আর্নেস্তো চে গুয়েভারা ও মিখাইল শলোকভ
আর্নেস্তো চে গুয়েভারা ও মিখাইল শলোকভ

হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া লেখা

বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারার বই দ্য রেমিনিসাঁস অব অব দ্য কিউবান রেভল্যুশনারি ওয়ার হলো ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে বিপ্লবের আখ্যান। আর মিখাইল শলোকভের অ্যান্ড কোয়ায়েট ফ্লৌজ দ্য ডন হলো উপন্যাসের আবরণে ইতিহাসের গল্প।

তখন কলেজে পড়ি। রাজনীতি তেমন বুঝি না। ছাত্র ইউনিয়নে তখন দুটো গ্রুপ—মেনন গ্রুপ আর মতিয়া গ্রুপ। এই গ্রুপিং কেন, এটা বুঝতে আমার ছয় মাস লেগে গেল।

১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর। মাওলানা ভাসানী পরপর দুই দিন হরতাল ডাকলেন। দেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। উনসত্তরের জানুয়ারিতে শুরু হলো ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন। তারুণ্যের যে উন্মাদনা দেখলাম, তার স্রোতে আরও অনেকের মতো আমিও গা ভাসিয়ে দিয়েছিলাম।

১৯৭০ সালের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। তখন জাতীয়তাবাদের জোয়ার। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে ক্যাম্পাস মুখর। একই সঙ্গে আছে অন্যান্য স্লোগান—‘তোমার আমার ঠিকানা, ক্ষেত খামার আর কারখানা’ কিংবা ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো, সমাজতন্ত্র কায়েম করো’। ঠিক এই সময় দুটো বই এল বাজারে।

পেঙ্গুইন পাবলিশার্সের পেপারব্যাক। একটার নাম দ্য রেমিনিসেন্স অব অব দ্য কিউবান রেভল্যুশনারি ওয়ার, অন্যটা গেরিলা ওয়ারফেয়ার। দুটো বইয়ের লেখকই আর্নেস্তো চে গুয়েভারা।

চে বলিভিয়ায় সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন। তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছিল। ঢাকার কোনো পত্রিকায় এ নিয়ে কোনো সংবাদ ছাপা হয়েছিল কি না, মনে নেই। এ দেশের কমিউনিস্টরা তখন চে গুয়েভারাকে তেমন গণ্য করতেন না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের প্রথাগত ধারার বাইরে গিয়ে চে গুয়েভারা ও তাঁর সহকর্মীরা যে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছিলেন, তার ফলে তাঁদের কপালে একটা তকমা বা গালি জুটেছিল—‘ট্রটস্কিপন্থী’, অর্থাৎ খুব খারাপ লোক। দ্য রেমিনিসেন্স অব অব দ্য কিউবান রেভল্যুশনারি ওয়ার বইটি কিউবার বিপ্লবী আন্দোলন নিয়ে লেখা। ১৯৫৯ সালে ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে একদল তরুণ গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে স্বৈরাচারী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল বাতিস্তা সরকারকে উত্খাত করে দুনিয়াজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। চের ওই বই পড়ে অনেক শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম—রেইড, অ্যাম্‌বুশ, বুটিট্র্যাপ, স্নাইপিং ইত্যাদি।

দুই শতাধিক বিপ্লবী যোদ্ধা ‘গ্রানমা’ নামের একটা নৌকায় করে মেক্সিকো থেকে কিউবায় যাওয়ার পথেই বিমান হামলায় অনেকেই নিহত হন। যাঁরা বেঁচে ছিলেন, তাঁরা আবার সংগঠিত হয়ে দুই বছরের মধ্যেই স্বৈরাচারের পতন ঘটান। এ রকম বই এর আগে পড়িনি। বইটি মনে দাগ কেটেছিল। মনে আছে, এ নিয়ে পরে একটা কবিতা লিখেছিলাম। তার শেষ অংশটুকু ছিল এ রকম:

হঠাৎ এই শহরে এলেন

চে গুয়েভারা

পেঙ্গুইনের পেপারব্যাকে মোড়া

স্মৃতিজাগানিয়া দুটো বছর

গ্রানমার পালে হাওয়া লেগে

তরি এসে ভিড়ল আমার

বুকের ঠিক মাঝখানটায়

নেশা ধরে গেল রক্তে।

আমি বুঝলাম, কেন সুকান্ত লেখেন

‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ’।

সে এক প্রবল জোয়ার

আমাকে ভাসিয়ে নেয়

বিপ্লবের সামনের কাতারে।

দ্য রেমিনিসেন্স অব অব দ্য কিউবান রেভল্যুশনারি ওয়ার

বইটি পড়ে কিউবার বিপ্লব বোঝার চেষ্টা করেছি! অনেক বছর পর সুযোগ হয়েছিল সেখানে যাওয়ার। যখন কিউবায় গিয়েছিলাম, তখন একদিন আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হাভানা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে একটা সিগার ফ্যাক্টরি দেখাতে। যাওয়ার পথটা অপূর্ব। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা। দুপাশে ঘন বন। পথের বাঁকগুলো এমন, যেন মনে হয় এখানে গাছের আড়ালে বসে গেরিলারা স্লাইপিং করতেন কিংবা অ্যাম্‌বুশের মাধ্যমে পুলিশ-মিলিটারির গাড়ি-লরি উড়িয়ে দিতেন বা দখলে নিতেন। গেরিলা যুদ্ধের জন্য এমন ল্যান্ডস্কেপই তো চাই!

