মাসরুর আরেফিন
মাসরুর আরেফিন

ক্ষমতার সঙ্গে লেখকের সম্পর্ক সাংঘর্ষিক

কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক মাসরুর আরেফিনের বই ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে বের হচ্ছে এ মাসে। তিনি কথা বলেছেন নিজের লেখালেখি নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ

প্রশ্ন

আপনার সাহিত্যচর্চার শুরু হয়েছিল অনুবাদের মাধ্যমে। আর প্রথম বইটা ছিল কবিতার। পরে লিখেছেন উপন্যাস। অনুবাদ, কবিতা, কথাসাহিত্য—এই তিন মাধ্যমের মধ্যে আপনি কী ধরনের সংযোগ অনুভব করেন?

মাসরুর আরেফিন: এই তিনের মধ্যে সংযোগসূত্র পরিষ্কার। সেটা ভাষা। কিন্তু এই তিনের চ্যালেঞ্জগুলো যেমন আলাদা, প্রাপ্তিও আলাদা। উপন্যাসে আমি গল্প বলি পুরো একটা আলাদা ইউনিভার্স তৈরির লক্ষ্য নিয়ে। কবিতাও একই ভাষার ব্যাপার, কিন্তু ভাষা সেখানে ঘন। কবিতায় আমরা ভাষার সীমারেখা পরীক্ষা করি। আর অনুবাদ ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে সমঝোতা করার আলটিমেট জিনিস। ভাষা হচ্ছে এই তিনের মধ্যে এক কমন সুতো। উপন্যাসে আমি ডানা মেলি। কবিতায় গভীরে যাই। আর অনুবাদে সাংস্কৃতিক সীমারেখা পার হই।

প্রশ্ন

আপনার উপন্যাস নিয়ে একটা সমালোচনা আছে যে উপন্যাসের ভাষাটি ঠিক সড়গড় নয়। কী বলবেন?

মাসরুর: আমার মনে হয়, আমার উপন্যাসের ভাষাই এর প্রধান সৌন্দর্য। দীর্ঘ বাক্য। গঠনে প্রুস্তিয়ান, বুননে লরেন্সিয়ান, রঙে ও গন্ধে চেখভের গদ্যের মতো হিম ধরানো। যেন আপনি তক্ষুনি বোঝেন যে এই পৃথিবী সুন্দর, আবার এই পৃথিবী বিপদের। অর্থাৎ এ জীবন হাহাকারের। সহিংসতা কীভাবে সভ্যতাকে গড়ে ও চালায় এবং তা যেন নিয়তিনির্দিষ্ট—এই যদি হয় লেখার থিম, সেখানে অগোছালো একটা ব্যাপার থাকবেই। গোছানো পিস্তলের গোছানো বুলেট দারুণ গতি-সংহতি নিয়ে বুকে ঢুকে যাবে। কিন্তু তারপরের পড়ে যাওয়া, সিঁড়িতে পড়ে থাকা, চারদিকে নিজের সন্তানদের মারা হচ্ছে দেখা—এগুলো গোছানো হবে কী করে?

এখানে বলে রাখা ভালো যে অরুণাভ সিনহা আমার প্রথম উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। অনূদিত বইটা ১৫ অক্টোবরের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে চলে আসবে।

প্রশ্ন

আপনার কাব্যগ্রন্থ থেকে শুরু করে প্রতিটি উপন্যাসেরই মূল বিষয়বস্তু হলো ক্ষমতার সঙ্গে সমাজ ও মানুষের সম্পর্ক। এই বিষয়গুলো আপনার লেখায় বারবার আসে কেন?

