অল্পস্বল্প করে দেশভাগের বেদনাও এ উপন্যাসে হাজির করেছেন লেখক। ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার অভিশাপ, আফিম প্রচলনের ইতিবৃত্ত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার করুণ কাহিনিও বুনে দিয়েছেন।
হরিশংকর জলদাসের উপন্যাস একটু দাঁড়াও আমাদের কিছু মানুষের জীবনের নানা পর্বে নিয়ে যায়। দাঁড় করিয়ে দেয় তাদের জীবনের সুখ ও সংকটের মুখোমুখি। পাশাপাশি হাজির করে অস্থির এক সময়কে, সম্পর্কের অনাকাঙ্ক্ষিত রূপান্তর এবং জীবনের অপ্রত্যাশিত বাঁককে। বার্ধক্যে উপনীত মানুষের অসহায়ত্ব, মর্যাদাহীন অস্তিত্ব আর পালিয়ে যাওয়া জীবন এ উপন্যাসের বড় জায়গা দখল করে আছে; পাশাপাশি গড়ে উঠেছে আরও অনেক গল্প। তবে গল্পের শেষে পাঠকের চোখে ধরা দেয় ‘পরাজিত, অসহায় নিরালম্ব, উন্মূলিত’ কিছু মানুষ।
উপন্যাসটির কেন্দ্রে আছে মূলত দুটি পরিবার। একদিকে আছেন আদর্শবান মানুষ, অবসরপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি, তাঁর স্ত্রী সুনন্দা ব্যানার্জি, ডাক্তার পুত্রবধূ মণিকা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পুত্র আবির। সব ঠিকঠাক থাকার পরও হঠাৎ একদিন মা-বাবাকে ফেলে নিজের ফ্ল্যাটে চলে যান তাঁরা। মায়া, মমতা, ভালোবাসা ও পিতৃ-মাতৃঋণ অর্থহীন হয়ে ওঠে। মা-বাবার শেষ বয়সের কল্পিত স্বর্গসুখের মৃত্যু ঘটে যেন। আজীবনের সঞ্চয় দিয়ে গড়ে তোলা সুসজ্জিত বাসা থেকে পালিয়ে তাই পার্কের বেঞ্চিতে দুদণ্ডর শান্তি খোঁজেন মৃগাঙ্ক।
মো. শামিম মণ্ডল
একটু দাঁড়াও
হরিশংকর জলদাস
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০২৪; প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য; ১২০ পৃষ্ঠা; দাম: ৩৪০ টাকা।
বইটি পাওয়া যাচ্ছে: prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে
অন্যদিকে আছেন অবসরপ্রাপ্ত ঘুষখোর পুলিশ কর্মকর্তা শিশির ঘোষ, তাঁর স্ত্রী মাধুরী দেবী, দুই ছেলে অতনু, দেবরাজ, পুত্রবধূ রেখা ও পল্লবী। লেখাপড়াটা ঠিক সেভাবে হয়ে ওঠে না শিশির ঘোষের ছেলেদের। দেবরাজ হয়ে যায় সন্ত্রাসী। অতনু কামতাড়িত পুরুষ। পরিবারে ঝগড়া লেগেই থাকে। অতনু ভ্রাতৃবধূর পল্লবীর দিকে লোলুপ দৃষ্টি দেয়, তার ওপর হামলে পড়ার চেষ্টা করে, ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়। ফলে পুলিশ আটক করে এ পরিবারের তিন সদস্যকে। অতনু ধর্ষণচেষ্টার অপরাধী, দেবরাজ পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসী আর পল্লবী হত্যাচেষ্টায় অভিযুক্ত। যে বিত্তবৈভব শিশির ঘোষ দুহাতে জড়ো করেছেন, মুহূর্তে তা যেন ঘুণে খেয়ে যায়। স্বস্তি মেলে না কোথাও। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে হয় সন্তানদের অবনতি আর নিজের পরিত্যক্ত, নিঃস্ব ও মূল্যহীন দশা। তাই বাড়ি নয়, পার্কে ও বাজারে গিয়ে স্বস্তি খুঁজতে হয় শিশির ঘোষকে।
