মানুষ আর বই পড়ে না, চারপাশে এমন রবের মধ্যেই করোনা মহামারির পর বিশ্বব্যাপী আবার বেড়েছে বইয়ের বিক্রি। নানা গবেষণা ঘেঁটে লিখেছেন মারুফ ইসলাম
প্রায়ই শোনা যায়, মানুষ আর আগের মতো বই পড়ে না। হাতের মুঠোয় ফেসবুক-ইউটিউব, মানুষ শুধু ভিডিও দেখে। বই আর পড়ে না। কিন্তু গবেষণা,
জরিপ ও পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। তথ্য–উপাত্ত বলছে, আবারও বইয়ের কাছে ফিরছেন মানুষ।
‘আবারও’ শব্দটি একটু গুরুত্বের সঙ্গেই ব্যবহার করা হলো এ কারণে যে বেশির ভাগ মানুষের বদ্ধমূল ধারণা, বইয়ের জায়গা দখল করে ফেলেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সেই জায়গা আর কখনোই পুনরুদ্ধার করতে পারবে না বই। কিন্তু সাম্প্রতিক তথ্য–উপাত্ত জানাচ্ছে, আবারও বইয়ের কাছে ফিরছেন মানুষ। বিশেষত, করোনা মহামারির পর বইপড়ুয়াদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে।
২০২০ সালে করোনা শুরু হওয়ার পর প্রায় সব ধরনের ব্যবসায়ীর যখন নাকানিচুবানি অবস্থা, তখন একমাত্র ব্যতিক্রম অবস্থা দেখা গেছে বই ব্যবসায়ীদের। আর সব ব্যবসায় যখন ধস নামছিল, তখন শনৈঃ শনৈঃ বাড়ছিল বইয়ের ব্যবসা। এ যেন ‘কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ’ বাগ্ধারার চাক্ষুষ দৃশায়ন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত ব্যবসাবিষয়ক সামায়িকী পাবলিশার্স উইকলি বলছে, করোনা শুরুর পর ২০২০ সালে ছাপা বইয়ের বিক্রি বেড়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। বই বিক্রির এই ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত ছিল ২০২১ ও ২০২২ সালেও।
রীতিমতো অঙ্ক কষে বই বিক্রির ঊর্ধ্বগতি দেখিয়েছে জার্মানভিত্তিক তথ্য, জরিপ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিসটা। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বই বিক্রি হয়েছে ২৭ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। তার আগের বছর বিক্রি হয়েছিল ২৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের বই।
যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরনের প্রকাশনী রয়েছে ২ হাজার ৬০০। ২০২১ সালে তারা বই ছেপেছে ৮২৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন।
ছাপা বইয়ের পাশাপাশি অনলাইনে বইপড়ুয়াদের সংখ্যাও বাড়ছে। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ই-বুক পাঠকের সংখ্যা ছিল ৯৫০ দশমিক ৫ মিলিয়ন। গত বছর তা বেড়ে হয়েছে ১ দশমিক ১১ বিলিয়ন।
বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, গল্প–উপন্যাসের বই–ই বুঝি মানুষ বেশি পড়েন। এত দিন হয়তো পড়তেনও। কিন্তু গত দুই–তিন বছরে গল্প–উপন্যাসের চেয়ে নন–ফিকশন বইয়ের পাঠক বেড়েছেন। প্রকাশনা সংস্থা পেঙ্গুইন র্যানডম হাউস বলছে, গত বছর গল্প–উপন্যাসের বই বিক্রি করে আয় হয়েছে ৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে নন–ফিকশন বই বিক্রি করে আয় হয়েছে ৬ দশকি ১৮ ডলার।
