লেখক কি আত্মজীবনী বা আত্মস্মৃতিতে নিজের সবকিছু লিখতে পারেন, নাকি তিনি সেটুকুই লেখেন, জীবনের যেটুকু অংশ তিনি বলতে চান? ভাষাসংগ্রামী ও সাহিত্যিক হালিমা খাতুনের আত্মস্মৃতি মেঘের ওপারে আকাশ পড়ার পর প্রশ্নটি যে মনে উঁকি দিল, তার যথাযথ কারণ আছে।
‘সেকাল’–এর মানুষ হালিমা খাতুনের এই আত্মস্মৃতিতে ‘সোনালি অতীত’ যেমন থরেবিথরে ছবি হয়ে ওঠে, তেমনি বইটিতে পাওয়া যাবে গত শতকের ত্রিশ থেকে আশি–নব্বই দশক অবধি গ্রামীণ প্রতিবেশ, মানুষজন এবং মফস্সল ও নগরের রোদ–বৃষ্টি; সব মিলিয়ে ‘অ্যানালগ’ আলো–হাওয়া। আর এর মধ্য দিয়ে আজকের ‘ডিজিটাল’ পাঠকের কাছে কেবল আমাদের সামাজিক ইতিহাস নয়, ধরা দেয় পরিবর্তনের ইতিবৃত্তও।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম যে চার মেয়ের দল ১৪৪ ধারা ভেঙেছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন হালিমা খাতুন।
আজকের বাংলাদেশেও নারীর পথচলা মসৃণ নয়, তাহলে ত্রিশ–চল্লিশ–পঞ্চাশ–ষাট দশকে কেমন ছিল চিত্রটি?
১৯৩৩ সালে বাগেরহাট থেকে দুই মাইল দূরের গ্রামে জন্ম নেওয়া হালিমা খাতুন লিখছেন, ‘…সেকালে কলেজ তো দূরের কথা, স্কুলেই খুব কম মেয়েরা লেখাপড়া করত। মুসলমান মেয়েদের দোজখে যাবার ভয়ে স্কুলে পাঠানো হতো না।’ এ–ই যখন বাস্তবতা, তার মধ্যেই লেখক নির্বিঘ্নে বিদ্যাশিক্ষা করছেন তাঁর বাবার সমর্থন ও সহযোগিতায়। কিন্তু মুসলমান ঘরের এই মেয়ে স্কুল–কলেজে পড়ার সময় এসরাজ শিখলেও ‘সমাজ’–এর ভয়ে সংগীতযন্ত্রটি নিজের বাড়িতে রাখতে পারেননি, এ–ও তো বাস্তবতাই ছিল।
এসব বাস্তবতা পেরিয়ে হালিমা খাতুন আজীবন সাম্যবাদী তথা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে বামপন্থী মতাদর্শ ধারণ করেছেন। মার্কিন মুলুকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনা করেছেন এবং ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে অবসর নিয়েছেন। শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম যে চার মেয়ের দল ১৪৪ ধারা ভেঙেছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন হালিমা খাতুন। মেঘের ওপারে আকাশ–এর বারো অধ্যায়ে আছে ভাষা আন্দোলনের সেই দিনের সচিত্র মর্মস্পর্শী বর্ণনা, ‘…গুলি থামলে মেডিকেল কলেজে ছাত্রদের ব্যারাকে গেলাম। …গিয়ে দেখি রক্ত আর রক্ত। রক্তের মহাসাগর। …একপাশে একটা বাঁশের খুঁটিতে বোধ হয়, কিংবা গাছের ডালে ঝোলানো রক্তে ভেজা পাজামা ও শার্ট। আর একটু দূরে দেখি, একজনের মাথার মগজ ছড়িয়ে রয়েছে অনেকখানি জায়গাজুড়ে। ফুলের মতন সেই মগজ। এমন বকুলফুল, একসাথে আর কখনো দেখিনি।’ এসব বিবরণ শেষে লেখক যখন মন্তব্য করেন, ‘আমাদের ইতিহাসবিদেরা মেয়েদের ভূমিকার কথা উল্লেখ না করতে চাইলেও পারবে না, কারণ ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে মেয়েদের ভূমিকা অনস্বীকার্য’, তখন মনে হয়, ভাষাসংগ্রামে নারীর বীরত্বের ইতিহাস আমরা কি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরতে পেরেছি?
