গত বছর ‘আগস্ট আবছায়া’ প্রকাশের পরপরই কথাসাহিত্যের জগতে একটা বেশ সাড়া ফেলে দেন মাসরুর আরেফিন। যদিও বোদ্ধারা জানেন, সাহিত্যাঙ্গনে মাসরুর আরেফিন নবাগত নন। বহুকাল আগে তাঁর কাব্য ‘ঈশ্বরদী, মেয়র ও মিউলের গল্প’ প্রকাশের পরই বোঝা গিয়েছিল, চেনাশোনা পথে তিনি হাঁটবেন না। হয় স্বতন্ত্র পথে হাঁটবেন, নয় হাঁটবেন না।
মাসরুর ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র। গোড়া থেকেই বিশ্বসাহিত্যের পাঁড় পাঠক। তার প্রতিফলন ‘ফ্রানৎস কাফকা রচনাবলী’ ও হোমারের ‘ইলিয়াড’ অনুবাদ। এরপরই এল ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাঁর ধ্রুপদি উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’। বইটি বইমেলায় সিরিয়াস উপন্যাস বিক্রিতে বোধ করি একটি নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। জাতির পিতার সপরিবারে নিহত হওয়ার হৃদয়বিদারক ও আবেগঘন ঘটনা, তার সঙ্গে মাসরুরের ভিন্নরকম গদ্য ও অভিনব লিখনরীতি বোদ্ধাদের মুগ্ধ করেছিল।
এ বছর মাসরুর যখন তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আলথুসার’ নিয়ে হাজির, তখন সবাই বুঝল, এই লেখক একটি মিশনে নেমেছেন এবং তাঁর কলমখানি সচল। বছরে একটি সিরিয়াস উপন্যাস মন্দ নয়; আর ওই ট্রেন যদি সচল থাকে, তবে ১০ বছরে ১০টি ধ্রুপদি রীতির উপন্যাস নিয়ে মাসরুর আরেফিন আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এক মহিরুহ হয়ে উঠবেন।
আলথুসার হলেন ফরাসি দার্শনিক; বিখ্যাত মার্ক্সবাদী। রাষ্ট্র যে একটি দমন-পীড়নমূলক যন্ত্র, এই তত্ত্বের উদ্গাতা তিনি। বাংলার বেশির ভাগ পাঠক তাঁকে চেনে না। ফলে, এক দুর্জ্ঞেয় রহস্য নিয়েই তারা যায় বইটি সংগ্রহ করতে। মাসরুরের ব্যাপক পঠনপাঠন ছায়া ফেলে যায় তাঁর উপন্যাসে, ফলে কখনো সেগুলো হয়ে ওঠে একধরনের কোলাজ, বিশেষ করে সে টেনে নিয়ে আসে কবিতাকে। কাহিনির সঙ্গে মিশে যায় প্রবন্ধ, ধারাভাষ্যের পাশে বসে থাকে কবিতার স্তবক।
‘আলথুসার’ পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে আমি হোর্হে লুইস বোর্হেস পড়ছি, কখনো মনে হয়েছে প্রবন্ধ পড়ছি, কখনো উপন্যাস। এটি মাসরুরের শক্তি হতে পারে, হতে পারে তাঁর দুর্বলতাও। আর এই যে একটি দিনের ভেতর এত ঘটনার ঘনঘটা, তা মনে পড়িয়ে দেয় গত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’-এর কথা। মাসরুরকে আমি বলব ডিটেলিংয়ের মাস্টার। কল্পনার অকল্পনীয় বিস্তার তাঁর লেখায়, আর ফিকশন বা উপন্যাস তো কল্পনাই। উত্তম পুরুষে লিখিত বলে তা হয়ে ওঠে বিশ্বাসযোগ্য।
‘আলথুসার’ আমার মতে একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। রাষ্ট্র কীভাবে নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করে তার ‘হার্ডওয়্যার’ সেনাবাহিনী, পুলিশ, কর্মচারী দিয়ে, আবার তার ‘সফটওয়্যার’ প্রোপাগান্ডা, মগজধোলাই, সূক্ষ্ম প্রচারণা দিয়ে মাসরুর তা উন্মোচিত করেন এ উপন্যাসে। একদল পরিবেশবাদীর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে আসে রাষ্ট্রের নিপীড়ন, ভেতরকার কলকবজা, আর এমনকি এসব পরিবেশবাদী আন্দোলনের গতি-প্রকৃতিও। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, পৌরনীতি, সমাজবিজ্ঞান আর সংস্কৃতি, পরিবেশদূষণ ইত্যাদি নিয়ে মাসরুরের ব্যাপক পড়াশোনার প্রতিফলন ঘটতে থাকে পাতায় পাতায়। মাসরুর যে পাশ্চাত্য ঢঙের আধুনিক, তা বুঝতে সময় লাগে না। তাঁর চরিত্রগুলো ছুৎমার্গবিবর্জিত। এই আন্তর্জাতিক চরিত্র বোঝা যায় যৌনতার বর্ণনায়, যা প্রোভোকেটিভ হয়েও সীমান্ত মেনে চলে, তবে কোনোরূপ ভণিতা করে না।
