বাংলাদেশের রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতি পরিসরে ‘তত্ত্ব কপচানো’ বলে ‘তত্ত্ব’কে যেভাবে চিহ্নিত করা হয়, তাতে সামগ্রিকভাবে নেতিবাচক মনোভঙ্গি স্পষ্টত ধরা পড়ে। তত্ত্ব করাকে স্রেফ বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতা ভাবা হয়, অথবা ইউরোপ থেকে আগত তত্ত্বের প্রতি অন্ধবিশ্বাস, অথবা তত্ত্ব করা শেষ, বাকি কেবল প্রয়োগ; মোটা দাগে বাংলাদেশের গণপরিসরে তত্ত্ববিষয়ক অবস্থানগুলোর দুর্বলতা ও অসারতা সারোয়ার তুষার যে চিহ্নিত করেছেন, তা চিন্তার অর্কেস্ট্রার ভূমিকাংশেই দাবি করেছেন। চিন্তার অর্কেস্ট্রাগুলো মোকাবিলা করার কায়দা হিসেবে দুনিয়ার চিন্তার বাজারে গোলার্ধের এই অংশের প্রভাবশালী পাঁচ তাত্ত্বিকের মোলাকাত করার কোশেশ করেছেন।
সারোয়ার তুষার ভারতীয় পাঁচজন চিন্তক ও তাত্ত্বিকের সাতটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। পাঁচজনই—দীপেশ চক্রবর্তী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুদীপ্ত কবিরাজ, আদিত্য নিগম ও প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজ নিজ জমিনে মশহুর। তাঁদের সঙ্গে সওয়াল-জবাবের মাধ্যমে বিদ্যমান তত্ত্ব জগতের এক দারুণ খতিয়ান পাওয়া যায় বইজুড়ে।
যে ধরনের গভীর বোঝাপড়ার নিয়তে তুষার মশহুর পাঁচ তাত্ত্বিকের সঙ্গে বাতচিত ও বাহাসে লিপ্ত হয়েছেন, তা আমাদের দেশের সাহিত্য জগতে খুব অভিনব ও বিরল। অর্থাৎ, খোদ সওয়ালকারী যে ধরনের আত্মবিশ্বাস ও পাণ্ডিত্য নিয়ে ওনাদের সামনে হাজির হয়েছিলেন, তাতে সাক্ষাৎকার নেওয়ার আমাদের চেনা গণ্ডি একেবারে ভেঙে যায়। অন্তত বাংলা ভাষায় এ ধরনের ক্রিটিক্যালি এঙ্গেজ হওয়ার নজির একদম নেই বললেই চলে।
দীপেশ, পার্থ, কবিরাজ, নিগম ও প্রথমা—সবার কাজ প্রকাশিত ও বহুল প্রচারিত। তবে এই পাঁচজনের মধ্যে দীপেশ ও পার্থ আমাদের এখানে বহুল পরিচিত হলেও, সুদীপ্ত, নিগম ও প্রথমা তুলনামূলক কম পঠিত। তাঁরা এই গ্রন্থে এমন কোনো নতুন তত্ত্ব বা তথ্য হাজির করেননি বা তাঁদের পাঠকদের জন্য এমন নতুন কোনো তাত্ত্বিক প্রস্তাবও দেননি। সওয়াল-জবাবের কসরতে সেটা সম্ভবও হয় না। এই আশা করাও উচিত হবে না। উপনিবেশোত্তর রাষ্ট্র ও রাজনীতি তাঁদের সামনে যে বাস্তবতা হাজির করেছিল, তাতে হালফিল জমানার বিভিন্ন শক্তিশালী বর্গকে ‘সর্বজনীন’ হিসেবে বিবেচনা না করে ক্রিটিক্যালি দেখার জন্য তাঁরা সিদ্ধহস্ত ও পরিচিত। দীর্ঘদিন যাবৎ পুঁজি, পুঁজিবাদ, ইউরোপকেন্দ্রিকতা, আধুনিকতা, উপনিবেশায়ন, আধুনিক রাষ্ট্র, সেক্যুলারবাদ, সাব–অল্টারনিটি, ইতিহাসপদ্ধতি ইত্যাদি প্রশ্ন গ্লোবাল সাউথ বা আমরা যাকে তৃতীয় বিশ্ব বলেও দাবি করি, তা থেকে মোকাবিলা করে যাচ্ছেন। তাঁরা কেবল নানা ময়াদান থেকে পশ্চিমা তত্ত্বের সমালোচনা করেই ক্ষান্ত দিচ্ছেন না, বরং নিজেরাই কীভাবে তত্ত্ব করতে পারি, সে বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন।
ফলে, চিন্তার অর্কেস্ট্রা আপাতপ্রকাশিত ও চেনা ‘জিনিস’ আমাদের সামনে হাজির করেছে বলে মনে হলেও, এর গুরুত্ব আসলে অন্যত্র। প্রথমত, সওয়ালকারী এমনভাবে তাঁর প্রশ্নগুলো সাজিয়েছিলেন যে তাঁদের চিন্তার এক ধারাবাহিক ইতিহাস দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। এতে যেমন তাঁদের চিন্তার বিকাশ, তেমনি পরিবর্তনের ধারাও ঠাহর করা যায়।
দ্বিতীয়ত, তুষার এই সব চিন্তকের চিন্তাকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেক্ষাপটে ও সমসাময়িক বাস্তবতায় হাজির করার কোশেশ করেছেন। অর্থাৎ কেবল গ্লোবাল সাউথই নয়, বরং বাংলাদেশের বাস্তুবতা ও নিজস্বতার নিরিখে তাঁদের তত্ত্বকথার একটা পর্যালোচনা হাজির করার রাস্তা খোঁজার কোশেশ করেছেন।
তৃতীয়ত, চিন্তার অর্কেস্ট্রা খুব সচেতনভাবে পাঁচ চিন্তকের তত্ত্ব ও চিন্তাকে একটা বাহাসে লিপ্ত করেছে। যেহেতু প্রায় একই সময়ে এই পাঁচ তাত্ত্বিক কাজ করছেন দুনিয়ার একই অংশ থেকে এবং একই অংশকে নিয়ে, ফলে তাঁরা একে অপরকেও ক্রিটিক্যালি পাঠ ও বিবেচনা করেন। এসব সাক্ষাৎকার হয়ে উঠেছিল তাঁদের নিজেদের বাহাসের আরেক ময়দান।
আমাদের এখানে নানা ‘মতবাদ’চর্চার নামে তরুণ প্রজন্মকে যে মান্ধাতার আমলের জিনিসের বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়, তা থেকে নিস্তার পেয়ে আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির বিউপনিবেশায়ন কীভাবে ঘটাতে পারি, সে পথের সন্ধান দিতে সাহায্য করবে এই গ্রন্থ। প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় বলতে হয়, ‘পশ্চিমা তত্ত্বচিন্তার আলোচনা বা প্রাদেশিকীকরণই আর যথেষ্ট নয়; খোদ তত্ত্বেরই নতুন তত্ত্বায়ন জরুরি’। চিন্তার অর্কেস্ট্রা সেই তত্ত্বায়নে সহায়ক হয়ে উঠবে বলে আশা রাখি।
সহুল আহমদ
চিন্তার অর্কেস্ট্রা: পাঁচ বিশিষ্ট চিন্তকের সঙ্গে আলাপচারিতা
সারোয়ার তুষার
প্রকাশক: গ্রন্থিক ঢাকা; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৩; প্রচ্ছদ: জাহিদ সবুজ; ২৬০ পৃষ্ঠা; দাম: ৭০০ টাকা।