বইপত্র

বাংলাদেশের উৎপত্তির ইতিকথা

ঢাকায় ঢুকছেন মুক্তিযোদ্ধারা, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
ঢাকায় ঢুকছেন মুক্তিযোদ্ধারা, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

বাংলাদেশের গৌরবময় স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিকথা নিয়ে জাতীয় অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের লেখা আকরগ্রন্থ জেনেসিস অব দ্য বাংলাদেশ ওয়ার অব ইনডিপেনডেন্স। গ্রন্থটিতে যুদ্ধদিনের কথা নয়; বরং যুদ্ধ শুরুর পেছনের গল্প উপস্থাপন করা হয়েছে, যা থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বহুমাত্রিকতা সম্পর্কে জানা যায়। আলোচ্য গ্রন্থটিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির অসারতা ও অযৌক্তিকতার পক্ষে নানা সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপিত হয়, যা ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানের ভাঙন নিশ্চিত করে। লেখক দেখিয়েছেন, কীভাবে জাতি গঠনের ক্ষেত্রে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা, রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ক্রমবিকাশ, দুই প্রান্তের জন্য দুই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রস্তাব, ছয় দফা ও পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন, সত্তরের নির্বাচন এবং নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি—এসব বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল।

ঝরঝরে ইংরেজিতে রচিত গ্রন্থটির মুখবন্ধের শুরু ‘দিস ইজ আ স্টোরি অব দ্য জেনেসিস অব দ্য বাংলাদেশ ওয়ার অব ইনডিপেনডেন্স’ বাক্যটি দিয়ে। একটি গবেষণাগ্রন্থের সূচনায় ‘স্টোরি’ কথাটি উল্লেখ করায় সাধারণ পাঠক বইটিকে দূরে সরিয়ে দেবে না। ‘স্টোরি টেলিং’ বা গল্প বলার মাধ্যমে গবেষণা উপস্থাপিত হওয়ায় পাঠকের নিকট তা সুখপাঠ্যই মনে হবে। ভূমিকার শুরুতে লেখক বলছেন, বিশ শতকের মাঝামাঝিতে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের অভ্যুদয় অনিবার্য ছিল। গল্পের শুরু ১৯০৫ সালের বাংলা বিভাগ দিয়ে, যা ছিল অনেকটা ১৯৪৭ সালের ভারতবিভক্তির পূর্বাভাস। সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত অধ্যায় এই বঙ্গভঙ্গ। কিন্তু আলোচ্য গ্রন্থে বৃহত্তর বাংলা নিয়ে সাম্প্রদায়িক সীমারেখা অঙ্কনের আদ্যোপান্ত ব্যাখ্যা করা হয়েছে, বাঙালি মুসলমান, বাঙালি হিন্দু ও ব্রিটিশরাজের দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরা হয়েছে একটা নির্মোহ বিশ্লেষণ, যা থেকে বোঝা যায়, এই বিভক্তির ক্ষেত্রে ধর্মীয় নয়; বরং আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। উপরন্তু ইংরেজ-প্রণীত ‘ভাগ করো, শাসন করো’-এর বীজও বোনা হয় এ সময়ে।

বঙ্গভঙ্গ–পরবর্তী সাম্প্রদায়িক ভেদরেখার কারণে ক্রমে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাজনৈতিক অনুশাসন, নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা এবং সর্বোপরি পৃথক আবাসভূমির গুরুত্ব উপলব্ধি হয়। আর ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে তার প্রাতিষ্ঠানিক ও ভৌগোলিক ভিত্তি রচনা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের উপস্থাপক এ কে ফজলুল হকের উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাবের বিপরীতে ১৯৪৬ সালের দিল্লি সংশোধনীতে হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত দুটি পৃথক ভূখণ্ড নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের সুপারিশ করা হয়। একটিমাত্র ‘এস’–এর (two sovereign states/one sovereign state) জন্য বাংলাদেশের জন্মক্ষণ সিকি শতাব্দী পিছিয়ে যায়।

