আদার্স নামে সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন। সেখানে রয়েছে ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, স্মিতা পাতিলসহ নানা অঙ্গনের মানুষের অজানা আখ্যান।
গাঁদা ফুলে ইন্দিরা গান্ধীর যে প্রবল অ্যালার্জি ছিল, আমি জানতাম না। জানতাম না, গাঁদা ফুল যাতে তাঁর ধারেকাছে পৌঁছাতে না পারে, সে জন্য তাঁর কাছের লোকজনকে কড়া নির্দেশ দেওয়া ছিল। অথচ কী আশ্চর্য, তিন মূর্তি ভবনে শায়িত ছিন্নভিন্ন ইন্দিরার শরীর ঢাকা পড়েছিল অজস্র হলুদ কমলা ও রক্তচন্দন গাঁদার মালার তলায়! বিহ্বলতায় আচ্ছন্ন সঙ্গীদের চেতনা লুপ্ত পেয়েছিল হয়তো। কিংবা হয়তো বেদনাদীর্ণ মানুষের ঢলকে বাধা দেওয়ার উপায় কারও জানা ছিল না।
জানা ছিল না এ কথাও যে গাঁদা ফুলে অ্যালার্জি না থাকলেও খানিক সময় মালা পরে থাকলে রাজীব গান্ধীর ঘাড়-গলাতেও লাল লাল র্যাশ বেরিয়ে যেত। ভক্ত বা অনুগামীদের মালা রাজীব গ্রহণ করতেন। কিন্তু বেশি সময় গলায় পরে থাকতেন না। সেই মালাই তাঁর কাল হয়ে দাঁড়ায়। তামিলনাড়ুর শ্রীপেরুমবুদুরে নিজের নিয়তি ধানুকে মালা হাতে এগিয়ে আসতে রাজীবই অনুমতি দিয়েছিলেন। তারপরই তো তিনি ইতিহাস!
সাংবাদিক হিসেবে কুমকুম চাড্ডা যখন দিল্লিতে কাজ শুরু করেছিলেন, সেই সময় খুব বেশি সংখ্যক নারী এই পেশায় ছিলেন না। কিন্তু যাঁরা ছিলেন, ইংরেজিতে সাংবাদিকতা করার সুবাদে তাঁদের অনেকেই খুব নাম করেছিলেন। সেই সময়, গত শতকের সত্তরের দশক থেকে দিল্লির হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায় কুমকুম চাড্ডা নিজের গুণে একটা জায়গা করে নিয়েছিলেন। জায়গা করাটা খুব সহজ ছিল না মোটেই। কারণ, সেই সময়ে দেশের রাজনীতিবিদেরাও নারী সাংবাদিকদের খুব একটা সম্ভ্রমের চোখে দেখতেন না।
কুমকুম তাঁর এই দীর্ঘ জীবনে বহু বিখ্যাত ভারতীয়র সংস্পর্শে এসেছেন। কারও কারও সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সখ্যও গড়ে উঠেছিল। খুবই কাছ থেকে তাঁদের দেখেছেন। কারও কারও সুখ-দুঃখের সঙ্গীও ছিলেন। এই সব মানুষ, যাঁদের তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন, পেশার দৌলতে বহুদিন ধরে যাঁদের সঙ্গ পেয়েছেন, তাঁদের জীবনের নানা কাহিনি—জানা ও অজানা—তিনি একত্র করেছেন দ্য ম্যারিগোল্ড স্টোরি: ইন্দিরা গান্ধী অ্যান্ড আদার্স বইয়ে। এই সব কাহিনি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস হয়তো নয়, কিন্তু ইতিহাসের অঙ্গও যে নয়, তা বলা যাবে না। সেই সব কাহিনিতে যেমন ফুটে উঠেছে ইন্দিরাতনয় সঞ্জয় গান্ধীর ‘থোড়াই কেয়ার অ্যাটিটিউড’, যা কিনা স্বৈরতন্ত্রের সংজ্ঞাভুক্ত হতে পারে, তেমনই চিত্রিত রাজীব গান্ধীর সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্র। কুমকুমের লেখা থেকে জানা যায়, সঞ্জয় চাইতেন লোকজন তাঁকে ভয় পাক। দলের বড় কোনো নেতা হয়তো ইন্দিরার কাছে এসেছেন, সঞ্জয় তাঁর পোষ্য কুকুরকে নিয়ে সেখানে হাজির হতেন। হাজির হতেন এটা জেনেই যে ওই নেতার কুকুরে বড় ভয়। বড়-ছোট সবার কাছ থেকে এই সমীহ আদায়ই সঞ্জয়কে আর পাঁচজনের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। তার খেসারত সাংবাদিক কুমকুমকে কীভাবে দিতে হয়েছে, সেই গল্পও এখানে লিপিবদ্ধ। নিজের বইয়ে কুমকুম জোর দিয়েছেন এই সব গল্পের ওপর, ইংরেজিতে যা ‘অ্যানেকডোট’, যা মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণে সহায়ক হয়। সেই গল্প আমাদের জানিয়ে দেয় কীভাবে টেলিভিশনের পর্দা ছেড়ে স্মৃতি ইরানী রাজনীতির আঙিনায় পাকাপাকি জায়গা করে নেন, দিন-রাত এক করে জয়া বচ্চনের প্রচার এলাহাবাদ নির্বাচনে স্বামী অমিতাভের জয় কীভাবে মসৃণ করে তুলেছিল, কিংবা হাতঘড়ির অমোঘ আকর্ষণ উপেক্ষা করতে না পারা অরুণ জেটলি কেন একজন ‘রাইট ম্যান ইন দ্য রং পার্টি’।