মাসরুর: এটাই তো বিষয়। সবটাই রাজনৈতিক, সবটাই হারা-জেতা, দমন ও শাসনে রাখার এবং শাসিত হওয়ার কিংবা হতে চাওয়ার ব্যাপার। মোড়লের কাছে দুই পক্ষ একসঙ্গে মিলে গিয়ে বলল, আমরা মারামারি করি, আমি ওকে দেখতে পারি না, ও আমাকে দেখতে পারে না। অতএব তোমার কাছে দুজনই মাথা নোয়ালাম যে তুমি সার্বভৌম, তো তুমি আমাদের নিরাপত্তা দাও। এই তো রাষ্ট্রের পত্তন। ক্ষমতার দাঁত-নখ থেকে আসা আতঙ্ক থেকে এর সৃষ্টি। সেই রাষ্ট্রের প্রধান কাজ দুটো—নিরাপত্তা দেওয়া আর কর্মসংস্থান সৃষ্টি। তো রাষ্ট্র তখন নিজে বলল, ভালো, আমার কাছে এসেছ, নিরাপত্তা চাচ্ছ, কালকে সমতা চাইবা, পরশু ন্যায় চাইবা, অতএব এই নাও দিলাম আদালত, দিলাম পুলিশ, সংসদ আর গোয়েন্দা সংস্থা, যারা কিনা তোমার ভালোর জন্যই অন্যকে মনিটর করবে, আবার অন্যের ভালোর জন্য তোমাকে। আর এই নাও পাঠ‍্যবই, গান, কিতাব, বিয়ের দলিলের ফরম্যাট, তালাকের ফরম্যাট। নিরাপত্তা চেয়েছ না? মানে কী? তুমি রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে একখানা যৌক্তিক সম্পর্ক চেয়েছ। ভালো কথা। কিন্তু ঐতিহাসিক স্ট্রাগলগুলোর কী হবে? জনগণের ভালোর জন্য, সমষ্টির সামাজিক কল্যাণের জন্য ব্যক্তি তার মর্যাদা ও সম্মানের ওপরে আঘাত মেনে নেবে? এত বড় ত্যাগ স্বীকার ব্যক্তি করে? এটা আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন? তার মানে, স্তরে স্তরে অনন্ত লড়াই। তার মানে ক্ষমতা নিয়ে কাজ করার অর্থ হলো স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে যেমন কাজ করা, তেমন অনেক বন্দুক বনাম একজন রংপুরের আবু সাঈদকে নিয়েও কাজ করা। এখানেই আসে ক্ষমতাহীনদের ক্ষমতার প্রসঙ্গ। সম্মিলিত ক্ষমতাহীনের দল মিলে বিদ্যমান ক্ষমতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ক্ষমতাটা তাদের থেকে কেড়ে নিতে পারে। কিন্তু দেখবেন, ততক্ষণে গলির মাথায় এসে উঁকি দিচ্ছে আবার ১০-১২ জন নতুন ক্ষমতাহীন। তারা তখন ক্ষমতাবানদের বলছে—সম্রাটের ফাঁসি দিচ্ছেন দেখছি, কিন্তু ফাঁসির মঞ্চ কিন্তু ইন্ট্যাক্টই থাকছে, হা হা। এগুলো ছাড়া কী নিয়ে লেখার আছে?

মাসরুর আরেফিন
প্রশ্ন

সাম্প্রতিক ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন ঘটেছে। নিজের লেখার সঙ্গে মিলিয়ে বিষয়টি কীভাবে দেখেন?

মাসরুর: কীভাবে কী যে বলি! ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটিয়েছে ছাত্র-জনতা। গণহত্যা পর্যায়ের হত্যাযজ্ঞ হয়ে গেল আমাদের চোখের সামনে। আমরা ব্যাংকিং সেক্টরে বুঝছিলাম যে এই দিন আসছে। টিপিক্যালি এই সব গণ–আন্দোলনেরই মুখোমুখি দাঁড়ায় আমার নায়কেরা। প্রথম আলো ঈদসংখ্যায় ছাপা হওয়া আমার উপন্যাস স্কয়ার ওয়ান–এ রকম গণ–অভ্যুত্থান নিয়েই। সেখানে সারা দেশের হতদরিদ্র মানুষ ঢাকায় বিজয় সরণিতে জড়ো হয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড এক দেশ গড়ে বসে। নৈরাজ্য! এই নৈরাজ্য হাসিনার সীমাহীন লোভ, মানুষের মর্যাদাকে অবজ্ঞা করা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা আর মূলত কর্তৃত্ববাদকে চরম ভালোবাসার ফল।

টোটালিটারিয়ান সিস্টেম যারা চালায়, তাদের বাঁচার পথ নিপীড়ন করে যাওয়া আর টাকা কামানো। আর ওই একই সিস্টেমে লেখকদের বাঁচার পথ চালাকি ও নন্দনতত্ত্বের আশ্রয়।
প্রশ্ন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনি বেশ সরব ছিলেন নিজের লেখালেখি নিয়ে। এখন এই মাধ্যমে আপনার উপস্থিতি সেভাবে দেখা যায় না। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনার নীরবতার কারণ কী?

