তকদীর সিনেমায় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী
তকদীর সিনেমায় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী

বাংলা সিনেমার চেহারা বদলে দিলেন যাঁরা

তাকদীর, ঊনলৌকিক, কাইজার, কারাগার-এর মতো সিরিজগুলো বাংলা সিনেমার ধারা অনেকটাই বদলে দিয়েছে। জেনে নেওয়া যাক দেশি এসব গল্পের কারিগর কারা।

এক তরুণীর মুখ। আপাতদৃষ্টে ভাবলেশহীন। একটু পরেই কথা বলতে শুরু করে সে। কোনো বাড়তি আবেগের বহিঃপ্রকাশ নেই, নেই কোনো আবহ সংগীত। ক্যামেরা কাছে এলে স্পষ্ট হয়, অদ্ভুত অন্তর্ভেদী দৃষ্টি তার। শীতল চাহনির আড়ালে লুকিয়ে আছে কোনো দুঃসহ অতীত স্মৃতি। ধর্ষণের শিকার হয়েছে সে।

বাংলা কনটেন্টে ধর্ষণের শিকার তরুণীকে নানাভাবেই পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে দর্শকের সঙ্গে। তবে তাকদীর-এর এই সূচনাপর্ব অনেক অর্থেই দেশি দর্শকের কাছে ‘ভিনদেশ’। আবহ সংগীতের অতি ব্যবহারে বাড়তি নাটকীয়তা তৈরির চেষ্টা নেই, কথা বলার সময় কান্নাকাটি নেই। বাস্তবে যেমন হয় বলে ইনটিউশন আপনাকে বলে দেয়, তেমনই। এই সূচনাদৃশ্যটিই আসলে বহুল চর্চিত সিরিজটির সুর বেঁধে দিয়েছে। এরপর পর্বগুলো এগিয়েছে সে পথ ধরেই। একই সঙ্গে সিরিজটি কি বাংলা কনটেন্টের গতিপথও ঠিক করে দেয়নি?

চার বছর আগের ডিসেম্বরে সিরিজটি যখন মুক্তি পায়, রাজশাহী, রংপুর বা সিলেটের কোনো তরুণ হয়তো শীতের রাতে তাকদীর দেখতে দেখতে ভেবেছিল, সেও একদিন এমন কিছু বানাবে। আজ হয়তো নিজের শহর বা অন্য কোথাও সেই প্রস্তুতিও নিচ্ছে সে। অথবা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনেকের আড্ডা জমেছিল সিরিজটি নিয়েই। সমঝদার সেসব দর্শকের চোখ হয়তো এখন আরও অনেক কিছু দেখার জন্য তৈরি হয়ে গেছে।

২০২০ সালে তাকদীর দিয়ে নির্মাতা হিসেবে যাত্রা শুরু হয় সৈয়দ আহমেদ শাওকির। সিরিজটি নির্মাণ করেছিল প্রযোজনা সংস্থা ফিল্ম সিন্ডিকেট। তবে এটা ছিল কেবল শুরু। এরপর ঊনলৌকিক, কাইজার, কারাগার-এর মতো প্রশংসিত সিরিজ আসে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি থেকে। ফিল্ম সিন্ডিকেট হয়ে ওঠে দেশি-বিদেশি দর্শকের কাছে সমীহ জাগানো এক নাম। গত বছর তারা ঘোষণা দেয় নতুন ১২টি সিরিজ ও সিনেমার। একসঙ্গে এতগুলো কাজের ঘোষণা দেশীয় প্রযোজনা সংস্থার জন্য অভিনব ঘটনা বটে।

