বইটি আগাগোড়া পড়ে আফসোসের কথাটাই বলতে হচ্ছে সবার আগে। একেবারে কোনো রকম ভণিতা না করেই বলছি, এই বইয়ের প্রতিটি লেখাই হতে পারত আরও অনেক বড়। আরও অনেক কিছু জানার ছিল পাঠকের। কিন্তু স্মরণ ও বরণ নামের বইটিতে আনিসুজ্জামান যেন একেক আঁচড়ে একেকজন মানুষকে এঁকেছেন। একটানের স্কেচই, কিন্তু হতে পারত একেকটি পূর্ণাঙ্গ তৈলচিত্র বা জলরঙের সমাহার।
পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, অনেকগুলো লেখাই বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে কিংবা কোনো উপলক্ষে লেখা। ফলে যাঁদের নিয়ে লেখা হচ্ছে, তাঁদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ থাকছে প্রবল, কিন্তু বলা হচ্ছে একেবারেই মেপে মেপে। অবশ্য আনিসুজ্জামানের লেখালেখির সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা জানেন, তিনি বাড়তি বলা–কওয়া বা লেখার মানুষ নন, সে কারণেই এতক্ষণ যে আক্ষেপের কথা বলা হলো, সেগুলো নিয়ে না ভেবে বইয়ের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করাই মঙ্গলকর।
স্মরণ ও বরণ নামের বইটিতে স্বাভাবিকভাবেই এর এই দুটি অংশের প্রথমটিতে রয়েছে কারও স্মরণে লেখা; দ্বিতীয়টিতে যাঁদের বরণ করে নেওয়া হলো, তাঁদের নিয়ে লেখা। ‘স্মরণ’ অংশে ৩৩টি প্রবন্ধ, ‘বরণ’–এ কিছু কম, ১২টি। প্রথম অংশের কেউ বেঁচে নেই, দ্বিতীয় অংশের লোকেরা এখনো বেঁচে আছেন। যাঁদের নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন আনিসুজ্জামান, তাঁদের মধ্যে আছেন দানবীর, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কবি–সাহিত্যিক, সাংবাদিক। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রণদাপ্রসাদ সাহা, আবুল হাশিম যেমন আছেন, তেমনি আছেন মনীরউদ্দীন ইউসুফ, মহিউদ্দীন আহমদ। বরণীয় অংশে আহমদ রফিক, আবুল মাল আবদুল মুহিত, শেখ হাসিনা, রামেন্দু মজুমদার, আসাদুজ্জামান নূর, শামসুজ্জামান খান, ইমদাদুল হক মিলন প্রমুখকে নিয়ে লিখেছেন তিনি।
যে বিষয়গুলো নিয়ে ঔৎসুক্য জাগে মনে, তারই কিছু আলোচনা করা যাক। জাহানারা ইমামকে নিয়ে তাঁর লেখাটিতে একজন মানুষের ব্যাপারে অনেক খুঁটিনাটি তথ্য যুক্ত করতে গিয়ে তিনি একটি পরিবার এবং তারই পথ ধরে একটি রাষ্ট্রের কিছু মানুষের এক অসমসাহসী পদক্ষেপের বর্ণনা করেছেন। পুরো দেশের মানুষ যখন ঘাতক–দালালদের বিচারের ব্যাপারে আশাহীন হয়ে উঠেছিল, তখনই জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সংঘটিত সেই আন্দোলনের কথা বিশদভাবেই এসেছে এ লেখায়। আহমদ পাবলিশিং হাউজের মহিউদ্দীন আহমদকে নিয়ে লেখাটি একটু অন্য রকম। মহিউদ্দীন সাহেবের শরাফতি, তাঁর বিনয় তাঁকে বিশিষ্ট করেছিল। মুনীর চৌধুরীর রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকের দ্বিতীয় মুদ্রণ থেকে ছাপতেন মহিউদ্দীন আহমদ। উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির পাঠ্য হওয়ায় বইটি খুব বিক্রি হতো। প্রতিবছর ঠিকঠাক হিসাব করে একটি খামে মুনীর চৌধুরীর হাতে তিনি তুলে দিতেন একটি করে চেক। মুনীর চৌধুরী শহীদ হওয়ার পর লিলি চৌধুরীর হাতেও তিনি পৌঁছে দিয়েছেন চেক। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে নিয়ে লেখাটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। ভাষা আন্দোলনে যুক্ততার কারণে কারাবাস হয়েছিল বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য নিযুক্ত ইতিহাসের অধ্যাপক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নিয়োগ বাতিল হয়ে যায়। এরপর বুকে ট্রে লাগিয়ে চা–সিগারেট বিক্রেতা বনে যাওয়া থেকে শুরু করে বেশ কিছু মজার ঘটনা উল্লেখ করেছেন আনিসুজ্জামান এবং তারপর এ মানুষটির অর্জনগুলো নিয়ে কথা বলেছেন। হাবিবুর রহমানের রবীন্দ্রসাধনা, দেশভাবনা ইত্যাদি উঠে এসেছে সাবলীলভাবে।
বলা যায়, যাঁদের কথা বলা হলো এ বইতে, তাঁদের সম্পর্কে এখান থেকে কিছু কিছু তথ্য জানার পর বর্ণিত ব্যক্তিত্বদের ব্যাপারে আরও বেশি আগ্রহ জাগবে। ফলে এই মনীষীদের নিয়ে নতুন নতুন বই পড়ার দিকে মন দেবেন পাঠক। আর আনিসুজ্জামানের বৈশিষ্ট্য যে অল্প কথায় অনেক কিছু বলে দেওয়া, সেটাও পাঠক বুঝে ফেলবেন নিমেষে। বইটির বহুল প্রচার কামনা করি।