চিত্রকলা প্রদর্শনীর নাম ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট অ্যান্ড রিয়েলিটি’ (বিমূর্ত এবং বাস্তবতা)। আমাদের চিত্রকলার যে ধারাবাহিক বিবর্তন তাকে অনুধাবনের ইচ্ছে থেকেই এই প্রদর্শনী। ওমানের ঐতিহ্যবাহী বিখ্যাত গ্যালারি ‘বাইত মুজনা’তে প্রদর্শনীর শিল্পকর্মগুলোর মধ্য দিয়ে আমাদের সমকালীন আধুনিক চিত্রকলার প্রবণতাগুলোর একটি ধারণা দিতে চেয়েছেন মূল আয়োজক এবং কিউরেটর এলদেম বি. কবির।
সম্প্রতি ওমানের রাজধানী মাসকাটে বাংলাদেশের সাত শিল্পীর চিত্রপ্রদর্শনী আয়োজন করে সোসাইটি ফর প্রমোশন অব বাংলাদেশ আর্ট, এসপিবিএ। বৃহৎ ক্যানভাসে বাংলাদেশের শিল্পীদের আঁকা গাঢ় ও উজ্জ্বল রঙের গতিশীল কম্পোজিশন আলোড়িত করেছে ওমানের শিল্পানুরাগী দর্শকদের।
এখানে অংশ নেওয়া শিল্পীরা সবাই স্বনামে খ্যাত—মনিরুল ইসলাম, মোহাম্মদ ইউনুস, কনক চাঁপা চাকমা, তাজউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ ইকবাল, জাহাঙ্গীর হোসেন ও মাকসুদা ইকবাল। বাংলাদেশের সমকালীন আধুনিক চিত্রকলা আজ স্বতন্ত্র এবং স্বমহিমায় উজ্জ্বল। সেই বাস্তবতা মাথায় রেখে আমরা প্রবেশ করছি প্রত্যেক শিল্পীর কাজের আলোচনায়।
দৃশ্যমান বস্তুর রূপের সরলীকরণের মধ্য দিয়ে বিমূর্ততার প্রকাশে মনিরুল ইসলাম অনন্য। তাঁর ছবিতে বিমূর্ততায় শুদ্ধ সৌন্দর্যের ঝোঁকের চেয়েও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ তাঁর মরমি অনুভবের রূপায়ণ। এখানে তাঁর ছবি দেখেও এটি অনুভব করা যায়।
মনিরের মতো মোহাম্মদ ইউনুসও বিমূর্ততা নিয়ে চর্চা করেন। সেই বিমূর্ততার ভেতরে আছে জীবনেরই এক রূপান্তরিত আভা। এ শিল্পীর ছবির জাপানি চিত্ররীতির আধ্যাত্মিকতা-অন্বিত সংবৃত আঙ্গিকের অনুরণন আমাদের আচ্ছন্ন করে।
অন্যদিকে প্রদর্শনীর আরেক শিল্পী তাজউদ্দিন আহমেদ যখন লৌকিক জীবনের সারল্যকে ক্যানভাসে ফর্মের ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত করেন, সে সময় তা যেন শান্তিময় হয়ে ওঠে। তাঁর কাজে পাওয়া যায় প্রাচ্যের নান্দনিক সংঘাতের একটি অনুরণন ও পাশ্চাত্যের আধুনিকতার আঙ্গিক।
আবার অবয়বী ছবিই আঁকেন কনক চাঁপা চাকমা। কিন্তু স্নিগ্ধ সুরেলা কল্পলোকের মধ্য দিয়ে পার্বত্য এলাকার মানুষদের এক স্বপ্নের জগৎকে উন্মীলিত করতে চান তিনি। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
মোহাম্মদ ইকবালের ছবিতে গুরুত্ব পেয়েছে সমসাময়িক আন্তর্জাতিক বাস্তবতা। অবয়বী রূপকল্পে ফ্যান্টাসির পরিমণ্ডল রচনায় ইকবাল অত্যন্ত দক্ষ শিল্পী। তাঁর তেলরঙের ক্যানভাসের অবয়ব বিন্যাস দর্শকদের টেনে নিয়ে যায় অন্যলোকে।
বিষয়ের রূপকল্প অনেকটা সুরিয়ালিজমের আবহ তৈরি করে জাহাঙ্গীর হোসেনের ছবিতে। সমাজবাস্তবতা ও শিল্পের মধ্যের নান্দনিক অবস্থানই যে এ শিল্পীর কাজের মূল প্রতিপাদ্য, তাঁর ছবি আমাদের সে কথাই বলেছে এখানে।
বাস্তবতা থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে রূপকল্প ও প্রতীকী ব্যঞ্জনার দিকে গেছেন যেসব শিল্পী, মাকসুদা ইকবাল তাঁদের অন্যতম। প্রতিচ্ছায়াবাদীদের মতো স্তরের পর স্তর অতিক্রম করে রঙের একটি মাত্রা তৈরি করতে পারঙ্গম তিনি।
সব মিলিয়ে এ প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের এই সাত শিল্পী মধ্যপ্রাচ্যে স্বদেশের চিত্রকলাকে অন্য মাত্রায় তুলে ধরেছেন বলেই মনে হলো।