‘হিম বাতাসের জীবন’ বই নিয়ে আলোচনা করার আগে বইয়ের ফ্ল্যাপে থাকা লেখকের কথাগুলো পড়ে নেওয়া যেতে পারে—
‘বুকের উপর থেকে পাথর সরাতে সরাতে কখন চারপাশে তৈরি হয়েছে অনির্বচনীয় পাহাড় তা ঠিক টের পাইনি। এই মানবহীন পাহাড়ে ঠিক কতকাল ধরে সায়ংসন্ধ্যা স্থায়ী হয়ে আছে, কে জানে! এই অন্ধকারে তাকালে মনে হয় আকাশ ডুবে গেছে সূর্যে আর চারিদিকে যে ঘোলা ঘোলা বিভ্রম তা ভরা থাকে দুঃখী মেঘের অশ্রুতে। তবু আমি সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাই কিংবা এমনও হতে পারে আমি অভিনয় করি দেখার। সেই কবে চোখের মধ্যে একটা নক্ষত্র এসে হারিয়ে ফেলেছে পালাবার পথ, সেও নিভু নিভু জ্বলে আর আমি পৃথিবী থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একটি প্রদীপ হাতে নিয়ে বসে থাকি আলো আবিস্কারের অপেক্ষায়। যে আলো আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে “হিম বাতাসের জীবন”-এর কাছে।’
শুরুতেই যেকারও মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বইয়ের উৎসর্গপত্রই যথেষ্ট।
‘সেই শিশুর জুতো জোড়াকে, যা তার পায়ের স্পর্শ না পেয়ে পড়ে আছে বিক্রির অপেক্ষায়’ হেমিংওয়ে লিখেছেন বলে প্রচারিত সেই বিখ্যাত ‘For sell, baby shoes, never worn’ থেকে অনুপ্রাণিত উৎসর্গপত্রই মূলত আমাকে আগ্রহী করেছে বইটার প্রতি। ‘হিম বাতাসের জীবন’ নাহিদ ধ্রুবের প্রকাশিত তৃতীয় গ্রন্থ। ৭৮ পৃষ্ঠার বইয়ে গড়ে ৩-৪ পৃষ্ঠায় গল্পের সংখ্যা বিশ।
প্রতিটি গল্পে প্রতীক, উপমা, রূপক প্রভৃতির আলংকারিক প্রয়োগ-নৈপুণ্যে চোখে পড়ার মতো। গল্পের নিজস্ব শরীর এবং আত্মার নির্মাণে এ ধরনের ‘চিত্ররূপময়’ বর্ণনা সত্যি মনোমুগ্ধকর। মনে হয়, গল্পকার হাতে নিয়েছেন তুলি, গুনগুন করছেন অদ্ভুত সুর, লিখছেন ছন্দে ছন্দে কবিতার শব্দ আর শেষমেশ হয়ে উঠছে এই তিনের বুননে সুন্দর একটা গল্প। গল্পের ক্যানভাসে যেন রঙের ছড়াছড়ি।
কাব্যগ্রন্থের মতো গল্পগ্রন্থও টানা পড়ে যাওয়ার ঝামেলা পোহাতে হয় না। গল্প মিশে থাকতে পারে আকাশে, জলে। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে কিংবা রাত্রিবেলা ঘুমাতে যাওয়ার কালে ‘হিম বাতাসের জীবন’ হয়ে উঠতে পারে আপনার নিজস্ব সম্পত্তির মতো। ‘কাকের মতো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া রাত’ গল্পের শাওন হয়তো আপনি কিংবা আমিই। ‘সংসার’ গল্পে বৃদ্ধা দাদির মৃত্যু এবং তার আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে সঙ্গে বাবা-চাচাদের অর্থ-সম্পত্তি নিয়ে টানাহেঁচড়ার আলোকে আমাদের কুৎসিত রূপ দেখা যায়। ‘যে পাড় ভেঙে দেয় নদী’ গল্পটি আমাদের সমাজজীবনের সেই ভয়াবহ অন্ধকার দিকে বর্ণনা করে, যেখানে অর্থ-সম্পদের মোহ আমাদের ওয়াকিবহাল করে রাখে সব মানবিক গুণ থেকে, কীভাবে নিজের স্বার্থ আর লোভের সমুদ্রে আমরা হাবুডুবু খেয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, তার গল্প বলে যায়। ‘মা কখনও মিথ্যে বলেন না’ গল্পে সুনিপুণভাবে গল্পকার মানুষের অনুপস্থিত কীভাবে খুন করে জড়বস্তুর বাড়িকেও তার জানান দিয়েছেন। ‘অ্যা ড্রিম উইদইন অ্যা ড্রিম’ গল্পটা আপনাকে যেকোনো সুরিয়ালাস্টিক সিনেমার স্বাদ দিতে পারে। ‘কয়েকটি খন্ডচিত্র’ আমাদের নগরজীবনের ভয়াবহ ব্যস্ত স্বভাব আর ‘থোড়াই কেয়ার করি অন্যের জন্য’ চরিত্রের শতভাগ প্রকাশ ঘটিয়েছে। হামিমের সঙ্গে মৃত নক্ষত্রের কী সম্পর্ক? জানতে হলে পড়তে হবে ‘মৃত নক্ষত্রের সুখ’।
