কুড়িগ্রামে যেভাবে জোরদার হচ্ছে বই পড়া আন্দোলন

কুড়িগ্রামে রাষ্ট্রালাপ পাঠচক্র আয়োজিত বই নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন কবি-লেখক সোহরাব হাসান। পাশে বসে আছেন নাহিদ হাসান, সফি খান ও মহিউদ্দিন আহমদ
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহীর পলান সরকার হেঁটে হেঁটে মানুষের বাড়িতে বই বিলি করতেন। একটি বই পড়া শেষ হলে আরেকটি বই দিয়ে আগেরটি ফেরত নিতেন। বাংলাদেশে বই পড়া আন্দোলনে পলান সরকার ছিলেন ধ্রুবতারা। তাঁকে নিয়ে প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’ ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রচ্ছদ করেছিল—‘বিনি পয়সায় বই বিলাই’।

তরুণদের বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করতে গত বছর যশোরে গড়ে ওঠে ‘সপ্তাহে একটি বই পড়ি’ নামে একটি সংগঠন। এ সংগঠনের নিয়মিত বই পড়া সদস্য আছেন ২০ জন। প্রতি মাসের চার সপ্তাহে ৪ ধরনের ৮০টি বই কিনে সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পড়া শেষ হলে সেগুলো আবার ফেরত নেওয়া হয়। এর উদ্যোক্তা যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহজাহান কবীর।

কুড়িগ্রামে বই পড়া আন্দোলনে আরেকটি উদ্যোগের সঙ্গে সম্প্রতি আমরা পরিচিত হলাম। সংগঠনটির নাম ‘রাষ্ট্রালাপ পাঠচক্র’। রাষ্ট্রের সঙ্গে সংলাপ কিংবা রাষ্ট্রকে নিয়ে সংলাপ। দুটোই হতে পারে। রাষ্ট্র মানে সরকার বা প্রশাসন নয়। রাষ্ট্র মানে ১৭ কোটি মানুষ; তাদের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা। এই পাঠচক্রের মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে জোরদার হচ্ছে কুড়িগ্রামের বই পড়া অন্দোলন।

প্রসঙ্গত বলা দরকার, এই কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে ‘প্রথম আলোর চর’। ২০০৮ সালে প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আলোর পাঠশালা’।

রাষ্ট্রালাপ পাঠচক্রের উদ্যোক্তা নাহিদ হাসান একজন শিক্ষক ও মানবাধিকারকর্মী। তাঁর সঙ্গে আছেন একদল উদ্যমী মানুষ। পেশায় কেউ আইনজীবী, কেউ সাংবাদিক, কেউ প্রকৌশলী। গত ২৬ মে রাষ্ট্রালাপ পাঠচক্রের আয়োজন ছিল জনপ্রিয় লেখক মহিউদ্দিন আহমদের বই ‘জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ নিয়ে। স্থান কুড়িগ্রাম কলেজ মোড়ে অবস্থিত সাধারণ পাঠাগার ভবন।

বিকেল সাড়ে চারটায় যেতেই দেখি মিলনায়তনের বাইরের বারান্দায় প্রথম আলোর রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ইমরান আলী প্রথমার বই সাজিয়ে বসেছেন। সেখানে মূলত ছিল মহিউদ্দিন আহমদের বই। সেই সঙ্গে এই লেখকেরও দুটি বই ছিল। এক-দুজন করে পাঠচক্রের সদস্যেরা আসছেন। বই দেখছেন। লেখকের সঙ্গে আলাপ করছেন। পছন্দের বইটি বেছে নিয়ে লেখকের অটোগ্রাফ নিচ্ছেন।

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত মহিউদ্দিন আহমদের ‘জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ বইয়ের প্রচ্ছদ

বিকেল পাঁচটা নাগাদ আলোচনা অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রথম দিকে দর্শক-শ্রোতা কম থাকলেও পরে মিলনায়তনটি ভরে যায়। মূল আলোচনার আগে পাঠকের অনুভূতি জানান কয়েক তরুণ পাঠক। পাঠচক্রের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নাহিদ হাসান বলেছেন, ‘তরুণেরা পাঠবিমুখ বলে যে অপবাদ আছে, আমরা সেটা ঘুচাতে চাই। বই পড়ায় আগ্রহ তৈরির মাধ্যমে তারাও দেশ ও সমাজ সম্পর্কে জানতে পারবে।’

