দীর্ঘ দুরূহ পথ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে উইলিয়াম রাদিচের পাঁচটি বক্তৃতা। বক্তৃতাগুলো তিনি দিয়েছিলেন বাংলাদেশে, বাংলা ভাষায়। প্রথমা প্রকাশন থেকে বইটি বের হয়েছে ২০১৬ সালে
উইলিয়াম রাদিচে বাংলা শিখেছেন, বাংলা সাহিত্যকর্ম ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। ৪০ বছর থেকেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণায়, অনুবাদে। কিন্তু অনুবাদের পথটি কেমন ছিল তাঁর কাছে? ১৯৮৭ সালে দেওয়া এক বক্তৃতায় রাদিচে বলেন, অনুবাদের পথ দীর্ঘ ও দুরূহ। কিন্তু একই সঙ্গে এ পথে তৃপ্তি ও আনন্দ মেলে। এই তৃপ্তি অনুবাদের বই বের করার, পাঠক-সমালোচকদের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়ার।
তবে গভীর ও নিঃস্বার্থ এক তৃপ্তির কথাও বলেছেন রাদিচে। তাঁর মতে, কবিতার অনুবাদে একই সঙ্গে অনুবাদকের কবিস্বভাবের দরকার হয়। নইলে ভালো অনুবাদ হয় না। রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনুবাদের সময় রাদিচে নিজের কবিস্বভাবও মিলিয়ে দিয়েছেন। মিলিয়ে দেওয়ার আনন্দ পেয়েছেন। আর গদ্যের অনুবাদ প্রসঙ্গে বলেছেন, সেখানে মূল লেখক উপস্থিত থাকেন, অনুবাদক থাকেন না। অনুবাদকের কাজের মধ্য দিয়ে লেখক থাকেন, তবে অন্য ভাষায়। অনুবাদকের কাছে সেটা একটা অসাধারণ, রহস্যময়, বিস্ময়কর আনন্দ।
অনুবাদের কাজে তৃপ্তি-আনন্দ থাকতে পারে। তবে এর মধ্যে সংকটও আছে। রাদিচে বলেন, কবিতার অনুবাদের সময়ে দুটি দিকে খেয়াল রাখতে হয়। এক. কবিতার গঠন বা রচনারীতি, দুই. কবিতার বিষয়বস্তু। এ দুটি ব্যাপারকে পরস্পর থেকে আলাদা করা যায় না। তাই প্রশ্ন তুলেছেন, অন্য ভাষায় কবিতার অনুবাদ আদৌ সম্ভব কি না। এরপর তাঁর নিজের করা তিন ধরনের তিনটি কবিতার অনুবাদ উপস্থাপন করেছেন। পাশাপাশি মূল কবিতাও রেখেছেন। দেখিয়েছেন, কীভাবে সেই দুরূহ পথ তিনি পাড়ি দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের ‘বৃক্ষবন্দনা’ কবিতার উদাহরণ টেনে রাদিচে বলেন, এটি পড়ে পুরোপুরি বোঝা যায় না। তবু কবিতাটি মুগ্ধ করে। এর ছন্দ ও ধ্বনি কানে লেগে থাকে। রাদিচে বলেন, এই কবিতায় বৃক্ষের কথা আছে। সেটি পৃথিবীর ‘আদিপ্রাণ’, যার সৃষ্টি আদিকালে। বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ কবিতায় প্রাচীন সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করেছেন। পুরাণেরও উল্লেখ আছে। তবে, এসব পুরাণ কোনো বৃহত্তর ঐতিহ্য থেকে আসেনি। এসেছে রবীন্দ্রনাথের কাব্যকল্পনা থেকে।
অনুবাদ করার সময় রাদিচে মূল কবিতার ওজন ধরে রাখতে চেয়েছেন। তাই সংস্কৃত শব্দের জায়গায় ব্যবহার করেছেন লাতিন শব্দ। রবীন্দ্রনাথের গম্ভীর অক্ষরবৃত্ত ছন্দের পরিবর্তে নতুন ধরনের ইংরেজি লাইন তৈরি করেছেন। অনুবাদক দাবি করেছেন, অনেকের মনে হতে পারে তাঁর অনুবাদটি একেবারে নতুন কবিতায় রূপ নিয়েছে। তবে তাঁর মতে, মূল কবিতা ও অনুবাদের মধ্যে সব সময় গভীর সাদৃশ্য রয়ে যায়। আর প্রতিটি কবিতার একটি স্বরূপ থাকে, যা কোনো বিশেষ ভাষা বা বাচনভঙ্গির ওপর নির্ভর করে না।