সমাজ এবং ব্যক্তিজীবনে আমাদের সীমাবদ্ধতা, যন্ত্রণা, বিষণ্নতা এবং সম্ভাবনা এসবকে নানান দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পগুলোয় আবিষ্কার করতে পারবেন। সজীব এবং সুন্দর এই দুটো শব্দের মিশ্রণে গল্পগুলো বেড়ে উঠেছে। কথার সত্যতা বইয়েই পাবেন। প্রতিটি গল্পই মুক্তগদ্য এবং ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য নিয়ে এক উভচর অবস্থানের সৃষ্টি করেছে। কাফকার ধেয়ান কিংবা বোর্হেসের ছোটগল্পের কথা কখনো মনে পড়বে কিংবা মনে পড়বে ও হেনরি/মোপাসার কথা, না গল্পের ধরনের জন্য না, সিনট্যাক্সের জন্যও না, বরং গোছালো বর্ণনা, সময়োপযোগী আলাপ, লেখকের নিজস্ব শিল্পকৌশলের সমন্বয়ের কারণে। অস্ট্রেলিয়ার ঔপন্যাসিক ডেভিড ম্যালুফ একবার বলেছিলেন, লিখতে হয় নৈঃশব্দ্যের গল্প এবং নীরব গল্প। শব্দই জানে কেমন করে সে নৈঃশব্দ্য পায়। ‘হিম বাতাসের জীবন’ সেই নৈঃশব্দ্যের গল্প। বইয়ের গল্পগুলোর আরেকটা অসাধারণ ব্যাপার হলো জায়গার নির্দিষ্ট বর্ণনা নেই। কিন্তু সেই জায়গাগুলো জীবন্ত। মনে হবে আপনি সেই গল্পের অংশ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রতিটি জায়গায়। যার কোনো ধ্বংস নেই। গল্পগুলো খুব স্বচ্ছ নয়। পাঠক হিসেবে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য তারা মরিয়া হয়ে ওঠে না। কিন্তু তবুও গল্পগুলোর সঙ্গে আপনি জড়িয়ে যাবেন। লুকিয়ে থাকার স্বচ্ছতাও চোখে পড়বে। হইয়াও হইল না শেষের অতৃপ্তিতে যে তৃপ্তিদায়ক হাসি, সেটা এই বই আনতে পারে আপনার মুখে। আরেকটা বড় ব্যাপার অর্থের বিস্তৃতি, গল্পগুলো পড়ে আমার যা মনে হয়েছে, তা কিন্তু আপনার মনে না হতেই পারে। আপনি পারেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো অর্থ দাঁড় করাতে। গল্পের মূল অর্থকে এভাবে পাঠকের হাতে ছেড়ে দেওয়ার যে সাহস লেখক দেখিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। বইয়ের ব্যাক কভারে তিনজন কথাসাহিত্যিক, একজন ঔপন্যাসিক, কবি ও গল্পকারের প্রশংসামূলক প্রতিক্রিয়া আমার কথাগুলোকেই সমর্থন করবে।
বইয়ের মন্দ লাগার একমাত্র দিক হলো ‘বোধগম্যতা’। একজন সাধারণ পাঠকের পক্ষে এই ধরনের অতি রূপকতা কিংবা গল্পের মূল বক্তব্য গোপন রাখার প্রবণতা পছন্দসই হবে না। মুক্তগদ্য বা এ ধরনের গল্প বলার ধরনের সঙ্গে যাদের পরিচয় নেই, তাদের কাছে গল্পের কথন খুবই অগোছালো এবং গল্পের ভাব অপ্রকাশিত লাগতে পারে। আমি নিজেও কয়েক জায়গায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম।
নাহিদ ধ্রুব সেই শান্ত লেখক, যার শব্দ এবং চিন্তার গভীরতার সামনে এসে বসলে মনে হবে গাছঘেরা শান্ত পুকুরের ধারে এসে বসলাম। যাই হোক, দিন শেষে ‘হিম বাতাসের জীবন’ আপনার কল্পনাশক্তিতে ব্যাপক ঝড় নিয়ে আসার ক্ষমতা রাখে।
হিম বাতাসের জীবন
নাহিদ ধ্রুব
প্রচ্ছদ: সিপাহী রেজা
প্রকাশক: চন্দ্রবিন্দু
মূল্য: ১৮০ টাকা