২৮ নভেম্বর শিল্পী রফিকুন নবীর ৮০তম জন্মদিন। আলোচিত কার্টুন চরিত্র ‘টোকাই’–এর স্রষ্টা হিসেবে রনবী হিসেবেও খ্যাতিমান তিনি। এই শিল্পীর জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও গ্যালারি চিত্রকে চলছে তাঁর ছবির আনুপূর্বিক প্রদর্শনী। নিজের ছবি আঁকা, কার্টুন—সব মিলিয়ে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন সিলভিয়া নাজনীন
সিলভিয়া নাজনীন: স্যার, আপনার শৈশব থেকেই শুরু করতে চাই। আপনার বেড়ে ওঠা তো পুরান ঢাকায়?
রফিকুন নবী: পুরান ঢাকা—এখানে ‘পুরান’ কথাটা না হলেও চলে। নতুন দিল্লি, পুরান দিল্লি—এ রকম একটা ভাবনা থেকে পুরান ঢাকা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমি বলি যে ওটাই ঢাকা। আমার জীবনের মৌলিক যে অভিজ্ঞতা, সেটা অর্জন হয়েছে এখান থেকে। আমি যে পোগোজ স্কুলে ভর্তি হলাম, স্কুলের দিনগুলো থেকেই আমার এই ঢাকাকে দেখার শুরু। এখন এই যে দূরে থাকি, মানে ‘নতুন ঢাকা’য় থাকি, দূরে থাকার ফলে মনে হয় ওই ঢাকাটা সত্যিই অন্য রকম ছিল। অনেক কিছু ছিল। তখন অতটা বুঝিনি। আমি টোকাই আঁকলাম, পথশিশুদের নিয়ে কাজ করেছি, নানা কিছু করেছি। বলতে দ্বিধা নেই, একেবারে ছোটবেলায় যখন প্রাইমারিতে পড়তাম, তখন পথশিশুরা আমার বন্ধু ছিল। তাদের সঙ্গে মেলামেশা, খেলাধুলা করেছি। তারা অনেক বুদ্ধিমান ছিল, তাদের বুদ্ধির একটা নির্যাস আমার মধ্যে থেকে গিয়েছিল।
সিলভিয়া: আপনার ছবি আঁকতে আসার পেছনে আপনার বাবার ইচ্ছা একটা বড় ব্যাপার ছিল বলে শুনেছি।
গ্রাম–শহর দুই জায়গাতেই আমি ছিলাম। গ্রামের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি, শিখেছি শহর থেকেও। এই দুই মিলিয়েই আমার ছবি।রফিকুন নবী
রনবী: সবাই জানে, আমার ছবি আঁকার পেছনের অনুপ্রেরণা আমার বাবা। তিনি নিজে ছবি আঁকতেন, যদিও পুলিশে চাকরি করতেন। পুলিশে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে বলতেন, এই ছবি আঁকা মানুষ পুলিশে মানায় না। আমার জীবনে বাবার অবদানটা অনেক বড়। তাঁর অবদানের সূত্র ধরেই হয়তো আমার জীবনে কখনোই কিছু ঠেকে থাকেনি। আর আমার আর্ট কলেজে ভর্তির ব্যাপারে আমি কিছুই বলিনি। বাবাই সব ঠিকঠাক করে বলে দিলেন, ‘তুই আর্ট কলেজে ভর্তি হবি।’
সিলভিয়া: পরে তো আর্ট কলেজের মাস্টারও হলেন…
রনবী: আমি কোনো দিন মাস্টার হতে চাইনি। আমার যখন রেজাল্ট বের হলো, ভালো রেজাল্ট দেখে আবেদিন স্যার আমাকে ডেকে বললেন, তুমি সোমবার থেকে ক্লাস করাবে। ব্যাপারগুলো আপনাআপনিই হয়েছে। এমনকি আমার বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারটাও, আমি কখনোই স্কলারশিপের চেষ্টা করতাম না। স্বাধীনতার পর বাহাত্তর সালে, হঠাৎই একটা মিটিং হলো চারুকলায়, শিক্ষকদের কক্ষে ডেকে পাঠানো হলো আমাকে। আমি তখন তরুণ শিক্ষক। গেলাম। জানলাম, গ্রিস সরকারের একটা স্কলারশিপ এসেছে। আজই চারুকলা থেকে একটা সিলেকশন দিতে হবে। কাইয়ুম স্যার থেকে শুরু করে হাশেম স্যার—যাঁরা তখনো বিদেশে যাননি, কেউই গ্রিসে যেতে রাজি নন। আর আমার তখন একেবারে নতুন সংসার, আমার যাওয়ার কোনো ইচ্ছাও নেই। এসব নিয়ে কোনো ভাবনাও নেই। তা ছাড়া এখানকার বইয়ের বাজার ও পত্রপত্রিকায় সে সময় আমার নাম প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, ভালো একটা অবস্থান তৈরি হচ্ছে। সব মিলিয়ে বললাম যে, আমি যাব না। কিন্তু ওই যে অটোমেটিক—আগে থেকেই যেন সব ঠিক হয়ে আছে। তখন স্যাররা আমাকে পটিয়ে-ফটিয়ে রাজি করিয়ে ফেললেন। জীবনে আমি কখনো কাউকে বলিনি, ভাই, ছবি-টবি কেনো বা পত্রপত্রিকাগুলোকেও কখনো বলিনি, আমাকে একটু কার্টুন করার সুযোগ দাও। সব নিজেই এসেছে।
সিলভিয়া: চারুকলায় দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা করেছেন। এই জীবনটা নিয়ে কিছু শুনতে চাই।
রনবী: আবেদিন স্যারের হুকুমে আমি শিক্ষকতায় ঢুকেছিলাম। স্যার বলেছিলেন, ভালো না লাগলে ছেড়ে দিয়ো। এটা কোনো জোরাজুরির ব্যাপার না। আর পয়সাটাও বড় কথা নয়। ইত্যাদি বলে তিনি আমাকে ঢোকালেন। কিন্তু আমি ওই যে ঢুকলাম, ধীরে ধীরে এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম যে বাইরের বিভিন্ন তৎপরতার সঙ্গে থাকলেও এটাকে আর ছাড়তে পারিনি। এই যে শিক্ষকতা—এর একটা আলাদা ব্যাপার আছে। চারুকলার যে পরিবেশ, তার সঙ্গে সম্পৃক্ততার একটা আলাদা গুণ আছে। এখনো আমি ছাত্রদের বলি, দেখো চারুকলায় ভর্তি হয়েছ, ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলে মানে সারা বিশ্বের শিল্পকলার সঙ্গে একটা সম্পৃক্ততা হয়ে গেল।
যাহোক, শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গেলে বলব, এটা একটা যাত্রা। ছাত্রদের সঙ্গে বসা, কথা বলা, তাদের গতিপ্রকৃতি দেখা এবং নিয়ে ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তা করা—এই সব। একদিকে আমাদের শিল্পীজীবন, আরেক দিকে শিক্ষকতা। শিল্পকলা নিয়ে কাজ করছি বলে সেটা শেখার একটা চেষ্টাও থাকে। এর মধ্যে একটা মজা আছে। অন্য শিক্ষকদের মতো আমিও মজাটা পেয়েছি। তবে সবই যে ভালো তা বলব না, মন্দ দিকও আছে। সব ছাত্রের প্রিয়ভাজন হওয়া কখনো সম্ভব নয়। একইভাবে সব সহকর্মী যে একেবারে সব সময় বন্ধুভাবাপন্ন থাকবে, সেটাও নয়। সবকিছু মিলিয়েই আমাদের শিক্ষক-জীবন।
সিলভিয়া: বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও গ্যালারি চিত্রকে এখন আপনার ছবির আনুপূর্বিক প্রদর্শনী চলছে। সেই প্রদর্শনী দেখে একটা বিষয় মনে হলো, প্রায় সময়ই আপনার ছবিতে পরিবার বিষয় হয়ে আসে। সাংসারিক ঘরোয়া ব্যাপারগুলো কি আপনার কাছে বিশেষভাবে ধরা দেয়?