আলোচ্য গ্রন্থটিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিতে বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান যে কোনোভাবেই একীভূত হতে পারেনি, তার একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলের মুসলমান–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে পাকিস্তান নামটি গৃহীত হয়েছিল, যা অনেকেরই জানা। কিন্তু ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত নতুন পাকিস্তানের মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬ শতাংশ পূর্ব বাংলায় বসবাস করা সত্ত্বেও বাংলা নামের আদ্যাক্ষর নবগঠিত রাষ্ট্রে সংযোজিত হয়নি, যা থেকে পাকিস্তানে বাংলার অন্তর্ভুক্তির অসারতা প্রমাণিত হয়। পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল ১৯৩০ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের যে রূপরেখা দিয়েছিলেন, সেখানেও বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল না। সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতির ধারক ও বাহক দুই জনগোষ্ঠীকে কেবল ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে একসুতায় গাঁথার পরিকল্পনাটি ছিল অসম্ভব ও অবাস্তব। এই প্রক্রিয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সমর্থন ছিল না, যাঁদের মধ্যে জেনারেল নিয়াজি ও আইয়ুব খানও ছিলেন। অথচ সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেই অবাস্তব রাষ্ট্রটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাঁরা কাজ করেছেন, দমন-পীড়ন করেছেন।

এসব কম জানা তথ্য এবং ব্যাখ্যার পাশাপাশি এই বইয়ে প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে এসেছে জানা কিছু প্রসঙ্গ; যেমন পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ, সামরিক কর্তা, আমলা ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যক্তিরা ইসলাম ধর্মকে আদর্শগত ভিত্তি ধরে নিয়ে রাষ্ট্রের দুই বিচ্ছিন্ন অংশকে এক রাখতে সক্ষম বলে মনে করলেও বাঙালি মুসলমানদের তাঁরা প্রকৃত মুসলমান বলে স্বীকার করতেন না; ‘হাফ মুসলিম’, এমনকি ‘কাফির’ বলতেও দ্বিধা করতেন না। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষও বাঙালিদের নিচু জাতের মনে করত। তারা বাঙালিদের গাত্রবর্ণ ও উচ্চতা নিয়ে কটাক্ষ করত। পাকিস্তান আমলের সেই অসম্মানের যন্ত্রণাই পূর্ব বাংলার মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছিল, যা ক্রমান্বয়ে তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী চেতনার সঞ্চার করে। এরপর ভাষার প্রশ্নে বিরোধ এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও সামরিক নিগ্রহ—সর্বোপরি অর্থনৈতিক বৈষম্য পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙন সম্পূর্ণ করে।

বস্তুত, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি আত্মপ্রকাশ করে একটি ভঙ্গুর অস্তিত্বের সাক্ষ্য নিয়ে। একটি রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক পরিচয়, জাতীয় ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য অপরিহার্য। কিন্তু এই কৃত্রিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের এসব অপরিহার্যতার বিষয়কে উপেক্ষা করা হয়। ভাষা, রীতিনীতি, মূল্যবোধ, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, এমনকি সময় ও বর্ষপঞ্জিতেও বৈসাদৃশ্য নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠিত হতে পারে না—এটাই ইতিহাসের পরম সত্য। উপরন্তু মানুষের অধিকার হরণ করে নির্যাতন চালিয়ে কোনো শাসনই স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না—ইতিহাসের এই সত্যই প্রতিভাত হয়েছে একাত্তরে। জেনেসিস অব দ্য বাংলাদেশ ওয়ার অব ইনডিপেনডেন্স গ্রন্থে কথাগুলো বিশদে আলোচিত হয়েছে।

সালমা বিনতে শফিক

জেনেসিস অব দ্য বাংলাদেশ ওয়ার অব ইনডিপেনডেন্স

আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন; প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০২৪; প্রচ্ছদ: মাহবুব রহমান; ২৯৬ পৃষ্ঠা; দাম: ৭০০ টাকা।

বইটি পাওয়া যাচ্ছে: prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে