দিবারাত্রির কাব্য উপন্যাসের আনন্দ প্রশ্ন করেছিল, ‘প্রেম কত দিন বাঁচে?’ হেরম্ব উত্তর দিয়েছিল, ‘এক দিন, এক সপ্তাহ, বড়জোর এক মাস’। যিনি এই প্রশ্ন ও উত্তর দুই–ই লিখেছিলেন, তিনিই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯ মে বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি এই লেখকের জন্মদিন। তাঁর লেখায় উপনিবেশবিরোধী ভাবনা কীভাবে এসেছে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে ত্রিশোত্তর সাহিত্যিকদের অভিযোগ ছিল যে তিনি রোমান্টিক, সাহিত্যে কেবল সুন্দরের সাধক। কল্লোল যুগের সাহিত্যিকদের অবস্থান ছিল বিশ শতকীয় আধুনিকতার পাটাতনে। যেখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালীন ক্লেদ, গ্লানি, হতাশা, অবক্ষয় আর অনিকেত-চেতনার বিস্তারে সুন্দর ও অসুন্দর—সবই আরাধ্য হয়ে উঠেছিল। রোমান্টিকতার বদলে অ্যান্টিরোমান্টিকতারই ছিল জয়জয়কার। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একুশ বছর বয়সের (১৯২৯) রচনা হিসেবে স্বীকৃত দিবারাত্রির কাব্য আর ওই বছরই প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা উপন্যাস দুটি পাশাপাশি রেখে পাঠ করলেই রোমান্টিকতা আর অ্যান্টিরোমান্টিকতার ব্যবধানটি স্পষ্ট হবে। অমিত-লাবণ্য ও হেরম্ব-আনন্দের প্রণয়ের ভাষা, পরিণামের ভাষ্যই এর প্রমাণ। বড় প্রমাণ প্রণয়ের স্থায়িত্বসংক্রান্ত হেরম্বের উক্তিতে। জন্মজন্মান্তরব্যাপী প্রেমের টিকে থাকা নিয়ে রোমান্টিকদের ভাবোচ্ছ্বাসময় চিন্তার বিপরীতে ‘প্রেম কত দিন বাঁচে?’ আনন্দের এমন জিজ্ঞাসার উত্তরে হেরম্ব বলেছিল, ‘এক দিন, এক সপ্তাহ, বড়জোর এক মাস’। প্রণয়ের জন্ম-মৃত্যু নিয়ে এরূপ ভাবনার সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের পরিচয় ছিল না। প্রথম রচিত উপন্যাসেই মানিক পাঠককে বিশ শতকীয় আধুনিকতার সঙ্গে পরিচিত করে তুললেন।
শুধু ওই একটি বিষয় নয়, বাংলা কথাশিল্পের ইতিহাসে বিশ শতকীয় আধুনিকতার সব অনুষঙ্গকে ধারণ করেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে উঠেছেন স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। এই আধুনিকতার প্রধান দুই উপাদান—ফ্রয়েডের মনস্তাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলো ও মার্ক্সীয় সমাজতত্ত্ব—তাঁর সাহিত্যকে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ ও রসমণ্ডিত করেছে। মনোবিশ্লেষণ ও সমাজবিশ্লেষণের অতি সূক্ষ্ম নিবিড়তায় ও সমন্বয় সাধনে যে নৈপুণ্য তিনি দেখিয়েছেন, তা পরবর্তী প্রজন্মের কথাশিল্পীদের কাছে অনুসরণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। এ কারণেই রবীন্দ্রোত্তর যুগে উত্তর প্রজন্মের ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে কবিতায় যেমন জীবনানন্দ, তেমনি কথাশিল্পে মানিকের নাম অগ্রগণ্য।
