বিদেশে বায়োগ্রাফার বা জীবনীকার পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও আমাদের দেশে এখনো এর প্রচলন ঘটেনি এবং সব সময় তা নির্মোহ না-ও হতে পারে। আবার ইতিহাসের চরিত্র যখন হন কোনো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, তখন বাইরে থেকে একজন গবেষক বা লেখকের সেখানে পৌঁছানো যেমন কঠিন, তেমনি পৌঁছাতে পারলেও তা হয়ে যেতে পারে ফরমায়েশি রচনা। তাই অজানা গুরুত্বপূর্ণ সংগৃহীত তথ্য নিয়ে বই রচনার সময় লেখক-গবেষককে খুব সাবধানে অগ্রসর হতে হয়।
সরাফ আহমদ সেই কাজই করেছেন তাঁর ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড: প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার দুঃসহ দিন বইটিতে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবার নিহত হওয়ার পর প্রবাসে থাকা তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা কেমন করে সেই দুঃসহ দিনগুলো পার করেছিলেন, তথ্য-উপাত্তসমেত এ বইয়ে আছে সেই বৃত্তান্ত। দীর্ঘ সাড়ে তিন দশক ধরে জার্মানিতে বসবাসরত সরাফ আহমেদ এতে তুলে এনেছেন অজানা তথ্য, উদ্ধার করেছেন দলিলপত্র, ইন্দিরা গান্ধী, ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার অপ্রকাশিত চিঠি, প্রেস ক্লিপিংস ও ছবি। বাংলায় অনুবাদ করেছেন আর্কাইভে রাখা জার্মান সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধ। লেখক ফোন ও ই-মেইলে বিভিন্নজনের সঙ্গে যোগযোগ করলে একটির পর একটি নতুন সূত্রের সন্ধান পেতে থাকেন। বার্লিন, বন, ফ্রাঙ্কফুর্ট, কার্লসরুয়ে, ভিয়েনা ব্রাসেলস, আমস্টারডাম, ওয়াশিংটন, বেঙ্গালুরু, ঢাকা—এসব জায়গায় সেই সময়ের ঘটনার সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের খুঁজে বের করেছেন তিনি।
প্রাক্কথনে লেখক লিখেছেন, ‘প্রাণে বেঁচে যান দুই কন্যা ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে জার্মানিতে আসার কারণে। তাঁরা কীভাবে, কোথায় ছিলেন, কারাই-বা সেই রুদ্ধশ্বাস সময়ে বিপদের সাথি হয়েছিলেন, বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংবাদপত্র, জার্মানির সেই সময়কার রাজনীতিক বা জার্মানরা বিষয়টি কীভাবে দেখেছিলেন, এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে থাকি। নতুন প্রজন্ম ও গবেষকদের কাছে সেসব তুলে ধরার তাগাদা অনুভব করি।’ আর এই ভাবনা থেকেই হয়তো তিনি বইটি উৎসর্গ করেছেন সেদিনের দুই শিশু জয় ও পুতুলকে।
১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড: প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার দুঃসহ দিন
সরাফ আহমেদ
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা প্রকাশকাল: আগস্ট ২০২১
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
পৃষ্ঠা ১৪৮, দাম: ৩০০ টাকা।
বইটি পাওয়া যাচ্ছে
prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে।
বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপতি, সেই সময় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের আগে কন্যাদের জার্মানযাত্রার সময় তাঁদের হাতে মাত্র ৫০ ডলার করে তুলে দিয়েছিলেন তিনি। এরপর ঘটে সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ড। পাল্টে যায় দৃশ্যপট। বঙ্গবন্ধুকন্যাদের জন্য চলে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান। চরম দুঃসময়ে কেউ দূরে চলে যান, কেউবা পাশে এগিয়ে আসেন। গোপন কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা পাহারা দিয়ে তাঁদের পৌঁছে দেন বিমানবন্দরে। কাউকে না জানিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে পৌঁছে যান দিল্লি। দুই বোন দিল্লিতে কঠোর নিরাপদ আশ্রয়ে থাকলেও ছিল নিরাপত্তার আতঙ্ক। গোপনীয়তার জন্য সবাইকে ছদ্মনাম গ্রহণ করতে হয়। রাজ্য সরকার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে রাজি না হওয়ায় শেখ রেহানার বিশ্বভারতীতে পড়ার স্বপ্নও অপূর্ণ থেকে যায়। নির্বাসিত জীবনে নানান বাস্তবতার মুখোমুখি হয় এই পরিবার। ইন্দিরা গান্ধীর পরবর্তী সরকার মাসিক ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেয়। পরিচয় প্রকাশ না করে ছদ্মনামেই আকাশবাণী দিল্লিতে কাজ করেন শেখ হাসিনা। চলে জয় ও পুতুলের লেখাপড়ার আয়োজন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১। ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন। রুদ্ধশ্বাস দিন। ঘটনার পর ঘটনা। এরই মধ্যে নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞের বিচার দাবিতে বিশ্বজনমত গঠনের চেষ্টা। ৪৬ বছর আগের এসব ঘটনার সবিস্তার বিবরণ সংগ্রহ ও মলাটবন্দী করার কাজটি আসলে সহজ ছিল না।
সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক এ করিম ও গবেষক ড. শহীদ হোসেন ছিলেন সেই দুঃসময়ের সাথি। ইতিহাসের এই সাক্ষীদের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণা বইটিতে সংযোজিত হয়েছে, যা বইটির গ্রহণযোগ্যতা ও সূত্রকে আরও জোরালো করেছে। ১০টি পর্বে সাজানো হয়েছে এ বই। বইটি পাঠক ও গবেষকদের ইতিমধ্যেই কৌতূহলী করে তুলেছে। এরই মধ্যে ছাপা হয়েছে তৃতীয় মুদ্রণ।