মাইদুল ইসলামের উপস্থাপনায় গত শুক্রবারের আয়োজনে কথা বলেন লেখক মহিউদ্দিন আহমদ, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি সফি খান, কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আহসান হাবীব, নাহিদ হাসান, খন্দকার আরিফ হামিদুল ইসলাম, মিজানুর রহমান ও আর্নিকা খাতুন।

মহিউদ্দিন আহমদের ‘জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’তে কেবল একটি দলের ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি, উঠে এসেছে ষাট ও সত্তরের দশকের রাজনীতির নানা বাঁকবদল। স্বাধীনতার আগে থেকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে বিভিন্ন ধারা ছিল, যা দলকে পরে আনুষ্ঠানিক বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়। জাসদ নামে নতুন দল গঠিত হয়।

মহিউদ্দিন আহমদের ‘জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’তে কেবল একটি দলের ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি, উঠে এসেছে ষাট ও সত্তরের দশকের রাজনীতির নানা বাঁকবদল। স্বাধীনতার আগে থেকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে বিভিন্ন ধারা ছিল, যা দলকে পরে আনুষ্ঠানিক বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়। জাসদ নামে নতুন দল গঠিত হয়।

রাষ্ট্রালাপ পাঠচক্র কেবল কুড়িগ্রাম শহরেই পাঠচক্রটি সীমিত রাখেনি, যুক্ত করেছে চিলমারীর প্রান্তিক অঞ্চলের তরুণদেরও। এই পাঠচক্রে যে অভিভাবকেরা এসেছেন, তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। জানালেন, তাঁরা চান সন্তানেরা পরীক্ষায় ভালো করার পাশাপাশি বাইরের দুনিয়াটাও জানুক। আলোর মশাল যেমন একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাতে চলে যায়, তেমনি জ্ঞানতৃষ্ণাও এক পাঠক থেকে আরেক পাঠকে ছড়িয়ে দিতে চায় রাষ্ট্রালাপ পাঠচক্র।

অনুষ্ঠানে আসা দর্শকদের একাংশ

সংগঠনটি এর আগে যে পাঁচ বই নিয়ে আলোচনা করেছে, সেগুলো হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, আহমদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’, নাদেজা স্কৃপস্কায়ার ‘কীভাবে পড়িতে হইবে’, ইয়ুভাল নোয়াহ হারারির ‘স্যাপিয়েন্স’, মনিরুল ইসলামের ‘নারী-পুরুষের বৈষম্যের উৎস’, আসিফ নজরুলের ‘মানবাধিকার’।

বইয়ের তালিকা দেখেই উদ্যোক্তাদের মুক্ত ও উদার মনের পরিচয় পাওয়া যায়। একসময় রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনগুলোর উদ্যোগে যেসব পাঠচক্র হতো, তাতে নির্দিষ্ট মতের বা ঘরানার বই নিয়েই আলোচনা হতো। অন্য মতের বই নিয়ে আলোচনা হতো না।

রাষ্ট্রালাপ পাঠচক্র সেই বৃত্ত ভেঙে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিচিত্র বিষয়ে জ্ঞানতৃষ্ণা জাগানোর চেষ্টা করছে। সংগঠনের একজন উদ্যোক্তা জানান, তাঁদের কার্যক্রমের আওতায় মোট ২০টি বই পড়া হবে। ২০ জন চিন্তক বইগুলোর ওপর আলোচনা করবেন। প্রতিটি পাঠচক্রে ২০ জন তরুণ অংশ নেবেন। পাঠচক্রে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি তাঁরা ফেসবুকেও তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানান। মাসের প্রথমে আলোচ্য বইটি তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় এবং মাসের শেষ শুক্রবার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

ওই উদ্যোক্তা জানান, তাঁদের সংগঠনটি এখনো অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নয়। অনেক লেখক-শুভানুধ্যায়ী বই কিনে দেন। ফলে তাঁদের পক্ষে কাজটি করা সহজ হয়েছে। বইয়ের প্রতি তরুণদের আগ্রহ বাড়াতে এ রকম উদ্যোগ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ুক।