অবরুদ্ধ সময়ের রাজনীতির নিবিড় আখ্যান

কলকাতায় হো চি মিনের সঙ্গে করমর্দনরত কামরুদ্দীন আহমদ। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন চিফ সেক্রেটারি এস এন রে। ছবি: সংগৃহীত
কলকাতায় হো চি মিনের সঙ্গে করমর্দনরত কামরুদ্দীন আহমদ। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন চিফ সেক্রেটারি এস এন রে। ছবি: সংগৃহীত

বর্ণিল জীবনের অধিকারী কামরুদ্দীন আহমদ (১৯১২—৮২) বর্তমান প্রজন্মের কাছে প্রায় বিস্মৃত এক নাম হলেও বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করতে গেলে তাঁর লেখনিজাত অভিজ্ঞতার আশ্রয় আমাদের নিতেই হবে। আলোচনায় প্রবেশের আগে তাঁর জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণের দিকে চোখ বোলানো যাক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, ঢাকার আরমানিটোলা বিদ্যালয়ে কিছুকাল শিক্ষকতা, পরে যোগদান করেন আইন পেশায়।

কামরুদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয় পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনা থেকে একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে। মুসলিম লীগের রাজনীতির মোহাচ্ছন্নতা কেটে গেলে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ‘গণআজাদী লীগ’ নামের রাজনৈতিক দল গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য। ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। পালন করেন যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে সবিশেষ ভূমিকা। যুক্তফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের মদদে সেই ফ্রন্টের ভাঙা–গড়া, কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, চক্রান্ত ইত্যাদির তিনি ছিলেন কোনো না কোনোভাবে প্রত্যক্ষ সাক্ষী।

তিনি কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করেন ভারতের কলকাতা ও রেঙ্গুনে। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেমন ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের টানাপোড়েন, তেমনি সমকালীন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। এ সবই এসেছে কামরুদ্দীন আহমদের আলোচ্য আত্মভাষ্যমূলক গ্রন্থ বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনীতে

বইয়ের ভূমিকায় কামরুদ্দীন আহমদ আমাদের জানিয়েছেন, ‘১৯৫৩ সাল পর্যন্ত আমার অভিজ্ঞতার কথা পূর্বপ্রকাশিত বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ-এ বলা হয়েছে—বাকি অভিজ্ঞতার কথা এই পুস্তকে লিপিবদ্ধ করে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠল না। কূটনৈতিক জীবন থেকে ১৯৬১ সালে অবসর গ্রহণ করা পর্যন্ত তাই এ বইয়ের সমাপ্তি।’

বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী কামরুদ্দীন আহমদ প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০১৮, ৪৫৬ পৃষ্ঠা, দাম: ৭৫০ টাকা।

সব সমাপ্তিই সমাপ্তি নয়। কামরুদ্দীন আহমদ বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনীর সাতটি অধ্যায়ের উপ-অধ্যায়গুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্র রক্ষা করেছেন। ফলে বইটিতে পাওয়া যায় সেই সময়ের রাজনীতির একটি অখণ্ড ছবি। লেখক এখানে আত্মকথনের মধ্য দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের শুরু থেকে ষাটের দশকের প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত ঐতিহাসিক সময়পর্বে সংঘটিত রাজনৈতিক ঘটনাধারা বর্ণনা করেছেন। আর এসব ঘটনায় তাঁর নিজের অংশগ্রহণ এবং ভবিষ্যতে যাঁরা এ দেশের রাজনীতির মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠবেন, তাঁদের পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানি পাঞ্জাবি শাসকদের শোষণের চিত্রও তিনি এঁকেছেন বিশ্বস্ততার সঙ্গে।

কামরুদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের সবচেয়ে কঠিন বাঁকফেরা সময়ের কেবল সাক্ষী ছিলেন না, ছিলেন আত্মনিবেদিত সক্রিয়তাবাদীও। দেখেছেন নিবিড়ভাবে শেরেবাংলা একে ফজলুল হককে, মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানকে। এই নেতারা তখন রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে যেসব ঘটনার শিকার হয়েছেন, তার এত অনুপুঙ্খ বিবরণ আর কোনো বইয়ে পাওয়া যায় না। যেমন বগুড়ার চৌধুরী মোহাম্মদ আলী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন তিনি রাজনৈতিক দাবা খেলা শুরু করলেন। তাঁর সেই দাবা খেলায় এখানকার নেতৃস্থানীয়দের কম দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। আবার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর ইস্কান্দার মির্জা সে সময় যে ষড়যন্ত্র করেছিলেন, সেটির বিশদ বিবরণও রয়েছে এখানে।

এ বইয়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অধ্যায় রেঙ্গুনে তাঁর অতিবাহিত কূটনৈতিক জীবন। সেই জীবনে তিনি দেশটির জীবনযাত্রাকে প্রত্যক্ষ করেছেন গভীরভাবে। সেসব এখানে লেখা হয়েছে বিস্তারিতভাবে। আবার কলকাতায় অতিবাহিত তাঁর কূটনৈতিক জীবনের যে বিবরণ তুলে ধরেছেন, তা-ও মনকে আলোড়িত করে। এখানে থাকতে বিপদগ্রস্ত লায়লা সামাদের ব্যাপারে তিনি যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, তাতে কামরুদ্দীন আহমদের প্রতি আমাদের মন শ্রদ্ধায় অবনত হতে বাধ্য।

এ বই রাজনৈতিক ও সমাজ বিষয়ে গবেষকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য।