ইতিহাসের আকরগ্রন্থ

হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ, সম্পাদক: আবদুল মমিন চৌধুরী ও রণবীর চক্রবর্তী, প্রচ্ছদ: রাজীব চক্রবর্তী, প্রকাশক: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, প্রকাশকাল: আগস্ট ২০১৮, দাম: (দুই খণ্ডের সেট) ৪০০০ টাকা।
হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ,  সম্পাদক: আবদুল মমিন চৌধুরী ও   রণবীর চক্রবর্তী,  প্রচ্ছদ: রাজীব চক্রবর্তী,  প্রকাশক: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, প্রকাশকাল: আগস্ট ২০১৮,  দাম: (দুই খণ্ডের সেট) ৪০০০ টাকা।

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্যোগে সম্প্রতি দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে গবেষণামূলক বই হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ। এতে সন্নিবেশিত হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ অঞ্চলের প্রত্নতত্ত্ব, রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের মূল্যবান প্রবন্ধ। অধ্যাপক আবদুল মমিন চৌধুরী ও অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তীর নিবিড় সম্পাদনায় প্রস্তুত সতেরো শ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থের মুখবন্ধ লিখেছেন আরেক দিকপাল ঐতিহাসিক অধ্যাপক রোমিলা থাপার। প্রাক্​–কথন রচনা করেছেন জাতীয় অধ্যাপক ও গ্রন্থটির সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি আনিসুজ্জামান।

মুখবন্ধে রোমিলা থাপার যথার্থই উল্লেখ করেছেন যে যদিও এ বইয়ের মূল শিরোনাম ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’, প্রকৃতপক্ষে এর বিস্তৃতি তার চেয়েও অনেক ব্যাপক; এবং যথার্থ ইতিহাস-সচেতনতার উপলব্ধি থেকেই এর পরিসর বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানায় বৃত্তাবদ্ধ করার কথা ভাবা হয়নি।

আলোচ্য বইয়ে উল্লিখিত সময়কালে বাংলার অস্তিত্ব একদিকে যেমন ছিল বিস্তারিত, তেমনি অন্যদিকে এ অঞ্চল ছিল বিভক্ত এবং একাধিক রাজনৈতিক শক্তির অধীনস্থ। ফলে তার বিচিত্র ও বিস্তৃত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্তরায়ণ, কৃষি ও বাণিজ্যভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো, বিভিন্ন পেশা ও বর্ণের মানুষে গ্রন্থিত সমাজ, একাধিক ধর্মীয় চেতনা ও লৌকিক বিশ্বাসে নির্মিত আধ্যাত্মিকতা, বহুল প্রচারিত আঞ্চলিক কথ্য ভাষা (যা ক্রমে বিবর্তিত হয়ে রূপ নিচ্ছে পরিশীলিত সাহিত্যের ভাষায়)—এসব উপাদানের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে বাংলার প্রাচীন পর্বের জটিল ও বহুমাত্রিক ইতিহাস। বইয়ের দুটি খণ্ডে পর্যায়ক্রমে এই সব বিষয়ের ওপর একাধিক প্রবন্ধ সন্নিবেশিত হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে বাংলার আদিপর্বের ইতিহাসের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাঠকের সামনে উপস্থাপনের।

উল্লেখ করা অসঙ্গত হবে না, প্রাচীন ও মধ্যযুগ নিয়ে ইংরেজ শাসনের শেষ পর্বে ১৯৪৩ ও ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ইংরেজিতে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল হিস্ট্রি অব বেঙ্গল। এর প্রায় সাত দশক পর আহরিত নতুন তথ্য-উপাত্ত, অগ্রসর গবেষণাপদ্ধতি ও ইতিহাসের নতুন ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রাগৈতিহাসিক থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বাংলার ইতিহাস প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে এ দেশের অগ্রণী সারস্বত সমাজ বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। ফলে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের সম্পাদনায় ১৯৯২ সালে তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয় হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ (১৭০৪-১৯৭১)। এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নবাবি, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান পর্বের ইতিহাস। ওই সময়েই আশা করা হয়েছিল, আদি যুগ থেকে সমসাময়িক কাল পর্যন্ত সামগ্রিক ইতিহাস আরও কয়েকটি খণ্ডে প্রকাশ করা হবে।

