দেশের লেখালেখির জগৎ, পাঠসংস্কৃতি নিয়ে কথা উঠছে অনেক দিন ধরে। সাম্প্রতিক গণ–অভুত্থানের পর আমাদের প্রকাশনাশিল্প ও লেখক–পাঠকের জগতের সংকট ও সম্ভাবনার বিষয়গুলো নতুনভাবে আবার আলোচনায় এসেছে
বাংলাদেশের প্রকাশনা ও লেখকের জগৎ অনেকটা লোককাহিনির সেই বিয়ের গল্পটার মতো, যেখানে কনেপক্ষের ঢোল বাজে, ‘অচল চালায়ে দিলাম, অচল চালায়ে দিলাম’ বলে, আর বরপক্ষের ঢোল বাজে, ‘কানা মেয়ে কুঁজো বর, কানা মেয়ে কুঁজো বর’ বলে! আর এমন কিম্ভূত হর-পার্বতীর মিলন দেখতে দেখতে ও ঢোলের বোল শুনতে শুনতে পাঠক এখানে অনেকটা দিশাহারা!
এই যে লেখক-প্রকাশক-পাঠকের সম্পর্কের জগৎ, তা এমনভাবে নির্মিত হলো কেমন করে?
প্রকৃতপক্ষে প্রকাশনা এমন একটা খাত, যেটা উন্নত-অনুন্নত সব দেশের জন্যই সবচেয়ে ক্ষুদ্র খাত। আমরা যদিও জানি, পৃথিবীর বৃহৎ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যবসা করে, কিন্তু তাদের সম্মিলিত যোগফলও সেসব দেশের জিডিপির অতিক্ষুদ্র একটা অংশ। তবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই খাতকে সেখানে একটা বৃহৎ কারখানার সুইচের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কারণ, সুইচটা খুব ক্ষুদ্র হলেও তা দিয়েই পুরো কারখানার চলা এবং তার গতি নির্ধারিত হয়। সে বিচারে বাংলাদেশের প্রকাশনা খাত যেখানে রয়েছে, তা দেশের বর্তমান পতিত দশার সঙ্গেই মানানসই। জ্ঞান, সৃজন ও মননজগতের সুইচ আর রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহ এখানে পরিপূরক সম্পর্ক দ্বারা আবদ্ধ।
বস্তুত এ দেশের প্রকাশনা খাতের যা কিছু ঐতিহ্য, তা মূলত পরাধীনতার কালের। ব্রিটিশ আমলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত কাঙাল হরিনাথের প্রেস আর প্রকাশনার মান কিংবা পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রাম বইঘরের প্রেস আর প্রকাশনার মানের সঙ্গে তুলনা করলেই এটা স্পষ্ট হয়। এর ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত মুক্তধারা এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে, বলা যায় দু-তিন দশকের মধ্যে তার যে ক্রমবিলীয়মানতা—এর মধ্যেই এ দেশের লেখক-প্রকাশক-পাঠক সম্পর্কের এমন পরিণতির কার্যকারণ অনেকখানি খুঁজে পাওয়া যাবে। সেটা ভিন্ন গবেষণার বিষয়। কিন্তু যা বলার তা হচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ নামের নবীন রাষ্ট্র তার শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতির যে রূপ নির্মাণ করেছে, তার মাধ্যমে সমাজে যত বিভাজনের বীজ বপন করেছে, আর যে বাটখারা দিয়ে সে মানের বিচার করেছে, তার মাধ্যমেই লেখক-পাঠক-প্রকাশকের জন্য প্রতিকূল আর অনাকাঙ্ক্ষিত সেই জগৎটা অনিবার্যভাবে অনেকখানি নির্মিত হয়ে গেছে।
এ দেশে প্রকাশনা মানে কী বোঝানো হয়? প্রকাশনা মানে অধিকাংশ প্রকাশক বোঝেন, লেখক সুন্দর একটা পাণ্ডুলিপি বা গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ লিখে তাঁকে দেবেন, আর তিনি সেটা ছাপিয়ে ব্যবসা করবেন—অনেকটা এ রকম। তিনি যে উদ্যোক্তা, তাঁর পণ্য যে বই এবং তাঁর কাঁচামাল পাণ্ডুলিপি যে আসে জ্ঞান ও সৃজন-মননজগতের শৃঙ্খলা থেকে, আর যে শৃঙ্খলা না থাকলে ভালো পাণ্ডুলিপিও পাওয়া যায় না—এই বোধ তাঁর সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে খুব একটা দৃশ্যমান নয়। তাঁর প্রতিটি বই যে একেকটা পৃথক পণ্য, তার যে পৃথক পৃথক স্বাদ রয়েছে এবং সে কারণেই যে প্রতিটি বইয়ের ভোক্তা বা ক্রেতাগোষ্ঠী অনেকখানি আলাদা, সেই বিবেচনা থেকে যে তাঁকে প্রয়োজন বুঝে নতুন নতুন পণ্য খুঁজতে হবে বা পরিকল্পনা করতে হবে, তা তিনি আমলে নিতেও পারেন না সেভাবে। অধিকাংশ প্রকাশক ভাবেন, তাঁর একটিই পণ্য এবং সেটি হলো বই।
