উপন্যাস আর নৃকুলবিদ্যার বাহাস

উপন্যাস আর নৃকুলবিদ্যার মধ্যে ফারাক আছে। উপন্যাস বাস্তব আর কল্পনার সংমিশ্রণে তৈরি। অন্যদিকে নৃকুলবিদ্যা নৃকুলের বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত বয়ানের বিজ্ঞান। তানজিনা হোসেনের যদি পাখা পাই পাখি হয়ে যাই উপন্যাসের আলোচনা কেবল উপন্যাসের আলোচনার ভেতরে আবদ্ধ রাখা হলে তাকে বরং সীমিত করে ফেলা হবে। এটি বহুলাংশে উপন্যাস আর নৃকুলবিদ্যার এক দারুণ সমন্বয়।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের যে সামাজিক বিবর্তন ঘটছে, সেই বিবর্তনের মধ্যে জনগণ ও জনজীবনের যে বাস্তব পরিস্থিতি, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা এ উপন্যাসে বর্তমান।

 যদি পাখা পাই পাখি হয়ে যাই

তানজিনা হোসেন

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪; প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য;  ১২৮ পৃষ্ঠা; দাম:৩৪০ টাকা।

কাহিনি এগিয়েছে প্রধানত ঢাকায় বসবাসরত শিকড়বিচ্ছিন্ন কর্মজীবী নারীদের নিয়ে। তাদের পক্ষের আর বিপক্ষের আরও কিছু চরিত্র নিয়ে। তার মধ্যে প্রধান চরিত্র হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছে অনিমা সিংহের। নারী চরিত্র এ উপন্যাসের প্রধান নিয়ামক শক্তি। সামাজিক পরিবর্তনে জনসমাজের বড় অংশই পরিবর্তিত হতে বাধ্য সমাজে সৃষ্ট বিপুল অভিঘাতের কারণে, এমনকি তাদের কারও কারও অস্তিত্ব হুমকিরও সম্মুখীন হয়। সূচনা হয় যাযাবর জীবনের। ব্যক্তি ও সমাজের সবকিছুই এই উপন্যাসের ভেতরে আছে, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিজাত হয়ে। কেউ কেউ এই পরিস্থিতিকে আধুনিকতা হিসেবে বিবেচনা করেন। কেউবা বিষয়টিকে আধুনিক মানুষের নিয়তি হিসেবে মেনে নেওয়ার প্রকল্প সাজান। ব্যাপারটি এমন, যেন বৃহৎ বয়ানের কাছে হারতে হবে ক্ষুদ্র বয়ানের। কিন্তু এর বিপরীতে নৃবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে একটি পাল্টা বয়ান দাঁড় করেছেন ঔপন্যাসিক, যার মাধ্যমে একটি মানবিক রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষাও শেষমেশ উপন্যাসটিতে স্পষ্ট।

আধুনিক জীবনের একটি দীর্ঘ টানাপোড়েন রয়েছে। সেই টানাপোড়েন কেন্দ্র-প্রান্তের যৌথতায় নির্মিত। ফলে ঔপন্যাসিককে বারবার কেন্দ্র-প্রান্তের দ্বৈততা-বণ্টন সামলাতে হয়। তিনি তা সামলে ঢাকা আর মণিপুরি জনগোষ্ঠীর জীবনের বর্ণনা তৈরি করেন। দেখান নস্টালজিয়ার সমন্বয়ে। নস্টালজিয়া উপন্যাসটির বর্তমানময়তা আর অতীতমুখীনতার ভেতর দিয়ে ইতিহাসের বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে।

উপন্যাসে ঢাকায় জনগণের যাপিত জীবনের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত কদাকার, বীভৎস; বৃহৎ অর্থে ঢাকায় বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষের দুঃসহ পরিস্থিতির বর্ণনাই দেওয়া হয়েছে। অনিমা নারী হিসেবে ঢাকাতেই বসবাস করে। এ ক্ষেত্রে নারী হিসেবে তাদের সংগ্রামের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। পদে পদে নানা জায়গায় ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে এগোতে হয় সামনে। কিন্তু এ কাহিনিতে ‘মোহিনী চৌধুরীর’ মতো লোকজনও যে রাষ্ট্রের সিস্টেমের কাছে বেশ অসহায়, সে কথাও আছে।

কেবল এই নগরীয় বর্ণনার ভেতরে আলাপ থেমে থাকেনি। এর বাইরে মণিপুরি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের বয়ানও উপস্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আদিবাসীদের দুচোখা মনোভঙ্গিতে দেখার এবং সেভাবে আচরণ করার একটি রেওয়াজ আছে। মানে দেশের ভেতরেই ‘পরদেশি’ হিসেবে তাদের ভাবতে যেন রাষ্ট্রীয় উপাদানগুলো সব সময় কার্যকর থাকে। লেখক এই বয়ানকেও ভাঙার চেষ্টা করেছেন। কেন্দ্র-প্রান্তের সীমানা ভাঙতে চেয়েছেন।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে একটি উৎকৃষ্ট উপন্যাস। সব ঠিক থাকলেও এ উপন্যাসের একটি বড় সমস্যা হলো, এখানে নগর থেকে গ্রামের বর্ণনা দিতে ইলিয়াস যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বয়ান চালান করেন, তা অনেক ক্ষেত্রেই খাপছাড়া লাগে। ঢাকা অংশ আর মণিপুরি জনগোষ্ঠীর বর্ণনা দিতে গিয়ে তানজিনা হোসেনও একই কাজ করেছেন। তাই একটি অংশ আরেকটি অংশের মধ্যে সম্পর্ক যেন অনেকাংশেই শৃঙ্খলিত হতে পারেনি। এই হতে না পারা, খাপছাড়া বিবরণ-বর্ণনা উপন্যাসটির একটি বড় খামতি। তবে উপন্যাস আর নৃকুলবিদ্যার সমন্বয়ের প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে।

 সোহানুজ্জামান