শুধু রাজনীতিবিদদের গল্পই কুমকুম শোনাননি, শুনিয়েছেন অন্য পেশার বহু সফল মানুষের কথা। শুটিংয়ে প্রথম ভারতীয় হিসেবে অলিম্পিক সোনাজয়ী অভিনব বিন্দ্রার কুঁড়েমি, খেলাধুলো না করার আলসেমি কীভাবে ও কেন তাঁকে হাতে বন্দুক তুলে নেওয়ার তাগিদ ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল, সেই কাহিনি তিনি লিখেছেন। লিখেছেন ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শনীতে বিপ্লব আনা অজয় বিজলির সাফল্য। শুনিয়েছেন তাঁর পারিবারিক পদবি কীভাবে ‘বিজলি’ হয়ে গেল সেই গল্পও। আর শুনিয়েছেন, ভারতীয় টেলিভিশনের ‘সোপ অপেরা কুইন’ একতা কাপুর ও তাঁর ঈশ্বরভক্তির গল্প। বিজেপির ‘লৌহপুরুষ’ লালকৃষ্ণ আদভানির অযোধ্যা রথযাত্রা যত না প্রাধান্য পেয়েছে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ব্যক্তি আদভানির সাধ, সাধ্য, ত্যাগ, অধরা স্বপ্ন ও চরম একাকিত্ব।
অবিশ্বাস্য ও অদ্ভুত সব গল্প বলেছেন কুমকুম এই বইয়ে। যেমন লালু প্রসাদ। হাকুচ দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী ছিল বলে লালুর ছেলেবেলা কেটেছিল জুতাবিহীন। সেই কারণে তাঁর পায়ের পাতা ছিল ছড়ানো। বন্য ইঁদুরের মাংস ও মোটা চালের ভাত পেলে বুভুক্ষু যে পরিবারে উৎসব লেগে যেত; যারা গরু, গোবর ও গরুর গাড়ির বাইরে আর কিছু জানত না, ভাগ্যের ফেরে সেই পরিবারের লালু প্রসাদ বিহারের মুখ্যমন্ত্রী যেমন হলেন, তেমনই স্ত্রীকেও হেঁসেল থেকে টেনে এনে তাঁর হাতে রাজত্ব সঁপে দেশের রাজনীতিতে পাকাপাকি স্থান আদায় করে নিলেন। আকণ্ঠ দুর্নীতির অভিযোগে কলুষিত সেই লালুর কথা কুমকুম শুনিয়েছেন, যিনি বলেছেন, ‘কলঙ্ক লাগে। কিন্তু ভাগ্যের কী লীলা, যতবার শোনা যায় লালু গেল, লালু গেল, লালু শেষ, প্রতিবারই দেখা গেছে লালু ফিরে এসেছেন প্রবলভাবে।’
এই বইয়ের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী অধ্যায় নন্দিত অভিনয়শিল্পী স্মিতা পাতিলকে ঘিরে। মহারাষ্ট্রের নাসিকের কৃষিশ্রমিক বাবা ও পরিচারিকা মায়ের সন্তান স্মিতার সঙ্গে কুমকুমের অদ্ভুত এক সখ্য গড়ে উঠেছিল। কুমকুম হয়ে উঠেছিলেন স্মিতার একমাত্র বন্ধু। অভিনেতা রাজ বাব্বরের মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর প্রেম। বাব্বর তাঁর সন্তানের পিতা। স্মিতা মনেপ্রাণে মা হতে চেয়েছিলেন। ভালোবাসায় ডুবে যেতে চেয়েছিলেন। মুম্বাইয়ের কার্টার রোডে নিজ নিকেতনে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তাঁর সংসার। সেই সংসার যা তাঁর, তাঁর সন্তান ও সন্তানের পিতাকে ঘিরে আবর্তিত হবে। সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে, হাসপাতাল থেকে পুত্রকে কোলে নিয়ে সেই সংসারে স্মিতা ফেরত আসছেন গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠান না করেই। শরীর অশক্ত। মনও খানখান। প্রিয় বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে অসুস্থতাকে জয় করতে না পারা স্মিতার সেই কথা, ‘কুমকুম, বাঁচার আর কোনো ইচ্ছে আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই’—কেন যেন মনে করিয়ে দেয় মেঘে ঢাকা তারার সেই আকুতি, ‘দাদা, আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম, সত্যি সত্যি বাঁচতে চেয়েছিলাম।’ বাঁচার জন্য এক নারীর আঁকুপাঁকু করে ওঠা, আরেক নারীর বাঁচতে না চাওয়ার প্রার্থনা কেমনভাবে যেন মিলেমিশে যায় এখানে।
এক সপ্তাহ কাটতে না কাটতেই মারা গিয়েছিলেন স্মিতা।
হয়তো অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি, হয়তো অনেক জিজ্ঞাসাও অনন্ত আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় রইল। তবু বইটার একটার পর এক অধ্যায় পড়তে পড়তে মনে হয়, নানান ফুল দিয়ে একটা মালা গাঁথতে চেয়েছেন কুমকুম চাড্ডা। ট্রাঙ্কুয়েবার থেকে বেরোনো দ্য ম্যারিগোল্ড স্টোরির সার্থকতা সেটাই।