কৌতূহলী হয়ে জানার ইচ্ছা হলো, কোন ধরনের নন–ফিকশন মানুষ বেশি পড়ছে। বই বিক্রির শীর্ষস্থানীয় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম অ্যামাজন বলছে, নন–ফিকশন বই বিক্রির ১ নম্বর তালিকায় রয়েছে স্মৃতিকথা ও আত্মজীবনী। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আত্ম-উন্নয়নমূলক বই। ৩ নম্বরে রয়েছে ধর্মসংক্রান্ত বই। এরপর ৪ ও ৫ নম্বর অবস্থানে রয়েছে যথারীতি স্বাস্থ্যবিষয়ক বই ও রাজনীতিবিষয়ক বই।
গল্প–উপন্যাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে রোমান্টিক ঘরানার বই। এরপর ক্রাইম ফিকশন। ৩ নম্বরে রয়েছে ধর্মাশ্রয়ী গল্প-উপন্যাস। চতুর্থ বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে ভৌতিক ঘরানার বই।
এত যে বই বিক্রি হচ্ছে, বই পড়ার হার বাড়ছে তো? নাকি সবই ফক্কিকার! ওয়ার্ল্ড কালচার স্কোর ইনডেস্ক বলছে, সারা বিশ্বেই বই পড়ার সময় বেড়েছে। যুক্তরাজ্যে একজন বয়স্ক মানুষ সপ্তাহে ৫ ঘণ্টা বই পড়েন। আর ২৫ বছরের কম বয়সীরা সপ্তাহে আড়াই ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন বই পড়ার পেছনে। মার্কিনরাও সপ্তাহে গড়ে ৫ ঘণ্টা বই পড়ে।
তবে বই পড়ার দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে এশিয়ার মানুষেরাই। ভারতের মানুষেরা সপ্তাহে ১০ ঘণ্টা ৪২ মিনিট বই পড়ে। থাইল্যান্ডের পাঠকেরা সপ্তাহে বই পড়েন ৯ ঘণ্টা ২৪ মিনিট। আর চীনের মানুষেরা সপ্তাহে বই পড়েন ৮ ঘণ্টা।
যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মধ্যেও বই পড়ার হার বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, কিশোরদের নিয়ে লেখা নন–ফিকশন বইয়ের বিক্রি ২০২১ সালের তুলনায় গত বছর ২৩ দশমিক ১ শতাংশ বেড়েছে। ইয়ং অ্যাডাল্টের বিক্রি বেড়েছে ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ। গ্রাফিক নভেল বেড়েছে ২৯ শতাংশ। শিক্ষাসংক্রান্ত বইয়ের বিক্রি বেড়েছে ৫৫ দশমিক ৫ শতাংশ। খেলাধুলা ও শখবিষয়ক বইয়ের বিক্রি বেড়েছে ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ।
প্রযুক্তির উল্লম্ফনের এই যুগে যখন হাতের কাছেই বিনোদনের নানা উপকরণ, শেখার উপকরণে ভর্তি ইউটিউব, ফেসবুক, লিংকডইন, খান একাডেমি, টেন মিনিট স্কুল—সেখানে মানুষ কেন বই পড়বে? বই পড়ে কী হয় আসলে? যুক্তরাষ্ট্রের কিংসটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক বলছেন, বই মানুষকে দয়ালু করে। যাঁরা নিয়মিত বই পড়েন, তাঁরা অন্যদের তুলনায় বেশি দয়ালু হন।
শুধু তা–ই নয়, আপনি জানলে অবাক হবেন যে বই মানুষকে কারাগার থেকে দূরে রাখে। অর্থাৎ অন্যায়–অপকর্ম থেকে দূরে রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারগুলোয় জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ কারাবন্দীর বই পড়ার অভ্যাস নেই। কারাবন্দীরা বলেছেন, তাঁরা পাঠ্যবইয়ের বাইরে কখনো অন্য বই পড়েননি।
সুতরাং বইয়ের কাছে যে মানুষ ফিরবেই, তা জোরগলায় বলাই যায়।
সূত্র: স্ট্যাটিসটা, ওয়ার্ল্ড কারচার স্কোর ও পাবলিশার্স উইকলি