কাজী নজরুল ইসলাম নিজে বলেছেন, ‘সাহিত্যে আমি কী দিয়েছি জানি না, তবে সংগীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি।’ তার মানে তিনি তাঁর সংগীত সাধনা নিয়ে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ছিলেন এবং সংগীতের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখতেন।
বিশের দশকের সূচনায় কুমিল্লায় অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করে দেশাত্মবোধক ও জাগরণী গান রচনার সূত্রপাত করেন নজরুল। বিশ শতকের বিশের দশকের প্রথমার্ধে তিনি যে গানগুলো রচনা করেছিলেন, তা ছিল একদিকে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশবাদবিরোধী আর একদিকে শ্রেণিসচেতন সংগ্রামী গান। ধূমকেতু পত্রিকার সঙ্গে যখন যুক্ত ছিলেন তিনি, তখন রচনা করেন ব্রিটিশবিরোধী গান; যখন লাঙল পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন, তখন বাংলা ভাষায় প্রথম শ্রেণিসচেতন গান রচনা করেন তিনি। আর গণবাণী পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি রচনা করেন আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী সংগীত।
এসব থেকে প্রতীয়মান হয়, নজরুল ইসলামের সৃষ্টিশীল জীবন সাহিত্য ও সংগীত দুই ধারায় প্রবাহিত হলেও সংগীত সৃষ্টি ও এর সঙ্গে তাঁর নিবিড়তা তাঁকে সংগীতের অনন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। কবির সৃষ্টিশীলতার এই গুরুত্বপূর্ণ পর্ব নিয়ে গবেষক, শিল্পী ও প্রশিক্ষক শাহীনূর রেজা রচনা করেছেন নজরুলের সংগীত জীবন বইটি।
গ্রন্থের সূচির দিকে তাকালেই বোঝা যায় লেখক কতখানি সময়, শ্রম ও নিবিষ্ট মন দিয়ে কাজটি সম্পন্ন করেছেন। নজরুলের সংগীত ও জীবনের সামগ্রিক মূল্যায়ন দূরের কথা, এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ পরিচিতিমূলক বই আজ পর্যন্ত লেখা হয়েছে বলে জানা যায় না। সেদিক থেকে শাহীনূর রেজার এ গ্রন্থটি একটি পূর্ণাঙ্গ বই, যা পাঠককে নজরুলের অতুলনীয় সংগীতপ্রতিভা ও বাংলা সংগীতে তাঁর বিশাল ও বহুমুখী অবদান সম্পর্কে জানতে সহায়তা করবে।বিপুল তথ্যের কারণে এ বই নজরুলসংগীত বিষয়ে একটি আকরগ্রন্থ হয়ে উঠেছে।
লেটো থেকে বেতার পর্যন্ত আটটি অধ্যায়ে নজরুলের সংগীতজীবনকে বিভাজন করেছেন লেখক। নজরুলের গানের শিল্পী-সুরকার-স্বরলিপিকার-রেকর্ড কোম্পানি-রাগ-তাল অধ্যায়টি এতটাই জটিল ও শ্রমলব্ধ যে শুধু এ অধ্যায়ের জন্যই গ্রন্থটি সমাদৃত ও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কোন শিল্পী, সুরকার ও স্বরলিপিকারের প্রত্যেকের কতটি করে গান, কোন রেকর্ড কোম্পানির কত গান, কোন রাগ-তালের কত গান—সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে উল্লেখ করে সেগুলো আবার বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। এতে পরবর্তীকালের গবেষক আর নজরুলের অনুরাগীরা উপকৃত হবেন। বলা ভালো, নজরুল সৃষ্ট রাগ-লক্ষণগীত-তাল ও ছন্দ আগেই বিশ্লেষিত হয়েছে। কিন্তু এ বইয়ের বিশ্লেষণে লেখকের নিজস্বতার প্রতিফলন ঘটেছে।
নজরুলের আদি রেকর্ডের শিল্পী-সুরকার-স্বরলিপিকারের নাম ও তাঁদের গানের সংখ্যা আশাতীতভাবে আমাদের আনন্দ দেয়, যা আগে আর কোনো গ্রন্থে উল্লেখিত হয়নি।
নজরুলের লেখা বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৮০। এর মধ্যে সংগীতগ্রন্থ ২০টি। লেখক এ বইগুলো নিয়ে বিশদ বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। দুটি পূর্ণাঙ্গ অপ্রকাশিত লেটো সংযোজন বইটির গুরুত্ব বাড়িয়েছে। নজরুলের গান নিয়ে যে একসময় যথেচ্ছার হয়েছে, এটি এক গানের একাধিক রেকর্ডের আলোচনায় লেখক উল্লেখ করেছেন।
নজরুল যে বাকগেয়কার ছাড়াও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র শিখেছেন সে আলোচনা এ বইয়ের একটি অভিনব অধ্যায়। আর ৩১টি গানের গীতি উৎস নজরুলজীবনীর বিশেষ উপাদান হিসেবে বিবেচিত।
সোয়া দুই দশকের সৃষ্টিশীল জীবনে নজরুলের সান্নিধ্যধন্য মানুষের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু তাঁদের খবরাখবর পাওয়া দুরূহ। শাহীনূর রেজা ছবিসমেত এমন ১৯ জন মানুষকে নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার মধ্যে আছেন ফুল মোহাম্মদ, যিনি নজরুলের দুটি গান গেয়েছেন। শাহীনূর রেজার সংগীতগুরুও তিনি। গুরুকেই গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন লেখক।
সাধারণ সংগীতপিপাসু, সংগীতজ্ঞ, গবেষক, নজরুল অনুরাগী সবারই চাহিদা মেটাবে এ বই।