একের ভেতর তিন

ফিল্ম সিন্ডিকেট একটা ছাতার মতো। এই ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে আছে আরও তিনটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান—ডোপ প্রোডাকশন, বক্স অফিস, ফিল্ম নোয়া। ২০১১ সালে ডোপ প্রোডাকশন শুরু করেন নির্মাতা তানিম নূর। ২০১২ সালে মীর মোকাররম হোসেন শুভ কর্মজীবন শুরু করেছিলেন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে। পরে নিজের মতো করে গল্প বলার স্বপ্ন নিয়ে তিনি বক্স অফিস নামে প্রযোজনা সংস্থা শুরু করেন। ২০১৩ সালে সৈয়দ আহমেদ শাওকি, সালেহ সোবহান অনীম আর রেহমান সোবহান সনেটের হাত ধরে শুরু হয় ফিল্ম নোয়া। তিনজন তখনও পুরোদস্তুর নির্মাতা হয়ে ওঠেননি। তবে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখছেন প্রবলভাবে। ডোপ প্রোডাকশন বিজ্ঞাপত্রচিত্রের পাশাপাশি তৈরি করেছে মানি হানি বা কন্ট্রাক্ট–এর মতো সিরিজ। বক্স অফিস মূলত বিজ্ঞাপনচিত্র, তথ্যচিত্র, মিউজিক ভিডিও আর বিভিন্ন বাণিজ্যিক কাজ করেছে। ফিল্ম নোয়া থেকে এসেছে জাগো বাহের মতো আলোচিত ও প্রশংসিত সিরিজ।

আলাদা আলাদা প্রযোজনা সংস্থা হলেও তানিম নূর, শাওকি আর শুভরা কর্মসূত্রে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। একসঙ্গে কাজ করছেন অনেকদিন ধরেই। পরে কীভাবে তাঁরা এক হলেন? কেন–ই বা সবাই মিলে ফিল্ম সিন্ডিকেট নামে আলাদা প্রযোজনা সংস্থা চালু করলেন? সে গল্প জানতে ফিরে যেতে হবে আরও পেছনে।

ঘটনাটা ২০০৯ সালের। সৈয়দ আহমেদ শাওকি, সালেহ সোবহান অনীম আর রেহমান সোবহান সনেট ছিলেন তানিম নূরের সহকারী। নির্মাতা তানিমের ফিরে এসো বেহুলা সিনেমার সহকারী পরিচালক ছিলেন তাঁরা। শাওকি তখন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্র, অনীম পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, সনেট ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। একসঙ্গে কাজ করতে করতে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন সবাই। সেই স্বপ্ন থেকেই ২০১৩ সালে ফিল্ম নোয়া তৈরি হয়। তিন বন্ধুর সঙ্গে ছিলেন হাসনাইন তসলিমও। বিজ্ঞাপন দিয়ে শুরু, তবে অন্য নির্মাতাদের মতোই ফিল্ম নোয়ার স্বপ্ন ছিল ফিকশন বানানো। তবে কারোরই সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা নেই, কাজটা পারবেন কিনা জানেন না। ভুল থেকে শিখে শিখে নিজেদের পরীক্ষা নিতে চান।

২০১৫-২০১৬ সালের দিকে ঢাকার যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের উদ্যোগে প্রজন্ম টকিজ নামে একটা ইউটিউব চ্যানেল শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সঙ্গে তাঁদের চুক্তি হয় দশটি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা বানানোর। ২০১৬ সালে অ্যান্থোলজি সিনেমার নামও সেভাবে কেউ জানত না। শাওকিদের পক্ষেও দশটি সিনেমা বানানো সম্ভব ছিল না। ততদিনে একই সঙ্গে ডোপ প্রোডাকশন শুরু হয়ে গেছে। শুভ ভাই সবারই বড় ভাই। বাকি সবাই তার ছোট ভাই। তাঁর পরামর্শ নেওয়া হলো। তিনি তানিম নূরকে একটা বানাতে বললেন, আরেক নির্মাতা রবিউল আলম রবিকে বানাতে বললেন আরেকটা।

প্রজন্ম টকিজের কাজ এটা করার পর ডাক পড়ল নির্মাতা অমিতাভ রেজার। তিনি তখন ঈদের একটা নাটক বানাচ্ছিলেন নবীন নির্মাতাদের নিয়ে—অস্থির সময়ের স্বস্তির গল্প নামে। এই প্রকল্পেই প্রথম মূলধারার কাজের সঙ্গে যুক্ত হলেন শাওকিরা। এরপর হলো আরেকটি অ্যান্থলজি সিনেমা, ইতি তোমারই ঢাকা। স্বপ্নটা আরও একটু বড় হলো।