মাসরুর: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আত্মপ্রশংসার লোভের চক্করে পড়ে যাওয়ার একটা ফাঁদ। ওই ফাঁদ আর ওর আওয়াজ লেখকের মাথার ভেতরের স্থির বাগানকে অস্থির করে, তছনছ করে। লেখক চারপাশের ঝড় নিয়ে লিখবেন, কিন্তু সেটা ঝড়ের মধ্যে বসে না। তা না হলে সাবজেকটিভিটি লেখককে গ্রাস করে খাবে। সেটারই ভালো রান্নাঘর হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সেটা ভাবে-ভঙ্গিতে এনলাইটমেন্টের সহযোগী, কিন্তু কাপড় খোলা চেহারায় টোটালিটারিয়ান। তাই ওখান থেকে দূরে আছি

প্রশ্ন

এই প্রবল পুঁজিবাদী সমাজে ব্যক্তিমানুষ হিসেবে একজন লেখকের অবস্থান কোথায়?

মাসরুর: দেখেন, সমাজ নির্মাণ করে তার সত্য, সরকার বলতে থাকে তার সত্য, এই আন্দোলন যাঁরা করলেন, তাঁরা এখন বলছেন তাঁদের সত্য। এই তিন পক্ষই চায়, তোমার আচার-ব্যবহার আমার বলা সত্যের সঙ্গে অ‍্যালাইন করে করে চলো। কিন্তু এটাই আবার পুঁজিবাদী সমাজের আসল সমস্যা। কারণ, সে সমাজে টাকার কাছে মূল্যবোধের সত্য মার্জিনালাইজড। লেখক এই নোংরা সত্যের ভেতরকার অমানবিক মিথ্যাটুকু খুঁজে বেড়ান।

প্রশ্ন

সাহিত্য চিরকালই ক্ষমতা থেকে দূরে অবস্থান করে। শুধু তা-ই নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাহিত্য ক্ষমতাকে প্রশ্নই করে। একটি বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে বাস করেন আপনি। বিষয়টিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

মাসরুর: আমার সব লেখালেখির, ওই দুই অনুবাদ বাদে, একটাই থিম—ক্ষমতাকে ঝামেলায় ফেলা। মানে নাগরিক ও রাষ্ট্রের মধ্যকার চুক্তি ভায়োলেট হচ্ছে কি না, তা তুলে ধরা। আত্মার ভেতরে এই আমিটাকে নিয়ে বাইরে ব্যাংক এমডি হিসেবে ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে নাটক করে ঘুরে বেড়ানোটা আমার ভালো লাগে। তাদের সঙ্গে চালাকিভরা বন্ধুত্ব করে তাদের আমার লেখায় আমি ভালোমতো ধসিয়ে দিতে বা খুন করতে পারি। বিষয়টা আমার জন্য আশীর্বাদের।

প্রশ্ন

একসময় নিয়মিত কবিতা লিখতেন। কবিতার চেয়ে কথাসাহিত্য সামাজিকভাবে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায় বলেই কি এখন আর কবিতা লেখেন না?

মাসরুর: একদম মনের কথা বললে, কবিতা লেখা তিন ধাপে বন্ধ করেছিলাম তিন কারণে। ১৯৯০-এর দিকে এই উপলব্ধি হলো যে জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতাগুলো লিখে যাওয়ার পরে আমি আর কী লিখব? ২০১০-এর পরে একই জিনিস হলো উৎপলকুমার বসু পড়ে যে সলমাজরির কাজ অথবা হাঁস চলার পথ বা আবার পুরী সিরিজ—এই বইগুলো পড়ার পরে আর কী লেখার আছে বাংলা কবিতায়? আর গত প্রায় দুই বছর ধরে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ পড়ছি এবং আমার গা-হাত-পা হিম হয়ে আসছে। ভাবছি, আমার তো আর বাংলা কবিতা লেখার কিছু নেই। ‘আমি কেন আমার মতন?/ তেরাস্তায় আমি স্থানু, ঘোড়াটা কাহিল,/ এ-রাস্তায় থামার মতন কিছু কই? খামার-মতন কিছু কই?’—এই হলো সুব্রত। সেরেব্রাল, ক্রিটিক্যাল, আর প্রকরণে আমাদের সেরা। আমি যদি দুটো বছর ধরে শুধু সুব্রতর কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে বইগুলো বাইরে বের করতে পারতাম, তাহলে বাংলা কবিতায় আবার নোবেল পুরস্কার আসত।