রনবী: পরিবার নিয়ে আমার অনেক কাজ আছে। এখনো মনে হয়, আবার পরিবার নিয়ে কাজ করি। পরিবারে একটা বাঁধন থাকে। বাচ্চারা যেভাবে মায়ের ওপরে ভরসা করে তাকে ঘিরে থাকে—ব্যাপারগুলো ছবিতে আমি আনি। আসলে ছবির অ্যারেঞ্জমেন্ট, ফিগার—এগুলো বড় কিছু নয়, ফিগার হলো অনুষঙ্গ। আমি মনে করি, সাজানোটাই আমার ছবির প্রধান ব্যাপার। একটা বাঁধন বা বিষয়কে মাঝখানে রাখা হলো, তারপর চারদিকে অন্য ফর্মগুলো ছড়িয়ে দিলাম। সেই ছড়ানো ফর্মগুলো ঘরের সাজেশন দিতে পারে বা নিছক রঙের সাজেশন। মূল বিষয় হলো, মাঝখানে যে বিষয়টা দাঁড়াল, সেটাই। সবার সঙ্গে সবাই জড়ানো। এভাবে আমার ছবিতে বারবারই পরিবার এসেছে।
সিলভিয়া: আপনার ছবিতে যে মানুষ বা পরিবারগুলো দেখি, তারা নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণির প্রতিনিধি?
রনবী: আমার এমন মনে হয় না। পশুপাখিদের তো আর শ্রেণির ব্যাপার থাকে না, যখন মানুষ নিয়ে কাজ করি, তখন মোটামুটি নিজের একেবারে পরিচিত যে অবস্থাগুলো, সেসবই আনার চেষ্টা করি। গ্রাম–শহর দুই জায়গাতেই আমি ছিলাম। গ্রামের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি, শিখেছি শহর থেকেও। এই দুই মিলিয়েই আমার ছবি।
তারপর এর সঙ্গে আছে আমার চারদিকের দেখা। রং নিয়ে এত বছর ধরে কাজ করে করে রঙের মধ্যেও যে নানান চরিত্র, সেসবও আমার ছবিকে নানা দিকে নিয়ে যায়। এভাবে এগোতে এগোতে ছবির বিষয় আর শ্রেণিতে থাকে না। তবে উচ্চবিত্ত, হাইফাই শ্রেণি, বিশাল গাড়িতে করে যাচ্ছে, খুব অভিজাত, মডেল মডেল ভাব নিয়ে বসে আছে—এগুলো আমার ছবিতে ঠিক আসে না। কারও ছবিতেই হয়তো আসে না। অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় বটে, অনেক ছবি আছে সমালোচনাধর্মী। ওপর মহলকে রিডিকিউল বা ব্যঙ্গ করতে অনেক সময় অনেকে এসব কাজ করে। তা তো আমি কখনো করিনি, অনভ্যাস বলা যেতে পারে। তবে এটা আমি করি কার্টুনে। ছবি যখন আঁকি, তখন স্বাধীনতার একটা ব্যাপার আছে, যা খুশি তা–ই। সে ক্ষেত্রে আমার ছবিতে শ্রেণি নয়, বিষয়ের স্বাধীনতাটাই উপভোগ করি।
সিলভিয়া: আপনি কার্টুন করার তাগিদ অনুভব করলেন ঠিক কী কারণে? ‘টোকাই’ কার্টুন সিরিজ করার পেছনের গল্পটা বলবেন কি?
রনবী: ষাটের দশকে পোস্টার আঁকতাম। ওখান থেকে কার্টুনের একটা প্র্যাকটিস চলে এসেছিল। সেটা পোস্টারের জন্য বা সাধারণ ফেস্টুনের জন্য কার্টুন। পরে ষাট দশকের শেষের দিকে, ড. রেহমান সোবহান, ড. কামাল হোসেন, হামিদা হোসেন, ফোরাম নামে তাঁরা একটা ইংরেজি পত্রিকা বের করতেন। আবেদিন স্যার আমাকে বললেন, ‘তুমি একটু যাও, ওনাদের কার্টুন এঁকে দিয়ে সহায়তা করো।’ আবেদিন স্যার যেহেতু আমাকে কার্টুন করতে বললেন, তার মানে আমি কার্টুন করতে পারব—এই ধারণা তিনি পোষণ করেছিলেন। ব্যাপারটা আমাকে খুব আন্দোলিত করল। তো সেসব কার্টুন ছিল তখনকার রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের অবস্থা নিয়ে। রাজনৈতিক কার্টুন।
স্বাধীনতার কিছুদিন পরে আমি চলে গেলাম দেশের বাইরে। বিদেশ থেকে ফিরলাম ১৯৭৬ সালে। তত দিনে দেশের রাজনীতি একেবারে বদলে গেছে। সপরিবার বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর রাজনৈতিকভাবে সবকিছু সম্পূর্ণ উল্টে যাওয়া যাকে বলে। এদিকে তখন আমার আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। আমার বন্ধু শাহাদাত চৌধুরী ছিলেন বিচিত্রা সম্পাদক। তিনি একদিন বললেন, ‘একটা কাজ করো, আমাদের পত্রিকায় কার্টুন আঁকা শুরু করো।’ আমার তো প্র্যাকটিস-ফ্যাকটিস নেই বহুদিন। তিনি বললেন, ‘তবু দেখো, যদি কিছু করতে চাও, করতে পারো।’ তখনকার সমাজ, রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক পরিবেশ—সবকিছু ভেবে হুট করেই আমার মনে হলো, স্বাধীনতার আগে ছোট্ট একটা ছেলেকে দিয়ে কোনো নাম না দিয়ে ক্যারেক্টারের মতো করে কিছু কার্টুন করতাম, মনে হলো যে ওটাই আবার শুরু করি, কিন্তু এবার নাম দিয়ে শুরু করি। তখন তো ওইভাবে কথা বলার অবস্থা ছিল না। এই একটা পথ মাথায় এল, ক্যারেক্টারের নাম দিলাম ‘টোকাই’। ছোট মুখে বড় বড় কথা বলবে, কখনো রাজনীতি, কখনো অর্থনীতি—নানান ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে কথা হবে, পরিবেশ নিয়েও কথা হবে। একেবারে মশা-মাছি থেকে শুরু করে সভা-সমাবেশের বক্তব্য সবই থাকবে। এইভাবে শুরু করলাম। দেখলাম, পাঠক খুব ভালোভাবে নিয়েছে। একপর্যায়ে এটাকে বন্ধ করার আর কোনো উপায় থাকল না। কাজটা করে বিস্তর মজাও পাচ্ছিলাম।
সিলভিয়া: আপনার ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে সম্প্রতি আপনার জীবনের সব কার্টুন নিয়ে বই বের হয়েছে। তাতে কার্টুনশিল্পের সঙ্গে আপনার সংযোগের ইতিহাসটা নিবিড়ভাবে ধরা যায়। মোটাদাগে, কার্টুন শিল্পটাকে নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই, এই সময়ের তরুণ কার্টুনিস্টদের উদ্দেশে কী বলবেন?
রনবী: কার্টুন ব্যাপারটা নিয়ে বলতে গেলে সহ্যশক্তির ব্যাপার-স্যাপারগুলো চলে আসে, যা এখন আমাদের মধ্যে খুব একটা নেই। আমরা এখন ভীষণভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। স্বাধীনতার পর থেকেই এই অস্থিরতা শুরু হয়েছে। এমনও হয়েছে, কার্টুন করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে কেউ কেউ। বিপদের মধ্যে আইনকানুনের ব্যাপার তো আছেই, কিন্তু পাবলিকলিও অনেক সময় কার্টুনের স্যাটায়ার সহ্য করতে পারেনি লোকেরা। আর যারা রাজনৈতিক কার্টুন করে, তাদের তো আরও বেশি বিপদ। এই যে আমাদের শিশির ভট্টাচার্য্য, ওর তো খুব মজার মজার রাজনৈতিক কার্টুন ছিল, এগুলো ফলপ্রসূও ছিল। মানে সমালোচনাটাকে ভালোভাবে নিয়ে যদি শোধরানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে সামাজিকভাবে কার্টুনের একটা ফল দাঁড়ায়। কিন্তু উল্টাটাই বেশি বুঝে ফেললে তো আর লাভ হলো না।
শেষ পর্যন্ত কার্টুন হলো ঠাট্টা-মশকরা, আমার মনে হয়, কার্টুনকে টিকিয়ে রাখার জন্য কার্টুনিস্টরা কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে হবে না। কার্টুন চালু রাখার জন্য নতুন কিছু পন্থা বের করা উচিত। এই সময়ের ইয়াং ছেলেদের অনেক রকম রসবোধ আছে, তাদের নানা রকম ভাবনাচিন্তা আছে, সেসব সামনে আসছে না। পত্রপত্রিকাগুলো নিজেদের বিপদ ভেবে কার্টুন আর তেমনভাবে ছাপতে চায় না। এমন কিছু পন্থা বের করা দরকার, যাতে কার্টুনও টেকে, কার্টুনিস্টও থাকে।