শাওকি যেমন বলতে বলতে ফিরে গেলেন কয়েক বছর পেছনে, ‘যেহেতু আমাদের ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা নেই, সব সময় কোলাবরেশনের ওপর নির্ভর করতাম। অনিম যেমন এডিটিং নিজে শিখছে। কালার গ্রেডিং, পোস্ট প্রোডাকশন পুরোটা শিখছে। আমি পরিচালনা করতে করতে শিখছি। একেকজনের দক্ষতা মিলিয়ে–মিশিয়েই আমাদের প্রকল্পগুলো হয়েছে। আমাদের লেখাটা দুর্বল ছিল। রবি ভাই আর তানিম ভাইয়ের সাহায্য নিয়েছিলাম। এর খুবই প্রয়োজন ছিল। হয়তো বানাতে পারি না, কিন্তু দর্শক হিসেবে তো আমি ভালো। নিজের কাজ দেখলে তো বুঝতে  পারি কোনটা ভালো হয়নি বা কোথায় কোথায় ঝামেলা আছে। একজন চলচ্চিত্রকারের জন্য এটাই প্রথম দরকার। ভালো দর্শক হওয়া জরুরি। দেখে বুঝতে হবে ভালো বানিয়েছি নাকি খারাপ। এর জন্য পড়ালেখা লাগে না।’

ধীরে ধীরে কাজ বাড়ছিল। তবে এই তরুণেরা কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছিলেন না। তাঁরা যে ধরনের গল্প বলতে চান, কেউ নিশ্চিত ছিলেন না, সে ধরনের গল্পের বাজার তৈরি হবে কি না। কোভিডের পর ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো ভালো বিনিয়োগ শুরু করল। সবাই বুঝতে পারলেন, এত দিন তাঁরা ব্যাট আর বল নিয়ে ছিলেন; এবার খেলার মাঠও পেলেন। তবে ওটিটির জন্য ১৬০ মিনিটের সিরিজ বানানো ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।

এবারও ত্রাণকর্তা হয়ে এলেন তানিম নূর। কারণ, তিনি অনেক আগেই সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি এর আগে মানি হানি আর একাত্তর নামে দুটি সিরিজ বানিয়েছেন। নিজের সব অভিজ্ঞতা নিংড়ে দিলেন। এই অভিজ্ঞতা নিয়েই তাকদীর-এর বিস্তারিত পরিকল্পনা হলো।

ফিল্ম সিন্ডিকেটের সূচনা

তাকদীর-এর সব ঠিকঠাক, কিন্তু প্রযোজক হবেন কে? বাইরের কারও ওপর নির্ভরও করতে মন সায় দিচ্ছিল না। কারণ যে গল্প তারা বলতে চান তার ওপর তো প্রযোজকের বিশ্বাস রাখতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় নিজেরাই প্রযোজনা করলে। কোনো তৃতীয় পক্ষের দরকার নেই। এই ঝুঁকি নিয়েই এক হলো ফিল্ম নোয়া, ডোপ প্রোডাকশন আর বক্স অফিস। এভাবে তাকদীর করার জন্যই তৈরি হলো ফিল্ম সিন্ডিকেট।

ফিল্ম সিন্ডিকেট, তার মানে, তৈরি হয়েছিল প্রযোজকের অভাবে। অনেকে মনে করেন, প্রযোজকের কাজ শুধু অর্থ লগ্নি করা। কিন্তু প্রযোজকের কাজ আসলে ব্যবস্থাপনা আর সৃষ্টিশীলতার মিশেল। মীর মোকাররম হোসেন মনে করেন, বাংলাদেশে বহু কাজই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সঠিক প্রযোজকের অভাবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বললেন, ‘আগে দেশে যত পরিচালক ছিলেন, তাদের বেশি মনোযোগ আসলে চলে গেছে প্রযোজনায়। কারণ সিনেমা বানানোর এই বিরাট কর্মযজ্ঞ যথাযথ প্রযোজক ছাড়া সম্ভব না। এই চাপটা পরিচালক নিয়ে নিলে মূল কাজ পরিচালনায় মনোযোগ কমে যায়।’