এটা একটা দিক। তবে তিনি যে একেবারেই পণ্য খোঁজেন না বা পরিকল্পনা করেন না, এটা সব সময় সত্য নয়। কিন্তু সত্য হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি যেভাবে একটা পণ্য খোঁজেন বা পরিকল্পনা করেন, তা রাষ্ট্রের শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতির ক্রমপতিত বিকাশপথের সঙ্গে মিলে যায় এবং সেই ক্রমপতনের ধারাবাহিকতায় যেসব প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে আছে, তার চরিত্রের সঙ্গেও অনেকখানি সংগতিপূর্ণ হয়। অর্থাৎ তিনি চান কোন পণ্যটা বা কার কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদিত পণ্য কম আয়েশে নির্মাণ করে স্বাভাবিক বা বিকল্প পথে অধিক ব্যবসা করতে পারবেন। নিশ্চয়ই এটা টিকে থাকার সবচেয়ে সহজ উপায়! কিন্তু এভাবে কোনোরকমে টেকার উপায় খুঁজতে খুঁজতে রাষ্ট্রের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ও প্রকাশনী মানুষ বা পাঠক থেকে ক্রমে অনেকখানি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় হচ্ছে, রাষ্ট্রে মানের কদর না থাকলে মানের পেছনে একজন কেন ছুটবে বা একটা ক্রমপতিত রাষ্ট্রে তার পতিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করে পৃথকভাবে মান নির্ধারণ করা সম্ভব কি না; অথবা সম্ভব হলে কতটা সম্ভব? এটা নির্ভর করে প্রকৃতপক্ষে সমাজের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও তার নির্মিত ও পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর চরিত্রের ওপর। যে ঐতিহাসিক পথ ধরে এ দেশে মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায় গড়ে উঠছিল, তার মধ্যে এত রাজনৈতিক উত্থান-পতন ঘটেছে যে এর কোনো সুসংগঠিত সাংস্কৃতিক রূপ কখনো দাঁড়ানোরই সুযোগ পায়নি। বরং আগেই বিকশিত মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দুর সহায়ক সাংস্কৃতিক নির্মাণ সমাজে এতটাই প্রভাব বিস্তার করে থেকেছে যে সংখ্যাগরিষ্ঠরা এখানে অনেকটা সংখ্যালঘুর মনস্তত্ত্বে ভুগেছে। ‘সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু’—এই পরিভাষা বলব কি বলব না, তা ভিন্ন আলাপের বিষয়; কিন্তু সত্য হচ্ছে, কোনো দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ক্রমে ‘অপর’ করে তুলে লেখক-পাঠক-প্রকাশকের মানের জগতের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব নয়। বস্তুত কোনো উন্নয়নই সম্ভব নয়।
তৃতীয় হচ্ছে, শিক্ষা, মানে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা; এটাকে ১৯৭২ সাল থেকে উন্নয়নের নামে ধারাবাহিকভাবে সর্বনাশ করা হয়েছে। পড়লে লাভ হয়—এমন পরিস্থিতি রাষ্ট্র ও তার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বহাল থাকে বলেই প্রকাশনায় উন্নত দেশগুলোতে মানুষ পড়ে। এর বাইরের যে পাঠকশ্রেণি বা বইপ্রেমী, তার সংখ্যা সারা দুনিয়াতেই তুলনামূলকভাবে কম হয়। অর্থাৎ পাঠক বা ক্রেতার শ্রেণি বিভাগ করলে যে কয়েকটি ধারা পাওয়া যায়, তার প্রধান ধারাটা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজনে এবং সেখান থেকে বের হওয়া শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়। যদি না পড়লেও লাভ পাওয়া যেত বা পড়লে-জানলে উল্টো ঝামেলা তৈরির ঝুঁকি থাকত, তবে দুনিয়ার কোথাও এই বৃহৎ পাঠকশ্রেণিটি গড়ে উঠত না। যেহেতু বাংলাদেশ রাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে এ রকম একটি বিরূপ অবস্থানে আছে বা চক্রের মধ্যে পরিভ্রমণ করছে, তাই এ দেশে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার তথাকথিত সাফল্য পাঠক বৃদ্ধিতে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অবদানই রাখতে পারেনি।
