝেতে পড়ে যাই, হাতকড়ার লোহার কড়া আমার পিঠে ঢুকে যায়। একজন বুকের ওপরে উঠে গলা চেপে ধরে, আরেকজন পেটে দাঁড়িয়ে পায়ের পাতা মাড়ায়। তৃতীয়জন পা দুটো ফাঁক করে ধরে, চতুর্থজন অণ্ডকোষে চাপ দিতে থাকে।

একসময় সবাই থামে। বুকে বসা ব্যক্তিটি জিজ্ঞেস করে, ‘হাসান কোথায়?’

‘জানি না।’

আবার একই ধারা শুরু হয়। আবার থামে, আবার একই প্রশ্ন চলে। একই উত্তর। তারপর আবার, তারপর আবার। একসময় বুঝতে পারে যে সত্যিই জানি না। এক সৈন্য আমাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, আমি সিদ্ধান্ত নিই যে আর দাঁড়াব না। ইব্রাহিমের চিৎকার শুনতে পাই। নিশ্চয় তার সঙ্গেও একই ব্যবহার করছে।

একটা অন্ধকার সেলে ঠেলে ঢুকিয়ে আমার মাথার বস্তা খুলে দেয়। আরও এক যুবককে ঠেলে দেওয়া হয়। তার মাথার বস্তা সরানোর পর এসে আমার পাশে বসে। নিজের নাম জানায়। দুই মাস এখানে আছে। পরে আরও পাঁচজন যুবককে ঢোকানো হয়। তাদের সবাইকে লাঠি দিয়ে পেটানো হচ্ছে, আর তারা ঠেকানোর চেষ্টা করছে। স্থির হওয়ার পর তারা নিজ নিজ পরিচয় দিয়ে জানতে চায়, আমরা কেন এখানে। সঙ্গী যুবকটি তার নিজের মামলার কথা খোলামেলা জানায়, কী কী সে লুকিয়ে রেখেছে। তারা তাকে সাবধান করে। জানায় যে তার গ্রেপ্তারির কথা বাইরে পাঠানো হবে, যেন প্রতিরোধযোদ্ধারা সতর্ক হয়। এরপর আমার দিকে তাকায়।

ইয়াহিয়া সিনওয়ারের উপন্যাস আশ-শাওক ওয়াল কারানফুল

হঠাৎ মনে হয়, এরা গুপ্তচর—আমার কাছ থেকে তথ্য বের করতে চাইছে। দরজা আবার খুলে যায় এবং জেলার আমাকে বাইরে ডেকে নেন। মাথায় আবার বস্তা পরিয়ে অন্য সেলে নিয়ে যায়। সেখানে তিন মাসের প্রশাসনিক আটকাদেশ ঘোষণা করা হয়। কাপড় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।

বন্দীরা আমাকে উষ্ণ স্বাগত জানায়। আমার বিছানা গুছিয়ে দেয়, ব্যবহারের জিনিসপত্র ঠিক করে, চা বানিয়ে দেয় এবং গোসলের ব্যবস্থা করে। রাতে সবাই একসঙ্গে বসে আলাপ-পরিচয় হয়। পরদিন সকালে কক্ষের দুই নেতা নিজেদের পরিচয় দিয়ে জানায় যে তারা আমার ভাই মেহমুদ, আমার আরেক ভাই হাসান এবং প্রতিবেশী পপুলার ফ্রন্টের আবদুল হাফিজ সম্পর্কে জানে। মানে শতভাগ নিশ্চিত করে যে তারা বিশ্বস্ত। তারপর আমার মামলার ব্যাপারে জানতে চায়। তাদের বিস্তারিত জানাই যে হাসান অনেক বছর ধরে আমাদের সঙ্গে থাকে না, আমরা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি।

কয়েক দিন পরই জেলার আমার নাম ধরে ডাকেন। আমার নিজের জিনিসপত্র ও পোশাক ফেরত দেন। জানান, আমাকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বাসই হচ্ছিল না। মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছি, কিন্তু মনে তখনো ঘুরছে, হাসানকে নিয়ে এত প্রশ্ন কেন?

আমি বাড়ি পৌঁছানোর আগেই খবর পৌঁছে গেছে। মা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেন, প্রতিবেশীদের অভিনন্দন জানান। সপ্তাহখানেক পরে এক বিকেলে, দরজায় দ্রুত কড়া নেড়ে একজন উল্লাস করে বলে, ইব্রাহিমকেও মুক্তি দেওয়া হয়েছে!

রাতে একান্তে বসে ইব্রাহিমের সঙ্গে কারাজীবনের আলাপ করি। সে বলে, ‘প্রথমে তুমি যাদের গুপ্তচর ভেবেছ, ওটা আসল ফাঁদ ছিল না। ফাঁদ ছিল পরেরটা।’

‘তুমি বলতে চাচ্ছ, যেখানে আমাকে বন্দীরা সংবর্ধনা দিয়েছে?’

‘হ্যাঁ, একদম তা-ই।’

আমি গভীর চোখে ইব্রাহিমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি, ‘ইব্রাহিম, হাসান কোথায়?’

সে খুব নির্লিপ্ত উত্তর দেয়, ‘ভুলে যাও। আসল কথা হলো, হাসান আর আমাদের বিরক্ত করবে না, পরিবারের সম্মান আর ক্ষুণ্ন করবে না।’

বুঝতে পারি যে সে তার শপথ বাস্তবায়ন করেছে।

পরদিন ভোরে বের হই, ভালোবাসার মানুষকে দেখা যায় কি না। দেখি, সে গলি থেকে বেরিয়ে আসছে। একঝলক আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। তার ঠোঁট নড়া দেখে মনে হয়, সে আলহামদুলিল্লাহ বলছে; কিংবা আমি নিজেই হয়তো তা কল্পনা করছি।


আরবি থেকে অনুবাদ মনযূরুল হক