ঘটনার সূত্রপাত উপন্যাসের নায়ক তরুণ ব্যাংকারের ট্রেনিং নিতে লন্ডন যাওয়া আর তার আলথুসারপ্রীতি–উদ্ভূত আগ্রহ থেকে অক্সফোর্ড স্ট্রিটের কোথাও আলথুসারের লন্ডনে অবস্থানকালে বাড়িটিকে খুঁজে বের করে স্বচক্ষে দেখার মাধ্যমে। টিউব স্টেশনে নামতেই তাকে পাকড়াও করে লন্ডনের পুলিশ। তারা ভাবে নায়ক ওই পরিবেশবাদীদের আন্দোলনে যোগ দিতে এসেছে। বস্তুত নায়ক ‘এক্সটিংশন রেবেলিয়ন’ নামের পরিবেশবাদীদের সম্পর্কে ওই পুলিশের মুখেই প্রথম শুনল, আর সে জানতই না সমুখে অক্সফোর্ড স্ট্রিটে পরিবেশবাদীরা এক বিশাল গণজমায়েত বসিয়েছে। পুলিশের হাত থেকে মুক্ত হয়ে সে ও তার দুই আত্মীয় গিয়ে পড়ে পরিবেশবাদীদের ভেতর, আর লেখক জড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের সঙ্গে। সেখানে মেগান নামের এক মেয়ে তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। তবে তার মূল আগ্রহ এই কৌতূহলোদ্দীপক পরিবেশবাদীদের আন্দোলনে প্রফেসর স্যামুয়েল ও উইলিয়াম স্কিপিং নামের কিছু ব্যতিক্রমী চরিত্র। পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের বিপক্ষে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে গিয়েই সে ফেঁসে যায়, প্রফেসর স্যামুয়েল তাকে টানতে টানতে নিয়ে আসে এক প্রত্নঘরে, যেখানে বিরাট টেবিলের ওপর শায়িত এক তিমি—সেটাই ওই প্রজাতির সর্বশেষ তিমি, সেই তিমি আবার কথা বলে (পরাবাস্তব)।
এই পরাবাস্তবতা ছড়িয়ে আছে মাসরুরের লেখায়, বিশেষ করে তাঁর সিগনেচার গদ্যে। মাঝেমধ্যোই সে নস্টালজিক হয়ে ওঠে, তখন ভেসে ওঠে শৈশবের ধানসিঁড়ি নদী, জীবনানন্দ, বরিশাল আর ঝালকাঠি। ‘এক্সটিংশন রেবেলিয়ন’-এর সদস্য ফর্ম পূরণ করতে গিয়ে সে যে সবিস্তর বর্ণনা লেখে তার কৈশোরকালের স্মৃতির, তা তো পরাবাস্তবতায় মোড়ানো। বস্তুত মাসরুরের গদ্য গতিশীল ও এলোমেলো। একধরনের মাতাল গদ্য বলা যায়, যা পা ফেলছে এলোমেলো, কিন্তু সঠিক পথেই, যাচ্ছে সে গদ্য সঠিক গন্তব্যেই। মাঝেমধ্যে সে তার কল্পনার বল্গাঘোড়াগুলোকে ছেড়ে দেয় আর তারা এসে পড়ে অধীত জ্ঞানের এক জগতে। ফলে এখানে যে গদ্যের জন্ম হয় তা অধিবিদ্যক। কখনো টাইম মেশিনে চড়ে সে লন্ডনের হাইড পার্ক থেকে চলে আসে বরিশালের মিশন রোডে, তার শৈশবে, জীবনানন্দ দাশের বাড়িতে।
এই উপন্যাসের একটি অন্যতম প্রধান দিক হলো ‘সত্যকথন’, গ্রিকরা যাকে ‘পারহেসিয়া’ বলে। এই পারহেসিয়া বা সত্যকথন উপন্যাসের নায়ক লেখককে বারবার বিপদগ্রস্ত করেছে, করেছে অজনপ্রিয়, কিন্তু সে সত্য উদ্ঘাটনে ও সত্যকথনে পিছপা হয়নি। বস্তুত পারহেসিয়া হলো দমন–নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য বড় হুমকি। রাষ্ট্র সত্যকে ভয় পায়। সে লুকিয়ে রাখে সত্য আর প্রচারণা করে মিথ্যা।