এ প্রসঙ্গেই স্মরণীয় মানিকের আরেকটি প্রায়-অনালোচিত বৈশিষ্ট্য। সেটি হলো, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী প্রকল্পে আমরা কেন্দ্র ও প্রান্তের বৈপরীত্য সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস লক্ষ করি। কেন্দ্রকে সমৃদ্ধ ও আলোকিত করে প্রান্তকে অবহেলার মাধ্যমে অনালোকিত রেখে কেন্দ্রের প্রতি প্রান্তের আকর্ষণ অব্যাহত রাখার উপনিবেশবাদী প্রকল্পের উত্তম দৃষ্টান্ত এই বাংলা ও ভারতবর্ষ। এই পরিকল্পনায় নগরজীবনকে আলোকায়নের অন্তর্ভুক্ত করে গ্রামকে রাখা হয়েছে তিমিরাচ্ছন্ন। কিন্তু পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬) উপন্যাসে এর বিপরীত প্রক্রিয়া লক্ষ করি। ‘শশী’ চরিত্রের মধ্য দিয়ে মানিক এ উপন্যাসে পল্লির উন্নয়নসাধনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। রাজধানী কলকাতার মেডিকেল কলেজে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের পর সে গ্রামে ফিরে যায় এবং গ্রামের মানুষের চিকিৎসাসেবায় সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করে। তার নেতৃত্বে গ্রামেই গড়ে তোলা হয় আধুনিক চিকিৎসালয়। আর সেখানে সে বিনা বেতনেই মানুষের সেবায় ব্যাপৃত থাকে। তার বিনিময়ে মানুষ তাকে নেতার আসনে বসিয়ে অনেক উঁচুতে তুলে দেয়। শশীর জীবনদর্শনই তাকে এমন মহত্তম অবস্থানে উন্নীত করে। শশী অনুভব করেছে, জীবনকে শ্রদ্ধা না করলে জীবন আনন্দ দেয় না। ফলে সে ‘প্রাণপণে জীবনকে শ্রদ্ধা করে। সংকীর্ণ জীবন, মলিন জীবন, দুর্বল পঙ্গু জীবন—সমস্ত জীবনকে।’ জীবনকে এভাবে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে সে লক্ষ করেছে যে ‘ডোবা আর মশাভরা গ্রামে জীবন কম গভীর নয়, কম জটিল নয়।’ জীবন সম্বন্ধে, বিশেষত গ্রামজীবন সম্বন্ধে, এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই, গ্রামজীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে সেখানকার মানুষগুলোর জীবনমান উন্নয়নের দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে শশী হয়ে উঠেছে মানিকের বি–উপনিবেশায়ন চেতনার উজ্জ্বল প্রতিভূ। আর এভাবেই পুতুলনাচের ইতিকথা উপন্যাস উপনিবেশবাদবিরোধী আখ্যান হিসেবে বিশিষ্টতা অর্জন করেছে। মানিকের এই বি–উপনিবেশায়ন চিন্তা শুধু বিশ শতকের আধুনিকতাবাদী চেতনার সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, একুশ শতকীয় আধুনিকতা যাকে আমরা উত্তর-আধুনিকতা বলে অভিহিত করেছি, তার পরিমাপেও অতিশয় প্রাসঙ্গিক।
তিনিও দস্তয়েভস্কির মতো শিকার হয়েছিলেন মৃগীরোগের। যদিও স্নায়বিক এই সংকট তাঁর মনোবিশ্লেষণের ঋজুতাকে কোনোভাবেই ব্যাহত করতে পারেনি।
ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর ধারায় মানিকের মানবমন বিশ্লেষণের যে আগ্রহ তাঁর কথাশিল্পকে আকর্ষণীয় ও বৈচিত্র্যময় করেছে, সেখানেও মানিকের সৃজনধর্মী স্বাতন্ত্র্য লক্ষণীয়। মানুষের সব আকাঙ্ক্ষা, উদ্যম ও উৎসাহ-আনন্দের মূলে লিবিডোর কার্যকরতা বা নিয়ন্ত্রক শক্তির ভূমিকা নিয়ে ফ্রয়েডীয় চিন্তার সঙ্গে মানিকের জীবন-মন বিশ্লেষণের ধারা সর্বদা সাযুজ্য রক্ষায় ব্যাপৃত থাকেনি। বরং ফ্রয়েডের লিবিডো-তত্ত্ব মানিক-সাহিত্যের ক্ষীণ অংশেই সহজলভ্য এবং সেসব অংশের বিশ্লেষণেও আবার ফ্রয়েড সর্বমান্যতা পাননি। অর্থাৎ লিবিডো-তত্ত্বের সর্বজনীনতা ওই সব অংশেও পুরোপুরিভাবে স্বীকৃত হয়নি। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের কথাই যদি ধরি, তাহলেই বুঝব, ভিখু চরিত্র সমগ্র মানবসমাজের প্রতিনিধি হতে পারে না। মনোবিকারের কারণ হিসেবে লিবিডোর বাইরে বহুবিধ শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সংকট মানিক-সাহিত্যে রূপায়িত হয়েছে বাস্তবোচিতভাবেই। দিবারাত্রির কাব্য আর জননী উপন্যাস কিংবা পদ্মানদীর মাঝি ও পুতুলনাচের ইতিকথা উপন্যাস পাশাপাশি রাখলে কিংবা ‘প্রাগৈতিহাসিক’ ও ‘সরীসৃপ’ গল্পের পাশে ‘আত্মহত্যার অধিকার’, ‘সমুদ্রের স্বাদ’ ও ‘হলুদ পোড়া’ গল্প রাখলে আমরা এর প্রমাণ পাব। মানিক তাঁর প্রতিভার উন্নততর বৈশিষ্ট্য ও মানুষের জীবন-মন অধ্যয়নের একান্ত স্বকীয় সূক্ষ্মতা দিয়েই একটি স্বতন্ত্র ধারা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। মানিকের ব্যক্তিজীবনের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের বিষয়টি এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। তিনিও দস্তয়েভস্কির মতো শিকার হয়েছিলেন মৃগীরোগের। যদিও স্নায়বিক এই সংকট তাঁর মনোবিশ্লেষণের ঋজুতাকে কোনোভাবেই ব্যাহত করতে পারেনি। জীবন অধ্যয়নে ব্যাপকভাবে ব্যাপৃত হয়ে তিনি এর বৈচিত্র্য ও বিশালতাকে এমনভাবে উপলব্ধি করেছেন যে তাঁর মনে হয়েছে, কোনো তত্ত্ব দ্বারা একে যথার্থ পরিমাপ বা বিচার করা সম্ভব নয়। এভাবে আমরা দেখতে পাই, মানিকের মনঃসমীক্ষণের প্রবণতাটি হয়ে উঠেছে কালাতিক্রমী এবং বলা যায় যে একুশ শতকীয় পরিমণ্ডলেও তার আবেদন প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি।
মার্ক্সীয় সমাজতত্ত্বের সঙ্গে পরিচয়সূত্রে মানিকের সাহিত্যদৃষ্টির যে পরিবর্তন সাধিত হয়, তাতে তাঁর পূর্ব-অনুসৃত মনোবিশ্লেষণধর্মী ধারা সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়, এমনটা বলা যাবে না। বরং মনোবিশ্লেষণের সঙ্গে সমাজবিশ্লেষণ যুক্ত হয়ে তাঁর সাহিত্যে একটি নতুন মাত্রার সঞ্চার ঘটে। সমাজবিশ্লেষণের এই নতুন প্রক্রিয়ায় সমাজের সর্ববিধ শোষণ অবসানের লক্ষ্যে পরিশ্রমজীবী নিম্নবর্গীয় মানুষের সচেতনতা ও সমষ্টিবদ্ধ সংগ্রামের বিষয়টি প্রাধান্য অর্জন করে। এর মধ্যে বৃহত্তর মানবকুলের যে কল্যাণাকাঙ্ক্ষা নিহিত থাকে, তাতে তাঁর সাহিত্যে চিত্রিত পূর্বকালীন চরিত্র-মধ্যকার অসহায়ত্ব ও নিরুপায়ত্ব বিলুপ্ত হয়। মধ্যবিত্তসুলভ অহং ভেঙে শ্রেণিবৈশিষ্ট্য বিসর্জন দিয়ে নিম্নবর্গের কাতারে শামিল হওয়ার মধ্যে যেমন বিকারমুক্তি ঘটে, তেমনি ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সমষ্টিস্বার্থের অনুভব তার অসহায়ত্ব দূরীকরণে সাহায্য করে। এ পর্বে মানিক কোনো ইউটোপীয় কল্পজগৎ নির্মাণ করেননি কিংবা সরাসরি রাজনৈতিক স্লোগানসর্বস্ব আখ্যান নির্মাণে ব্যাপৃত হননি। অর্থনৈতিক শোষণমুক্তির মধ্যেই বৃহত্তর কল্যাণনিহিত সেই বোধ সঞ্চার করার পাশাপাশি জাগ্রত করেছেন সমষ্টিচেতনা, এঁকেছেন মনোজগতের রূপান্তরসাধনের চিত্র। একুশ শতকীয় আধুনিকতার পাটাতনে, যেটিকে আমরা উত্তরাধুনিকতা বলে নামাঙ্কিত করেছি, মানিকের এই সমাজ-কল্যাণাকাঙ্ক্ষাটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েনি। একুশ শতকীয় বাস্তবতায় নিম্নবর্গের জীবন-অধ্যয়ন আরও ব্যাপকতা ও গুরুত্ব অর্জন করেছে। নিম্নবর্গের কুসংস্কারমুক্ত যুক্তিশীল ও সংগ্রামমুখর শরীর-মনে মানিক যে সৌন্দর্য ও বুদ্ধির দীপ্তি দেখেছেন, তার ব্যঞ্জনা আজও পাঠককুলকে মোহিত করে।