উপন্যাসটি পড়তে পড়তে আমাদের দেখা হয়ে যায় কিশোর গ্যাংয়ের তিন সদস্য মফিজ, ইব্রাহিম ও ইলিয়াছের সঙ্গে। তারা মনে করিয়ে দেয় হাসান আজিজুল হকের ইনাম, সুহাস ও ফেকুকে। তফাত শুধু এ–ই, আত্মজা ও একটি করবী গাছ গ্রামীণ পরিমণ্ডলের গল্প, আর একটু দাঁড়াও উপন্যাসটি নগরজীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি ও শিশির ঘোষের পরিবারের গল্পের ফাঁকে ফাঁকে উন্মূল এই কিশোর অপরাধীদের গল্প শোনা হয়ে যায় আমাদের। তাদের মর্মান্তিক জীবনবৃত্তান্ত একদিকে চোখ খুলে দেয়, অন্যদিকে মন গলাতেও কসুর করে না। না হলে তাদের গল্প শুনে শিশির ঘোষের মন আর্দ্র হয়ে উঠবে কেন! উন্মূল এই কিশোরদের জগৎজুড়ে রুক্ষতা ও উগ্রতা। সেখানে বেঁচে থাকা আর হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো ফারাক নেই। এই জগতে সন্তানকে রেখে রাতবিরাতে খদ্দেরের খোঁজে বেরিয়ে যান মা। একদিন রেললাইনে কাটা পড়তে হয় তাঁকে। বাবা রিকশা চালাতে চালাতে হঠাৎ একদিন ট্রাকে চাপা পড়ে মারা যান। এ রকম গল্পের পুনরাবৃত্তিই যেন এই কিশোরদের জীবনের সংজ্ঞা। তাই অপরাধে জড়িয়ে পড়াই তাদের নিয়তি। সেখানে জুটে যায় পুলিশ কর্মকর্তার সম্ভাবনাময় ছেলে দেবরাজ। এভাবে আমাদের সমাজকাঠামোর ভেতরেই গোকুলে বেড়ে চলে সংকটের বীজ।
অল্পস্বল্প করে দেশভাগের বেদনাও এ উপন্যাসে হাজির করেছেন লেখক। ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার অভিশাপ, আফিম প্রচলনের ইতিবৃত্ত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার করুণ কাহিনিও বুনে দিয়েছেন। এভাবে অনেক আয়োজন আছে এর ভেতরে। তাই বলা যায়, এ হলো অনেক জীবনের টুকরো কথা।
তবু একটু দাঁড়াও হয়তো হরিশংকর জলদাসের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস নয়। আরও ভালো তিনি লিখেছেন। এ উপন্যাসের অলিগলির যে ঘুপচি-ভূগোল, তা রয়ে গেছে বর্ণনার ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে। চরিত্রগুলোর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পরিপূর্ণ বিকাশ সেভাবে ঘটেনি। অল্প কিছু জায়গায় খটকাও লেগে যায়। যেমন অতনুর আচমকা ধর্ষণচেষ্টা। অসম্ভব নয়, তবে ঘটনাটি ঠিক বাস্তবসম্মত মনে হয় না। আবার বৃদ্ধ বয়সের সংকটের গল্প ধীরে ধীরে অন্য সব গল্পের কাছে প্রান্তিক হয়ে যায়।
কিন্তু সমস্ত ঘাটতি ছাপিয়ে, হরিশংকর জলদাসের কলমের জোরে বার্ধক্যের করুন পরিণতির এই আখ্যান, উঠতি প্রজন্মের সংকটের এ বৃত্তান্ত এবং প্রান্তিক জীবনের মর্মস্পর্শী এই বয়ানকে সুপাঠ্য না বলে উপায় কী!