এই বাস্তবতা মনে রেখে প্রথমেই খুঁজতে বসা হলো—কে কোন কাজে ভালো? এটা খুঁজতে গিয়েই তাকদীর প্রযোজনা করতে গিয়ে জন্ম হলো ফিল্ম সিন্ডিকেটের। ‘পাঁচ–ছয়জন মিলে যদি আমরা কাজটা করি, তাহলে সবাই কিছু না কিছু অবদান রাখতে পারব। এটাই ছিল মূল ভাবনা।’ বললেন মীর মোকাররম হোসেন। ফিল্ম সিন্ডিকেট একটা আইডিয়া চূড়ান্ত হওয়ার পর সবার মত নেওয়া হয়, কয়েক রকমের ড্রাফট হয়, এরপর কাজের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সবার অবদান থাকে। ফিল্ম সিন্ডিকেট মনে করে, সবাই মিলে কাজটা করলে সবার দুর্বলতার জয়গাটা পূরণ করা যায়।

সবাই মিলে একসঙ্গে কাজের সুবিধাই বেশি বলে মনে করেন সালেহ সোবহান অনীম। তিনি বললেন, এতে একজনের ওপর চাপ পড়ে না। এ ছাড়া একেকজনের দক্ষতা একেক বিষয়ে। সবাই মিলে কাজ করলে দক্ষতা একসঙ্গে করে বিভিন্ন দিকে প্রয়োগ করা যায়। অনীম নিজে ফিল্ম স্কুলে পড়েননি, শেখেননি সম্পাদনাও। কিন্তু তিনিই পরে সম্পাদনায় মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। ফিল্ম সিন্ডিকেটের কাজ ছাড়াও বাইরের প্রযোজনা সংস্থার সিরিজেও সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন।

সালেহ সোবহান জানালেন, সম্পাদনা তিনি শিখেছেন বিপদে পড়ে। তাকদীর-এর শুটিংয়েই সব টাকা খরচ হয়ে গিয়েছিল। পোস্ট প্রোডাকশনের বাজেট আর ছিল না। তাই নিজে নিজেই সম্পাদনা শিখে নিতে হয়। পরে এ বিষয়ে আগ্রহও তৈরি হয় তাঁর। আশপাশের বন্ধুরাও বুঝতে পারেন সম্পাদনায় তাঁর একটা দক্ষতা তৈরি হয়েছে। এভাবে গড়ে ওঠে আস্থাও। তাঁদের কাজেও এর প্রতিফলন পাওয়া যায়। তবে অনেক কিছু অর্জন করে ফেলেছে, এভাবে মোটেই ভাবেন না ফিল্ম সিন্ডিকেটের সদস্যরা। তাঁরা বলেন, দেশে মানসম্পন্ন কাজের অভাব থাকায় সামান্য ভালো কাজেও তাঁরা প্রশংসিত হন। বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এখনো তাঁরা অসাধারণ কিছু করেননি।

কারাগার সিনেমায় অভিনেত্রী তাসনিয়া ফারিন

নিজেদের গল্প বলা

ফিল্ম সিন্ডিকেটের কাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তাদের গল্পের দেশি সৌরভ৷ আশপাশের চেনা মানুষের জীবনযাপনের গল্প যেভাবে তারা পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছে, সেটা আগে খুব বেশি দেখা যায়নি। তাকদীর আর কারাগার–এর নির্মাতা শাওকি জানালেন, তাঁদের মূল ভাবনাই ছিল এটা—এমন গল্প বলা, যেটা শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব।

আলাপে আলাপে নির্মাতা ফিরে গেলেন সেই বিকেলে, যেদিন তাঁদের দেখা করার কথা পশ্চিমবঙ্গের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচইয়ের তখনকার হেড অব কনটেন্ট অনিন্দ্য ব্যানার্জির সঙ্গে। শাওকিদের মাথায় কোনো গল্প নেই, মিটিংয়ে যাওয়ার সময় হাঁটতে হাঁটতে একটা প্লট ভেবে বলে দিলেন। অনিন্দ্য বললেন, ‘এটা কি এক্ষুনি আসতে আসতে বানালি?’ সেই সঙ্গে জুড়ে দিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেই প্রশ্নও, ‘এই গল্প যদি বাংলাদেশে না হয়ে টেক্সাসে হয়, তাহলে কি গল্পটা বদলে যাবে?’ না, বদলাবে না। এই উত্তর শুনে তিনি বললেন, এ রকম গল্প তাঁর চাই না। তাঁর চাই এমন গল্প, যা শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব। বছর কয়েক আগের কথা সেটা। কিন্তু শাওকিরা সেই বাক্যকেই ধ্রুব সত্য মেনে এগিয়ে চলছেন।

মীর মোকাররম হোসেন বিবিসিতে রেডিও সাংবাদিকতার সুবাদে সারা দেশে চষে বেড়ান। দেশের অন্তত তিন শ উপজেলায় এক রাত করে থেকেছেন। এ সফরই তাঁর সামনে খুলে দিয়েছিল দেশি গল্পের নতুন ভান্ডার। নিজে নির্মাতা হতে চেয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যুক্ত ছিলেন ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে। সাংবাদিকতার সুবাদে আয়ত্ত হয়েছিল ভিজ্যুয়াল গল্প বলার ধরন। পরে জুটে গেল সিনেমাপ্রেমী বন্ধু ও ছোট ভাইয়েরা। শুরু হলো গল্প বলার নতুন যাত্রা।

তাকদীর যে কেবল দেশি ওটিটি কনটেন্টের ক্ষেত্রে নতুন মানদণ্ড তৈরি করেছে, তা নয়, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবিত একদল তরুণকে আরও বড় পরিসরে গল্প বলার আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। তবে সিরিজটি কতটা সফল বা ব্যর্থ, সে আলোচনায় যেতে চায় না ফিল্ম সিন্ডিকেট। তারা মনে করে, সিরিজটি দিয়ে তারা বুঝেছে ওটিটির বাজার আসলে কত বড়। তারা যে গল্প বলতে চায়, সেটার একটা দর্শকগোষ্ঠী আছে, সেটাও বোঝা গেছে। তাকদীরকে নিজেদের ‘লিটমাস টেস্ট’ হিসেবে দেখে, যা তাদের ভবিষ্যৎ গতিপথ ঠিক করে দিয়েছে।

ফিল্ম সিন্ডিকেট নিজের কাজে যেন দেশি গল্পের ছোঁয়া দিতে চায়, তেমনই দিতে চায় সামাজিক বার্তাও। তানিম নূর বলছিলেন, ‘দর্শকদের যাতে আরেকটু সচেতন করা যায়, আধুনিকতা-মনস্ক করে তোলা যায়, এটাও আমাদের মনে কাজ করে। একটা কনটেন্ট বানালাম আর ছেড়ে দিলাম—ব্যাপারটা এমন নয়। তরুণদের প্রতি একটা দায় আমাদের আছে। কারণ, অডিও-ভিডিও মাধ্যম মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য খুবই শক্তিশালী। আমরা দর্শককে বিনোদন দিতে চাই; একই সঙ্গে যেন একটা ইতিবাচক বার্তাও থাকে।

ফিল্ম সিন্ডিকেট কেন আলোচনায়

নিজেদের গল্প পর্দায় খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারটি আছেই, সঙ্গে তাকদীর, ঊনলৌকিক, কাইজার বা কারাগার-এর সংলাপও ছিল অন্যতম চর্চার বিষয়। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টালমাটাল পুলিশের গোয়েন্দাকে নিয়ে সারা দুনিয়ায় এন্তার সিরিজ হয়েছে, তবে কাইজার ছিল বাংলা ওয়েব দুনিয়ার উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। সিরিজটি যতটা না চিত্রনাট্যের জন্য, তার চেয়েও বেশি আলোচনায় ছিল এর বুদ্ধিদীপ্ত ও রসাত্মক লেখনীর কারণে। সিরিজটির লেখক আয়মান স্বাধীন অচিরেই নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন।

এই প্রযোজনা সংস্থার সিরিজগুলো দেখলে অনুমান করা শক্ত নয়, তাদের অন্যতম শক্তির জায়গা পরিমিতিবোধ। সাইকোলজিক্যাল ড্রামা, ফ্যামিলি ড্রামা, থ্রিলার—বিভিন্ন ধরনের কাজ করে করেছে তারা। তবে সহজে হাততালি পাওয়া যাবে—এমন দৃশ্য খুব বেশি নেই কোনো কনটেন্টেই। হালের অনেক সিরিজই আবহ সংগীতের অতি প্রয়োগে দৃশ্যের আবেদন হারায়। এখানেও মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন লেখক, নির্মাতা ও প্রযোজকেরা। চেষ্টা করেছেন গল্প বলার সময় বাস্তবঘেঁষা থাকতে।