প্রশ্ন

সমালোচকেরা বলেন, সামাজিক ক্ষমতা আপনার সাহিত্যিকজীবনকে অপেক্ষাকৃত সহজ করে তুলেছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?

মাসরুর: কথা তো সত্য। সামাজিক ক্ষমতা আমাকে দিয়েছে সব দরজা আমার সামনে বেশি বেশি খুলে যাওয়ার সুযোগ। এটা এড়াবেন কী করে? পৃথিবীর ফরম্যাটটাই তো এই। কিন্তু সাহিত্যিক হিসেবে আমি সেটা থেকে সুবিধা নেব কি না, তা তো একটা নৈতিক প্রশ্ন। আমার সেটা নেওয়ার দরকার পড়ে না। কারণ, আমি জাত লেখক। আবার ক্ষমতার সঙ্গে লেখকের সম্পর্ক সাংঘর্ষিক হতেই হবে। আসলে একটা ব্যাপারে ফুকোই সত্য। ওই যে ফুকো বলেছিলেন—পৃথিবী খারাপ না, পৃথিবী স্রেফ বিপজ্জনক। পৃথিবী বিপজ্জনক বলেই লেখক যদি ক্ষমতার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যান, তাহলে সেই বিপদটা কী, তা তিনি আর কোনো দিন জানতেই পারবেন না, সিস্টেম কারা চালায় এবং কীভাবে চালায়, তা ধরতে পারবেন না।  টোটালিটারিয়ান সিস্টেম যারা চালায়, তাদের বাঁচার পথ নিপীড়ন করে যাওয়া আর টাকা কামানো। আর ওই একই সিস্টেমে লেখকদের বাঁচার পথ চালাকি ও নন্দনতত্ত্বের আশ্রয়। আমার সামাজিক ক্ষমতার কৌশলী ব্যবহারের মাধ্যমে আমি সিটি ব্যাংকের অনেক কাজে এসেছি। কিন্তু সাহিত্যের জায়গায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার ইত্যাদি পেতে সেটাকে কোনো কাজে লাগাইনি। আর ওই পুরস্কার আমি কোনো দিন পাবও না। কারণ, উসকানি ও নাশকতামূলক সাহিত্যের সঙ্গে কোনোকালে কোনো সরকারের বন্ধুত্ব হওয়া অসম্ভব।

প্রশ্ন

এখন কী লিখছেন? লেখালেখি নিয়ে সামনের দিনগুলোতে আপনার পরিকল্পনা কী?

মাসরুর:পন্যাস লিখছি। প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরোচ্ছে আগামী বইমেলায়। নাম দূর বৃত্ত। এটি আগে প্রথম আলো ঈদসংখ্যায় বেরিয়েছিল। তবে ঈদসংখ্যায় ছাপা হওয়া আগের দূর বৃত্ত-এর সঙ্গে এটার কোনো মিল নেই। এটার বিষয় অনেক কিছু। এমনকি মতাদর্শিক যে লড়াই শুরু হয়ে গেছে দেশ নিয়ে, এর সংস্কৃতি, এর সেক্যুলার বনাম ধর্মীয় পরিচয়ের লুডু খেলা নিয়ে—এসব এই উপন্যাসের পার্শ্ববিষয়। কিন্তু কোনোভাবেই কোনো নির্দিষ্ট স্বৈরাচার আমার লেখার বিষয় হতে পারে না। নির্দিষ্ট স্বৈরাচার দৈনন্দিন রাজনীতির অংশ। সে প্রতিদিন দেশের সবকিছু খেয়ে বেড়ায়—ব্যাংক, আদালত, পুলিশ, সাংবাদিকতা, দরিদ্র মানুষ, ভাষাহীন মানুষ, কী না? সেই স্বৈরাচারকে আমি আমার কথাসাহিত্যও খেয়ে ফেলতে দেব না।