মাসরুরের ডিটেলিংয়ের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে লুই আলথুসার লন্ডনের যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন সেই বাড়ির প্লাম্বিং সিস্টেম নিয়ে বুড়ো ক্লেইজের বর্ণনা, যিনি আলথুসারকে শেষাবধি এক পানির পাইপের মিস্ত্রি বানিয়ে ছাড়েন। যৌন অবদমন ও ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব মাসরুরের লেখার ভেতরে পাশ্চাত্যের উপন্যাসের মতোই আড়ালহীন, কিন্তু শিল্পসম্মত। লেখকের দুর্বলতা যে নারীকে ঘিরে, সেই মেগানের দ্বিতীয় রাতেই নারীশরীরলোভী পুলিশ কনস্টেবল মার্কের শয্যাসঙ্গিনী হওয়া অ্যান্টিরোমান্টিক। তবে আধুনিক মননের লেখক কিন্তু নির্বিকার। কারণ, তাঁর কাছে চরিত্রচিত্রণই জরুরি, আর তিনিই তো তৈরি করেন চরিত্র, তিলকে তাল বানান আর কল্পনার পরিদের ছেড়ে দেন শব্দের বাগানে।
আলথুসারমাসরুর আরেফিনপ্রচ্ছদ: সেলিম আহ্মেদ, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২০, ৩৪৪ পৃষ্ঠা, দাম: ৬৫০ টাকা।
এক প্রতিভাবান মার্ক্সবাদী ফরাসি দার্শনিকের দর্শন যেমন এ উপন্যাসের বিষয়, তেমনি তাঁর জীবনের এক ভয়ংকর ট্র্যাজেডি এ উপন্যাসে বিধৃত। আলথুসার ছিলেন ঘুমের ভেতর হেঁটে বেড়ানো একজন মানুষ, যিনি বিশ্বাস করতেন পরিবার হলো নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রথম ইউনিট। মানসিক অবসাদে ভোগা এই বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ঘুমের ভেতরে গলা টিপে হত্যা করেন তাঁর স্ত্রী হেলেনকে, যিনি নিজেও বামপন্থী ছিলেন। অর্থাৎ আলথুসার একজন উন্মাদ মস্তিষ্কের খুনি। আলথুসারের পক্ষে-বিপক্ষে লেখকের তাত্ত্বিক ডিসকোর্সটি খুবই বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানসঞ্চারী নিঃসন্দেহে। কিন্তু সেসব বিশুদ্ধ দার্শনিক তত্ত্ব উপন্যাসের পাঠকদের মন ও পঠনকে ভারী করে তুলতে পারে।
প্রথম উপন্যাস থেকেই বোঝা গেছে, কোনো প্রথাগত বিষয় নিয়ে মাসরুর লিখবেন না। ছিঁচকাঁদুনে গল্প লিখবেন না, হাঁটবেন না কোনো চেনাজানা পথে। ‘আলথুসার’ তার বিষয়বৈচিত্র্যে খুবই আলাদা। এমন বিষয় নিয়ে বাংলায় কোনো উপন্যাস লেখা হয়নি। ‘আগস্ট আবছায়া’ নিয়ে যে বিতর্ক উঠেছিল, ১৫ আগস্ট নিয়ে সেটাই প্রথম কোনো পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস কি না, ‘আলথুসার’ নিয়ে তেমন বিতর্ক ওঠার সুদূরতম কোনো সম্ভাবনা নেই। এই উপন্যাসের মঞ্চ লন্ডন শহর, তা আমাদের চেনাশোনা গণ্ডির এতটাই বাইরে যে মনে হয় বিদেশি কোনো উপন্যাস পড়ছি। ব্রিটিশ চরিত্রগুলো এত নিখুঁতভাবে অঙ্কিত যে তা একমাত্র পশ্চিমা লেখকদের পক্ষেই জানা সম্ভব। এভাবে মাসরুর কি উপন্যাসের বিশ্বায়ন ঘটানোর সম্ভাবনা জাগানোর সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি পাঠক থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছেন তাঁর বিষয়কে? উপন্যাসের ভেতর পোস্টারের বাণী, চুক্তিপত্রের ধারা ছাপানো অভিনব, প্রবহমান গদ্যের ভেতর তারা কঠিন সব প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়, তবে বৈচিত্র্য আনে নিঃসন্দেহে। পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে লেখকের পঠন-পাঠন বিস্ময়কর। ‘এক্সটিংশন রেবেলিয়ন’-এর মঞ্চে তাঁর পরিবেশসংক্রান্ত বক্তৃতা কেবল কৌতূহলোদ্দীপক নয়, জ্ঞানগর্ভ। ব্রিটিশ চরিত্রদের বেশ ভালোই অধ্যয়ন করেছেন তিনি, তাঁর লেখায় প্রবলভাবে ফুটে থাকে যৌন অবদমন, ফ্রয়েড থাকেন আলথুসারের সমান্তরাল। এসব ক্ষেত্রে মাসরুর খুবই আধুনিক, বলা যায় পাশ্চাত্যের ঘরানার। ভাবি, এসব তাকে বিযুক্ত করে নিয়ে যায় কি না উপন্যাসের এমন এক জগতে, যে জগৎটি বাংলার পাঠকের কাছে ভিনদেশ। এই যে প্রতিদিন লাখ লাখ কলকারখানার ধোঁয়া উড়িয়ে, কোটি কোটি যানবাহনের তেল পুড়িয়ে আমরা বাতাসে ছেড়ে দিচ্ছি লাখ লাখ টন কার্বন, যা উষ্ণ করে তুলছে পৃথিবীর তাপমাত্রা, যার প্রভাবে গলছে মেরু অঞ্চলের বরফ, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, যাকে আমরা বলি গ্রিনহাউস ইফেক্ট, বনজঙ্গল ধ্বংস আর জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলা সেই বিপন্ন পৃথিবীকে রক্ষা করতে সচেতন হচ্ছে মানুষ। ‘আলথুসার’ উপন্যাসে এই পরিবেশ বিপর্যয়ের তথ্যগত ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও মেলে, সেখানে আটলান্টিকে তিমি শিকার থেকে সুন্দরবন—সব চলে আসে।
চরিত্রগুলোর মিথস্ক্রিয়ার মধ্যেই মাসরুরের কলমে ঝরনাধারার মতোই বেরিয়ে আসে প্রকৃতি বর্ণনার অনুপম গদ্য, যা একান্তই মাসরুরীয়। মনে হয়, এও এক অবসেশন মাসরুরের, তিনি তখন সেই গদ্যের মোহে উপন্যাসের কনটেক্সটকেও কিছুক্ষণ ভুলে থাকেন। তাকে উদ্ধার করে পরাবাস্তবতা। টাইম মেশিনে চড়ে এক লহমায় লন্ডনের হাইড পার্কের ভেতরকার সার্পেন্টাইন হ্রদের বৃক্ষাবলির জগৎ ছেড়ে চলে আসেন বরিশালের মিশন রোডে, জীবনানন্দ দাশের বাড়িতে। তাঁর উপন্যাসে কেবল বিলুপ্তপ্রায় ধূসররঙা তিমি নয়, কথা বলে ওঠে বিড়াল (যেন চেশায়ার ক্যাট) ও কুকুর। মাত্র দুদিনের ঘটনা নিয়ে ৩৮৪ পৃষ্ঠা লিখে ফেলার পর ঔপন্যাসিক শেষ অধ্যায়টি রেখে দেন তাঁর বাড়ি ফেরার কাহিনি বর্ণনের জন্য। বস্তুত, আমি ভাবছিলাম তিনি কীভাবে এই পরিবেশবাদী আন্দোলনকে ঘিরে মার্ক্সবাদী তত্ত্বের ডিসকোর্স উদ্ঘাটিত উপন্যাসটি শেষ করবেন। লেখককে, এখানে এসে মনে হলো, পথ হারানো পথিক।
‘আলথুসার’ উপন্যাসটির বিষয়বস্তু, ভাষা, ট্রিটমেন্ট—সবই জটিল। উপন্যাসের ভেতর যাঁরা প্রেম–পরিণয়–বিরহ খোঁজেন, তাঁরা হতাশ হবেন। যাঁরা তরল ও সরল গদ্য পড়ে পড়ে ভেবেছেন উপন্যাস বুঝি কিছু খুচরো সংলাপ আর পরিচিত চরিত্রের হাসি–ঠাট্টা–মশকরা, তাঁরা মাসরুরের চৌকাঠে এসে হোঁচট খাবেন। মাসরুরের গদ্য এক স্লিপওয়াকারের মতো মাতাল—ঘুরে বেড়ায়, আবার এক প্রবল যুক্তিবাদীর মতো তত্ত্বের দুনিয়ায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টে যায়। তার গদ্য জটিল ও প্রবহমান, নেশা–জাগানিয়া ও নস্টালজিক। বস্তুত, মাসরুরের এই উপন্যাস ঘোষণা করল নতুন ধরনের উপন্যাসও লেখা হচ্ছে বাংলাদেশে। সমকালীন বাংলা উপন্যাসে ‘আলথুসার’-এর মতো এমন বই আগে আসেনি। এর বিষয়বস্তু অভিনব ও বৈশ্বিক, ভাষা কাব্যিক ও গতিময়, প্লট জটিল এবং ডিসকোর্সটি বুদ্ধিবৃত্তিক। সুতরাং ‘আলথুসার’কে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলা যায়।
সব মিলিয়ে মাসরুর আরেফিনের ‘আলথুসার’ আমার জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে এর তুলনা আছে কি না জানি না, থাকলেও স্বল্প। ‘আলথুসার’, এককথায়, একটি মাস্টারপিস!