কোনো কোনো লেখা আছে, পড়তে পড়তেই মনে হয়, এমন লেখা আগে পড়িনি তো! কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদারের উপন্যাস মৃত্যুগন্ধী সেই ধরনের লেখা।
উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র একজন লেখক, যাঁর এখনো পাঠক-সম্প্রদায় গড়ে ওঠেনি, কোনো সম্পাদক যাঁর লেখা আগ্রহভরে ছাপাতে এগিয়ে আসেন না। আবার কোনো প্রকাশকও রাজি হন না তাঁর বই প্রকাশে। এমনকি লেখকের নিজের পরিবারের সদস্যরাও তাঁর প্রতি অবহেলা, অনুযোগ, অবজ্ঞা প্রকাশে দ্বিধা করেন না। তাঁর স্বল্প আয়রোজগার নিয়ে স্ত্রী-সন্তান সুযোগ পেলেই দু–চার কথা শুনিয়ে দেয়। এভাবে প্রতিকূল পরিবেশে থেকে থেকে একসময় হাঁপিয়ে ওঠেন সৃষ্টিশীলতার স্বপ্নে দিনযাপন করা এই লেখক। বলা দরকার, তিনি সমাজ ও মানুষের কাছে একজন দায়বদ্ধ লেখকও বটেন।
পরিবার ও সমাজজীবনের অনুযোগ, অভাব ও অশান্তি থেকে বাঁচার জন্য একসময় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি, চলে যান আত্মগোপনে। এবার নিজের মুখোমুখি হন লেখক। সমাজ, ধর্ম, সংসার, রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা—নানা বিষয়ে প্রশ্ন করে জর্জরিত করেন নিজেকে। আবার উত্তরও খোঁজেন একাই।
যে সমাজে লেখকের লেখাকে কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, লেখালেখি নিতান্তই শৌখিন বা অবসরের হালকা কাজ—এমন বিবেচনা করা হয়, সেই সমাজের এই লেখক তখন ফিরে তাকান তাঁর পূর্বসূরি লেখকদের দিকে।
সাধারণের চোখে লেখক হচ্ছেন কাণ্ডজ্ঞানহীন ও ভবিষ্যৎ বিষয়ে অন্ধ। কিন্তু সত্যিকারের একজন দায়বদ্ধ লেখকের দৃষ্টি যে কতটা প্রসারিত, তা সাধারণের কল্পনারও অতীত। পরিবার ও সমাজের চোখে ভাবলেশহীন ও ভবিষ্যৎজ্ঞানহীন একজন লেখক কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারেন, এই বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয় পাটের দাম নির্ধারণ করা হবে ওয়াশিংটন থেকে—অন্তত মৃত্যুগন্ধী পড়ে আমাদের তেমনই মনে হয়।
বইটি পড়তে পড়তে ভাবনা আসে, এখনকার দিনেও যখন একজন লেখক ‘জীবিকার’ জন্য অন্য কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, তখন সাহিত্যেরই ক্ষতি হয়—এটা বুঝতে পারাটা দরকার। এটা বুঝলে লেখক এবং পরিবার ও সমাজ সবার জন্যই মঙ্গল।
যিনি লেখাকে পেশা হিসেবে নেবেন, তিনি প্রাণপণে খেটে শিখবেন। অপরদিকে শৌখিন যাঁরা, দু–চার দিন পরে সরে যাবেন—এটাই চলে আসছে চিরায়ত কাল ধরে। যদিও লেখকজীবন তেমন লোভনীয় কিছু নয় এখানে, এই সমাজে।
মৃত্যুগন্ধী উপন্যাসের লেখক আত্মগোপনে একটি ধর্মীয় আস্তানায় জায়গা করে নেন। সেখানে তিনি ধর্ম নিয়ে নানা জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হন। শান্তির জন্য ধর্মের আশ্রয়ের কথাও কখনোবা ভাবেন তিনি। আবার পরক্ষণেই মনে করেন, ধর্মনিবিষ্ট হয়েও তো শান্তি আসেনি অনেকের জীবনে। তলস্তয় বা দস্তয়ভস্কি—ধর্মে মনোনিবেশ করে এই কালজয়ী লেখকদ্বয় কি পারিবারিক জীবনে শান্তির দেখা পেয়েছিলেন? পাননি।
তবু পরিবার থেকে আড়ালে গিয়ে নিজের মতো বাঁচতে চেয়েও পুরোপুরি নিস্তার মেলে না মৃত্যুগন্ধীর লেখকের। নানা আশঙ্কায় ভেতরে ভেতরে মিইয়ে থাকেন তিনি। এই অবিখ্যাত, সহৃদয় পাঠকহীন ও প্রকাশকের নিশ্চয়তাহীন লেখককেই একসময় আমরা দেখি অসুস্থ মা–বাবার চিকিৎসার ব্যয় নিয়ে সন্তান হিসেবে চিন্তিত হতে। দেখি স্ত্রীর প্রতি একনিষ্ঠ স্বামী হিসেবে, এবং তাঁকে পাই সন্তানের মঙ্গল কামনারত স্নেহবাৎসল্যে মুখর পিতা হিসেবেও। লেখকের এই সব অনুভূতিকে কিসের সঙ্গে মেলানো যায়, প্রেম নাকি কর্তব্য? এই প্রশ্নের পরেই আমাদের মনে উদিত হয় বার্ট্রান্ড রাসেলের একটি কথা: ‘প্রেম যখন স্বাধীন নয়, প্রেম যখন কর্তব্য, তখন প্রেম মরে যায়।’
এভাবে চেনা সমাজ ও পরিচিত পরিবার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নানা প্রশ্নে নিজেকে জর্জরিত করে চলেন লেখক। একটা সময়ে আত্মহননের চিন্তাও বুঝি পেয়ে বসে তাঁকে! আর সেই উত্তুঙ্গ সময়েই অবচেতন মনে তাঁর সামনে হাজির হন তাঁর নিজের ভাষার এমন একজন কবি, যিনি জীবদ্দশায় পরিবার ও সমাজের নিগৃহ সয়ে, স্বীকৃতি না পেয়ে বেছে নিয়েছিলেন মৃত্যুর সরল পথ। আবার ওই কবিরই একটি কবিতা লেখককে মনে করিয়ে দেয় মৃত্যুর চেয়ে জীবন কত সুন্দর, সেই কথাটিও। শেখায়, জীবনকে উদ্যাপন করতে হয় নিজের মতো করে এবং শেষ পর্যন্ত জীবন এগিয়ে যায় তার অপ্রতিরোধ্য গতিতে।
জাকির তালুকদারের মৃত্যুগন্ধী উপন্যাসটি জীবনের এই সত্যসমূহ আমাদের সামনে উন্মোচনের পাশাপাশি প্রচলিত এই সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু প্রশ্নও ছুড়ে দেয় পাঠকের কাছে। ‘দায়বদ্ধ’ এক লেখকের জীবনের পরতে পরতে থাকা ওই প্রশ্নগুলো আমাদের ভাবায়, আমাদের আক্রান্ত করে।