তাকদীর ও কাইজার-এ অভিনয় করা অভিনেত্রী রিকিতা নন্দিনী শিমু মনে করেন, ফিল্ম সিন্ডিকেট শিল্পীদের মধ্যে স্বস্তির জায়াগাটা তৈরি করতে পারে, যার প্রভাব কাজেও পড়ে। শিমু বলেন, ‘তাদের পেশাদারি আমাকে মুগ্ধ করে। পরে যখন আমি হয়তো অন্য কোনো কাজ করতে যাই, তাদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা মিস করি।’

এই প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে কাজ করে প্রায় ‘হারিয়ে যাওয়া’ যাওয়া অভিনেতাদের যেমন পাওয়া গেছে, তেমনই কেউ আবার তারকা থেকে হয়ে উঠেছেন আন্তর্জাতিক তারকা। দেশের অভিনয়শিল্পীদের যথাযথভাবে ব্যবহার না করার যে আক্ষেপ বারবার শোনা যায়, সেটাও অনেকটা ঘুচিয়েছে সিরিজগুলো। প্রথমেই বলা যাক ইন্তেখাব দিনারের কথা। এই অভিনেতা পর্দা থেকে যেন প্রায় ‘নেই’ হয়ে গিয়েছিলেন। চরকির অ্যান্থোলজি সিরিজ ঊনলৌকিক-এর শেষ পর্ব ‘দ্বিখণ্ডিত’-তে সুযোগ পাওয়াকে তিনি নিজেই বলেছেন তাঁর ‘দ্বিতীয় জীবন’ পাওয়া হিসেবে।

ইন্তেখাব দিনার বলেন, ‘“দ্বিখণ্ডিত” আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। এটা আমাকে দ্বিতীয় জীবন দিয়েছে। আগে আমি কোনো কাজের জন্য এমন প্রশংসা পাইনি। এটা আমার অসম্ভব ভালো লাগছে। দর্শকদের ভালো লাগার জন্যই কাজ করি। কাজের জন্য কেউ প্রশংসা করলে কাজের জায়গায় দায়বদ্ধতা বেড়ে যায়।’

ঊনলৌকিক ছাড়াও ফিল্ম সিন্ডিকেটের সঙ্গে তাকদীর, জাগো বাহে, কারাগার-এ কাজ করেছেন দিনার। ফিল্ম নোয়ার সঙ্গে করেছেন জাগো বাহে। এখন করছেন নতুন আরেকটি কাজ। এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করাকে অসাধারণ অভিজ্ঞতা হিসেবে উল্লেখ করতে চান তিনি। তাঁর ভাষ্যে, একজন শিল্পীকে তৃপ্ত করার জন্য যা যা দরকার, সেটার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ফিল্ম সিন্ডিকেট। এটা নিয়ে দিনার প্রায়ই মজা করে বলে থাকেন, ‘ওদের সেটে কেবল শরীরটা নিয়ে গেলেই হয়, বাকিটা এমনি এমনি চলে আসে।’ তিনি মনে করেন, ফিল্ম সিন্ডিকেট কাজটাকে উপভোগ্য করে তোলে। ‘ওরা খুবই পেশাদার; কাজের প্রতি, শিল্পীর প্রতি ওরা যে যত্ন আর শ্রদ্ধা দেখায়—সবকিছু মিলিয়ে দারুণ অভিজ্ঞতা।’ বললেন তিনি।