২.

স্কুলজীবন থেকেই আমি বইয়ের পোকা। অনেক উপন্যাস পড়েছি। শুরুটা শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রামের সুমতি দিয়ে। শেষ কোনটা পড়েছি, মনে নেই। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটু–আধটু ইংরেজি বুঝি। তাই সম্বল করে ইংরেজি ভাষায় লেখা বিদেশি বই পড়ার চেষ্টা করি।

তত দিনে আমার এমএ পরীক্ষা হয়ে গেছে। দেশে সামরিক শাসন। আমি তখন পালিয়ে বেড়াই। আজ ঢাকায়, তো কাল সিলেট, পরশু কুমিল্লায়। কুমিল্লা রেলস্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। যাব সিলেটে। প্ল্যাটফর্মের মধ্যে একটা বইয়ের দোকান। চোখ পড়ল মিখাইল শলোকভের অ্যান্ড কোয়ায়েট ফ্লৌজ দ্য ডন বইটি। চার খণ্ডের এ বই ছেপেছে মস্কোর প্রগ্রেস পাবলিশার্স, ১৯৭৪ সালের মুদ্রণ। এ বইয়ের নাম অনেক শুনেছি। এটাও শুনেছি, শলোকভকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। তিনি সেটা নেননি বা সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসকেরা তাঁকে সেটা নিতে দেননি।

অ্যান্ড কোয়ায়েট ফ্লৌজ দ্য ডন

আমি এর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট বিপ্লবের ইতিহাস নিয়ে দুটো বই পড়েছিলাম। একটা স্তালিনের লেখা, অন্যটা ট্রটস্কির। শলোকভের উপন্যাসটিও এক অর্থে রুশ বিপ্লবের ইতিহাস। তবে এখানে কমিউনিস্ট পার্টির বয়ান, জেনারেলদের রণকৌশল আর অন্যান্য রীতিমাফিক ভাষ্য দেওয়া হয়নি। শলোকভের লেখায় রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের কথা, বিশেষ করে কৃষকের কথা উঠে এসেছে। আর আছে গৃহযুদ্ধের কথা। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল দুটি পক্ষ। একদিকে বুর্জেয়া আর সামন্ত প্রভুদের সমর্থনে হোয়াইট আর্মি, অন্যদিকে শ্রমিক–কৃষকের পক্ষে রেড আর্মি। ওই সময় আওয়াজ উঠেছিল—শ্বেত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লাল সন্ত্রাস ছড়িয়ে দাও। পরে লালসন্ত্রাস নামে আমি একটা বই লিখেছিলাম। অনেকেই শব্দটির অর্থ না বুঝে আমার ওপর খড়্গহস্ত হয়েছেন।

শলোকভ পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, আমার চোখের সামনেই সব ঘটছে। বিপ্লব মানে শুধু ইনসারেকশন নয়, জারের বদলে পাটি নয়, পুরো সমাজটাই ভাঙছে। শুধু ক্ষমতার পালাবদল নয়, এর সঙ্গে মিশে আছে কোটি কৃষকের ঘাম ও রক্ত। সবকিছুই চমৎকার নয়। বিপ্লবের বিশাল ক্যানভাস জুড়ে আছে অনেক আর্তনাদ, অনেক কান্না। সব ছাপিয়ে উঠে এসেছে এক কসাক যুগলের প্রেমকাহিনি। অদ্ভুত সুন্দর বেদনাময় পরকীয়া—সৈনিক গ্রিগরির সঙ্গে প্রতিবেশী আকসিনিয়ার উথাল–পাথাল সম্পর্ক। বইটি পড়ার মুগ্ধতা থেকে আমি একটি কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলাম:

ধীরে বহে ডন

এ বইটা পড়তে পড়তে

আমি আকসিনিয়ার

প্রেমে পড়ে যাই

চাষবাস গৃহযুদ্ধ

এবং নেশাজাগানিয়া

একটা জমাট গল্প

তথাপি শেষ দৃশ্যটা

ছিল অন্য রকম

অবশেষে সব পাখি

ঘরে ফিরে যায়।

গ্রিগরি আর আকসিনিয়ার চোখ দিয়ে আমি রুশ বিপ্লব বোঝার চেষ্টা করেছি।

আমরা তো কত বই–ই পড়ি। কখনো তথ্যের জন্য, কখনো বিনোদনের জন্য। কিছু বই মন কেড়ে নেয়, হৃদয় ছুঁয়ে যায়। অনেক সময় তা আমূল বদলে দেয় চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি। এখানে যে দুটো বইয়ের উল্লেখ করলাম, আমার ওপর সেগুলোর প্রভাব ছিল সীমাহীন। প্রথম বইটি পড়ে আমি বিপ্লবের অনিশ্চিত পিচ্ছিল পথে বের হয়েছিলাম। গন্তব্য খুঁজে না পেলেও পথে বের হওয়াটাই ছিল মুখ্য। সবাই পারে না।

আর দ্বিতীয় বই ছিল উপন্যাসের আবরণে ইতিহাসের গল্প। জীবনে যুদ্ধ আর প্রেম একসঙ্গে মিশে আছে। কখনো তা সফল, কখনো তা বিয়োগান্ত। এ বইয়ে আমি যেন আমাকেই খুঁজে পেয়েছি।