আদতে বাংলার ইতিহাসের আদিপর্বের বিস্তৃত পরিসরে পরিকল্পিত গবেষণাগ্রন্থের অভাব রয়েই যাচ্ছিল। অবশেষে, দীর্ঘদিনের ব্যবধানে হলেও সেই শূন্যতা পূরণের প্রয়াসে প্রকাশিত হলো এই সংকলন। এখানে প্রণীত হয়েছে আদিকাল থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস। এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত ১৮টি প্রত্নস্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে প্রাপ্ত সামগ্রীর বিবরণ ও বিশ্লেষণ। বলা যায়, এই প্রথম আমরা দেখলাম ইতিহাস বইয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাত্তের অন্তর্ভুক্তি। এতে করে আমাদের সভ্যতার উন্মেষকাল ও প্রাগৈতিহাসিক মানব সভ্যতার বিবর্তনে প্রত্নস্থানগুলোর ভূমিকা ও তাৎপর্য পাঠকের কাছে অনেকটা বোধগম্য হয়েছে।

বইয়ের রাজনৈতিক ইতিহাস অংশের প্রণেতারা এই পর্বের বহু অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর বা ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন, দূর করেছেন ইতিহাসের স্বল্প আলোকিত অধ্যায়ের অস্বস্তিকর তমসা। বিগত অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে পাওয়া গিয়েছে বিপুল তথ্য-উপাত্ত, যে কারণে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের বিদ্যমান ইতিহাসের রদবদল। বর্তমান সংকলনটি বহুলাংশে নবপর্যায়ে ইতিহাস পুনর্লিখনের সেই দায় মিটিয়েছে। আবদুল মমিন চৌধুরীর পরিণত প্রজ্ঞায় পাল-সেন যুগের বংশানুক্রমিক ইতিহাসের ভাষ্য অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এতে; যা অনেক ক্ষেত্রে, ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত তাঁরই যুগান্তকারী বই ডায়নাস্টিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল-এ প্রণীত ইতিহাসের নবায়িত ভাষ্য। অকালপ্রয়াত তরুণ গবেষক ড. শরীফুল ইসলাম দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ইতিহাস নির্মাণের ক্ষেত্রেও অনেক বিদ্যমান প্রচলিত ধারণার পুনর্বিবেচিত বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন। 

রণবীর চক্রবর্তী রচিত রাষ্ট্র নির্মাণ–সংক্রান্ত দীর্ঘ, তথ্যবহুল ও বিশ্লেষণী প্রবন্ধ দিয়ে প্রথম খণ্ডের সমাপ্তি ঘটেছে। প্রাচীন তাম্রশাসন, লেখমালা, শাস্ত্রগ্রন্থ ও অন্যান্য তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে চমৎকারভাবে তিনি দেখিয়েছেন এ অঞ্চলের আদিপর্বের রাষ্ট্রীক ইতিহাসের পর্যায়গুলোর বিবর্তনমূলক ধারা। দ্বিতীয় খণ্ডে ‘সমাজ’ অংশের পরিশিষ্টে অধ্যাপক নূপুর দাশগুপ্ত সামাজিক ইতিহাস নির্মাণে প্রাচীন ভারতের প্রেক্ষাপটে নারীর ইতিহাস সম্পর্কে গবেষণার পদ্ধতি ও পরিসর বিষয়ে সাম্প্রতিক অগ্রগতির যে মূল্যায়ন উপস্থাপন করেছেন, তা কেবল নারী বা জেন্ডার নয়, সামগ্রিকভাবে ইতিহাসের দর্শনের পরিবর্তমান ধারা সম্পর্কেও আমাদের অবহিত করে। দুই খণ্ডে (অধ্যায় ও পরিশিষ্ট মিলিয়ে) প্রায় ৪৮টি অধ্যায়ে এ বইয়ে প্রাচীন বাংলার রাজনীতি-সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতির নানা দিক উঠে এসেছে বিশেষজ্ঞ-গবেষকদের বিশ্লেষণী মৌলিক অভিমতসহ। পাতায় পাতায় প্রাসঙ্গিক সাদা-কালো ও রঙিন ছবি এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের উৎখননে প্রাপ্ত বিবরণী বইটির উপযোগিতা বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণে। আশা করা যায়, এগুলো ইতিহাসের আকরগ্রন্থ হিসেবে বিদ্বৎমহলে, আগ্রহী সাধারণ পাঠকের কাছে, এমনকি অনাগত ভবিষ্যতের গবেষক–সমাজেও সযত্ন সমাদর লাভ করবে। হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ–এর বাংলায় ভাষান্তরিত সংস্করণটিও বর্তমানে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।