রাদিচে কবি ছিলেন। তাই তাঁর অনুবাদে কবিতার মৃত্যু ঘটেনি। তিনি অনুবাদের আগে মূল কবিতার বিষয় ও রচনারীতি খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতেন। মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য অনুবাদের সময় মূল রচনার রীতি ও ছন্দকে অবিকৃত রাখার চেষ্টা করেছেন। এই কাব্যের মধ্যে তিনি দেখেছেন অসাধারণ প্রবহমানতা। এই প্রবহমানতা কাব্যের শেষ পঙ্ক্তি পর্যন্ত অক্ষুণ্ন রয়েছে। রাদিচে কাব্যের মূল রূপ অবিকৃত রাখার জন্য এর গঠন ও ছন্দ নিয়ে ভেবেছেন। মূলে একেকটি বাক্যে তিনটি বা ছয়টি যতি আছে। রাদিচে ইংরেজি লাইনেও তিনটি করে যতি রেখেছেন।
রাদিচে ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন যে রচনার প্রতিরূপ ধরতে না পারলে শুধু বিষয়বস্তুর অনুবাদ দিয়ে সাহিত্যের প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয় না। অনুবাদের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশের সমাজ আর মানুষকেও চিনেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘পুত্রযজ্ঞ’ গল্পের অনুবাদের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী এলিজাবেথ আমার সবচেয়ে ভালো ও কঠোর সমালোচক। তিনি বলেছিলেন, গল্পটির শেষে বিনোদা তার স্বামীকে চেনেনি কেন?’
রাদিচে নিজেও প্রথমে এর কারণ বোঝেননি। না বুঝে এলিজাবেথকে বলেছিলেন, হয়তো বিনোদা এত ক্ষুধার্ত ও অবসন্ন ছিল যে ওর স্বামীকে চেনার ক্ষমতা ছিল না। তা ছাড়া বিনোদা অনেক দিন ওর স্বামীকে দেখেনি, বৈদ্যনাথের অবস্থা খুবই বদলে গেছে ইত্যাদি। তবে পরে বুঝেছে, বৈদ্যনাথ তার স্ত্রী বিনোদাকে ‘কলঙ্কিনী’ বলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এত বড় অপমানের পর বাঙালি স্ত্রী কীভাবে স্বামীকে স্বীকার করতে পারে?
উইলিয়াম রাদিচের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে নিবিড়ভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন। তাঁর দেওয়া পাঁচটি বক্তৃতার সংকলন দীর্ঘ দুরূহ পথ। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে তিনি দিয়েছিলেন চারটি বক্তৃতা। পঞ্চম বক্তৃতাটি দেন ২০১২ সালে। এগুলো সংকলিত হয়ে প্রথমা থেকে বের হয় ২০১৬ সালে।
বাংলা সাহিত্যকে অনুবাদের মাধ্যমে পশ্চিমে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি রাদিচে করে গেছেন নিরলসভাবে। এ কাজে তাঁর যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, এর সারৎসার দীর্ঘ দুরূহ পথ। যাঁরা সাহিত্য-অনুবাদের কাজ করেন বা করতে চান, তাঁদের জন্য রাদিচের দীর্ঘ দুরূহ পথ অবশ্যপাঠ্য। তিনি কবি ও অনুবাদকের দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেছেন, অনুবাদের পথটি কেন দুরূহ। একই সঙ্গে দেখিয়েছেন, কীভাবে একে অতিক্রম করে ভালো অনুবাদ করা যায়।
তারিক মনজুর
দীর্ঘ দুরূহ পথ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পাঁচটি বক্তৃতা
উইলিয়াম রাদিচে
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৬; প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল; ৮৮ পৃষ্ঠা;
দাম: ১৮০ টাকা।