চতুর্থ হলো, প্রকাশনা ও সম্পাদনার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং সম্পাদনার উপযোগী বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক শর্তের বিষয়টা। প্রকাশনায় উন্নত রাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এই শিক্ষার বিভাগ রয়েছে এবং তাদের দীর্ঘদিনের চর্চার ফলে এর উপযোগী সাংস্কৃতিক শর্তও সেখানে তৈরি হয়েছে। কিন্তু একটা আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ক্রমপতিত হওয়ায় সে প্রকাশনা-সম্পাদনা শিক্ষার প্রয়োজনটা বোঝেনি বা যেটুকু বুঝেছে, তা অন্য সব প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মতোই পতিত। এই পতিত দশা নিয়ে যে সাংস্কৃতিক শর্ত পূরণ করা যায় না, এটা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। তাই প্রকাশনায় উন্নত দেশে যেখানে যিনি যত বড় লেখক, তাঁর তত বড় সম্পাদকের প্রয়োজন হয়, এখানে তার উল্টা। সেখানে যে বই বেশি ব্যবসা আনতে পারে বা আনছে, তার জন্য বেশি সম্পাদনা ব্যয় ধরা হয়, এখানেও তার উল্টা। এখানে কোনো বইয়ের পাঠক কম বলে, ব্যবসা কম বলে সম্পাদনা করা হয় না; আবার যে বই চলছে বা চলবে, সেটাও সম্পাদনার কথা ভাবা হয় না। কারণ, ওটা তো এমনিতেই চলছে বা চলবে, তাহলে বাড়তি খরচ করা কেন—ভাবনাটা এ রকম।
তাহলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এমন পতিত দশার মধ্যেও, প্রকাশনা খাতের এমন চরিত্র না দাঁড়ানো অবস্থার মধ্যেও, পাঠকের এত অপ্রতুলতার পরও অনেক মানুষ প্রকাশক হতে চান কেন? অথবা প্রতিবছর বইমেলায় নতুন নতুন প্রকাশনার উদ্যোগ চোখে পড়ে কেন? কেনই–বা এত মানুষ লেখক হতে চান?
প্রকৃতপক্ষে এটাই আমাদের আশার কথা। এ এক অসাধারণ ভূখণ্ড, যার অনন্য নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষ আমরা। এখানে রাষ্ট্র যত পতিত হোক, এর প্রতিষ্ঠান যত অধঃপতিত হোক, আমাদের মানুষেরা একটা সুন্দর জ্ঞানভিত্তিক সমাজের আকাঙ্ক্ষা গভীর থেকে লালন করেন। এই গভীরতা তার ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ আধ্যাত্মিক চেতনাজাত। বস্তুত আজ দুনিয়ার যেসব দেশের মানুষকে আমরা ‘সভ্য’ বলি, তারা মূলত শাসনে সভ্য। শাসন একটুখানি শিথিল হলেই তাদের বর্বরতার নখ-দন্ত উদগ্রভাবে প্রকাশ পায়। অন্যদিকে সমাজ-রাষ্ট্রের বিপর্যয়ের নানা পর্বে এ দেশের মানুষের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায়, দীর্ঘ কুশাসনে থেকেও আমরা মানবিক বোধ থেকে তুলনামূলকভাবে বিচ্যুত হয়েছি কম। সে কারণেই জুলাই ২০২৪–এর গণ–অভ্যুত্থানের পর যেখানে রাষ্ট্র, সরকার ও তার প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বলতে গেলে এক অর্থে অকার্যকর, তখনো আমরা অন্যান্য ‘সভ্য’ দেশের মানুষের মতো বুনো-বর্বর হয়ে উঠিনি। কিছু ঘটনা ঘটলেও ব্যাপকসংখ্যক মানুষের বিবেকবোধ ও স্বতঃস্ফূর্ত তৎপরতার কাছে সেগুলো পরাজিত হয়েছে বারবার। সেই মানুষের উপযোগী রাষ্ট্র নির্মাণের পথে যদি আমরা এগোতে পারি, তবেই আমাদের প্রকাশনা এবং সৃজন-মনন ও পাঠকের জগৎ অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে।