প্রদর্শনকক্ষে কীভাবে চিত্রবস্তু সাজানো হলো, তার ওপরও একটি প্রদর্শনীর গুরুত্ব অনেকখানি নির্ভর করে। এখানে আলোচিত প্রদর্শনীটির একটি ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। সেটি বাদ দিয়ে এ প্রদর্শনীর আলোচনা পূর্ণতা পায় না।
চারুকলা মহাবিদ্যালয় (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) প্রতিষ্ঠার পর প্রথম প্রজন্মের শিল্পীরা শিল্পকলায় নানা নিরীক্ষা করেন। মোহাম্মদ কিবরিয়ার শুরুর দিকের কাজে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিউবিস্ট ধারার অনুগামিতা লক্ষ করা যায়। অনেকের মধ্যে দেশজ বর্ণনাধর্মী কাজের ধারাও গড়ে ওঠে। তাঁদের অনেকেই বিদেশে গিয়ে নতুন আলোয় দেখেন পৃথিবীকে। পৃথিবীজুড়ে তখন শিল্পের নানা নিরীক্ষায় প্রভাব রাখছিল নিউইয়র্ক স্কুল। তাদের আগেও বিমূর্ততার চর্চা থাকলেও বিশুদ্ধ বিমূর্ততা নিউইয়র্ক স্কুলের হাত ধরে বিশ্বব্যাপী বিস্তার পায়। বাংলাদেশেও প্রথম পর্বে বিমূর্ততার দুটি ধারা দেখা যায়। সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
এই প্রদর্শনীতে সফিউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, দেবদাস চক্রবর্তী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, কাজী আবদুল বাসেত, নিতুন কুন্ডু, আবু তাহের, সমরজিৎ রায়চৌধুরী, হাশেম খান, মাহমুদুল হক, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, আবুল বারক আলভী, মোহাম্মদ ইউনুস, রতন মজুমদার, তাজউদ্দীন আহমেদ, রেজাউন নবী, রাসেদুল হুদা, রফি হক, অনুকূলচন্দ্র মজুমদার, মাকসুদা হক নিপা এবং এম ডি টোকনের কাজ দেখা গেল।
বড় একটা ক্যানভাস বাংলাদেশের বিমূর্ত শিল্পকলার ইতিহাস একসঙ্গে দেখা গেল। আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীকে যুক্ত করা গেলে প্রদর্শনী পূর্ণ হতো।
সফিউদ্দীন আহমেদের পেনসিলে করা শিল্পকর্মটি তাঁর বিরল কাজের একটি নমুনা। মোহাম্মদ কিবরিয়ার ছাপাই মাধ্যমের রচনা তাঁর গভীর মানসের প্রতিফলন। আমিনুল ইসলাম বাংলাদেশের শিল্পচর্চার ইতিহাসে অলোচিত নাম হলেও তাঁর কাজ সচরাচর চোখে পড়ে না। দীর্ঘ বিরতির পর প্রদর্শনীতে তাঁর কাজের উপস্থিতি আলাদা গুরুত্ব বহন করে এ জন্য যে তাঁর শুরু ও শেষের দিকের কাজে একটা মিলন আছে। ছাপায়, তেলরঙে, রেখাঙ্কনে মুর্তজা বশীরের কিছু বিরল কাজ প্রদর্শনীকে সমৃদ্ধ করেছে। দেবদাস চক্রবর্তী কম উচ্চারিত নাম। প্রদর্শনীটি তাঁর কাজ দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। একই কথা বলা যায় কাজী আবদুল বাসেতের ক্ষেত্রেও। সৈয়দ জাহাঙ্গীর, নিতুন কুন্ডু, আবু তাহেরের কাজও সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছে।
সমরজিৎ রায়চৌধুরী শেষ জীবনে নিসর্গচিত্রের বিমূর্তায়নে আলাদা ভাষা তৈরি করেছিলেন। মাহমুদুল হক প্রেরণা পেয়েছেন কিবরিয়ার কাছ থেকে। হাশেম খান বর্ণনা আর বিমূর্তের মাঝখানে আলাদা পরিসর নিয়ে আছেন। আবদুল্লাহ খালিদের কাজকে কি বিমূর্ত বলা যায়? প্রদর্শকেরা কী ভেবেছেন জানি না। হামিদুজ্জামান খান প্রতিনিধিত্ব করছেন ভাস্কর্য ও ছবি নিয়ে। কালিদাস কর্মকারের একটা বিরল বিমূর্ত কাজ রয়েছে।
আবুল বারক আলভী ও মোহাম্মদ ইউনুস আলাদা ভাষার চর্চা করেন। রতন মজুমদারের একটি কাজ দেখে বিভ্রম হয়, সেটি দেবদাস চক্রবর্তীর কি না! তাজউদ্দীন, রেজাউন নবী, রাসেদুল হুদার ধারাবাহিক উপস্থিতি সময়ের মালা গাঁথতে সহায়ক। রফি হকের কাজ চমক দিয়েছে। অনুকূলচন্দ্র মজুমদার বর্ণনাধর্মী শিল্পী হলেও কখনো কখনো চলে যান বর্ণনার বাইরে।
মাকসুদা হক নিপা ক্যানভাসে নানা বিভ্রম রচনা করেন। মোহাম্মদ টোকন ইমপ্রেশনিস্টদের কাজের মধ্যে নতুন বিমূর্ত উপাদান খুঁজে পান।
ছোট পরিসরে বিমূর্ত ধারার ইতিহাসের মালা গাঁথা হয়তো সম্ভব নয়, তবে একটা হ্যান্ডবুক তো হতে পারে। এই প্রদর্শনী সম্ভবত সে রকমই।
গ্যালারি কায়ায় এ প্রদর্শনী চলবে ২৬ অক্টোবর ২০২৪ পর্যন্ত।
সৈয়দ গোলাম দস্তগীর