২০১৮ সালে প্রয়াত হন হালিমা খাতুন। এই বইয়ে তাঁর মেয়ে আবৃত্তিশিল্পী প্রজ্ঞা লাবণীর একটি ভূমিকা আছে। সেখান থেকে জানা যায়, লেখক এই আত্মস্মৃতি লিখতে শুরু করেছিলেন ২০১৬ সালে, তাঁর বয়স তখন আশির ওপর। এ বয়সে লিখতে বসেও নিজের শৈশব–কৈশোর–তারুণ্যের এত অপূর্ব বর্ণনা তিনি দিয়েছেন! জীবনস্মৃতি বলতে বলতে সেখানে স্থান করে নিয়েছে তৎকালীন সমাজজীবন। আর বর্ণনাগুলো এত কাব্যগন্ধী যে উদহারণ দেওয়ার লোভ সামলানো কঠিন, ‘খুব ছোট্টবেলায় আমার অদ্ভুত রকমের কিছু ধারণা ছিল। গঙ্গা, যমুনা, মধুমতী, কপোতাক্ষ ইত্যাদি নদীর নাম আমাকে মুগ্ধ করত। কস্তুরীমৃগের মতো আমি শব্দগুলো খুঁজে বেড়াতাম। তখন ভাবতাম, এই নামগুলো বুঝি আকাশে মেঘের ওপরে থাকে।’ পড়তে পড়তে মনে হয় যেন রূপকথার জগতে চলে যাচ্ছি!
মেঘের ওপারে আকাশ
হালিমা খাতুন
প্রকাশক: বাংলা একাডেমি, ঢাকা; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪; প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা; ২৩২ পৃষ্ঠা; দাম: ৩৬০ টাকা।
তবে জীবন তো রূপকথা নয়, হালিমা খাতুনের জীবনও তা ছিল না। বইয়ের শেষ দিকে লেখক জানান, ১৯৫৫ সালে তাঁর বিয়ে হয়। এর কিছু কালের মাথায় পরস্পরের জীবন–দর্শনে অমিল ধরা পড়ে। সেই সঙ্গে প্রাক্তন প্রেমিকাকে ভুলতে না পারায় স্বামী তাঁকে ছেড়ে যান। এর মধ্যেই তাঁর মেয়ের জন্ম হয়। তিনি আর বিয়ে করেননি। ভাবা যায়, সেই ষাট দশক থেকে তিনি ‘সিঙ্গেল মাদার’! এভাবে একাকী মা হিসেবে মেয়েকে বড় করেছেন, দক্ষিণ বাংলার এক মফস্সল থেকে এসে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন ঢাকা নগরের পোক্ত পাটাতনের ওপর। শুধু তা–ই নয়, একজীবনে সমাজ–সংসার, হিল্লি–দিল্লিও কম করেননি। জীবনের সেসব টুকরো স্মৃতি লেখা আছে এ বইয়ে। কিন্তু যা লেখা নেই তা হলো, সেকালের একজন একাকী মায়ের লড়াইয়ের সবিস্তার গল্প। তেইশটি অধ্যায়ে বিভক্ত বইটির সর্বত্রই মারাত্মক পরিমিতির ছোঁয়া। তাতে সমাজ আর লেখকের কর্মজীবনের কথাই বেশি। তবে তাঁর ব্যক্তিজীবনের লড়াইয়ের গল্পটি আরও খানিকটা বিস্তৃত হলে আরেকটু পরিতৃপ্তি জাগত মনে হয়।