চঞ্চল চৌধুরী ভালো অভিনেতা, দেশের অন্যতম শীর্ষ তারকাদেরও একজন—এটা সবারই জানা। কিন্তু তাকদীর, ঊনলৌকিক, কারাগার-এর পর ভারতে যেভাবে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন, এটা আগে কে ভেবেছিল। চঞ্চল মনে করেন, মানসম্পন্ন কাজই ফিল্ম সিন্ডিকেটকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে। তিনি বলেন, ‘ওখানে যারা আছে, প্রোডাকশন ডিজাইন যারা করে বা নির্মাতা—সবাই সবাই খুব মেধাবী। সেটা তানিম (তানিম নূর) বলি বা শাওকি (সৈয়দ আহমেদ শাওকি) বলি, অনীম (সালেহ সোবহান) বলি; এ ছাড়া যারা আছে, সবাই মেধাবী। সেটা ওদের সঙ্গে যে কাজগুলো করেছি, তাতেই বোঝা যায়। ওদের গল্প ভালো। এই ভালো গল্প নিয়ে ওরা আবার অনেক দিন কাজ করে। গবেষণা, প্রোডাকশন ডিজাইনও ভালো, শিল্পী নির্বাচনও যৌক্তিক হয়। প্রিপ্রোডাকশন, নির্মাণ, পোস্টপ্রোডাকশন—সবই খুব পেশাদারির সঙ্গে করে।’

ফিল্ম সিন্ডিকেটের নির্মাতা, লেখক, প্রযোজকেরা জানান, তাঁরা যেকোনো কাজের জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি নেন; এটাই হয়তো তাঁদের কাজগুলোকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। আর এর মূলে রয়েছে ‘সিনেমাপ্রেম’। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের এই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল কারাগার-এ অভিনয় করা তাসনিয়া ফারিণের ভাষ্যেও। এত গোছানো টিমের সঙ্গে খুব কমই কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর। এই সময়ের অন্যতম আলোচিত এই তারকা মনে করেন, ফিল্ম সিন্ডিকেটের সবেচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো, তারা প্রিপ্রোডাকশনে অনেক সময় দেয়। চিত্রনাট্য থেকে শুরু করে টুকিটাকি পরিকল্পনা—সবই গোছানো থাকে। প্রতিটি চরিত্রের বিস্তারিত থাকে। কেন চরিত্রটি, কী করছে, চিত্রনাট্য সংশোধন, বারবার শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলা, অনুশীলন করা, নিজেদের মধ্যে বসে তর্কবিতর্ক করা, গল্পের দুর্বলতা বের করে নিজেরা সমাধনের চেষ্টা করা—সব মিলিয়ে তাদের কাজের পরিবেশটা আলাদা। এই টিমের সবাই চেষ্টা করে যে রিসোর্স আছে, সেটার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে। তাই শুটিংয়ে শিল্পী হাজির হলে আপনা-আপনিই পরিবেশটা তৈরি হয়ে যায়।

উদাহরণ দিয়ে ফারিণ বলেন, ‘যেমন আমি কারাগার-এ কাজ করছিলাম, সেটের পুরো পরিবেশ অন্য রকম ছিল। সবাই নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করত। মনে হতো, আমরা যেন সিরিজটির আবহের মতো সেই দুই শ বছর আগেই ফিরে গেছি। পরিবেশটা তৈরি করতে সবাই পারে না। যেমন আমার সঙ্গে চঞ্চল ভাইয়ের প্রশ্নোত্তর পর্বের দৃশ্য দারুণভাবে করা হয়েছে। ওদের সেটে যে যার কাজটা ভালোভাবে জানে, সেটা করার চেষ্টার করে।’

নতুনের বারান্দা

ফিল্ম সিন্ডিকেট মনে করে, দেশি কনটেন্টের চেহারা বদলে দিতে আরও নতুন নতুন কাজ দরকার; দরকার আরও অনেক নতুন ছেলেমেয়ের। প্রযোজনা সংস্থাটি সব সময়ই নতুনদের পাশে দাঁড়াতে চায়। ফিল্ম সিন্ডিকেট তাকদীর বানিয়েছে, সেটা আবার তেলেগুতে রিমেকও হয়েছে। তার মানে, মোহাম্মদপুরে গল্পটি ছিল, প্রয়োজন ছিল খুঁজে বের করে বানানো। এটা হয়ে যাওয়ার পর সিন্ডিকেটের ঘাড়েও দায়িত্ব পড়েছে পরের তাকদীর  খুঁজে বের করার। সেটা তারা বানাবে, নাকি অন্য কেউ বানাবে, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়; গুরুত্বপূর্ণ হলো গল্পটা সবার সামনে নিয়ে আসা। সিন্ডিকেট এখন বাংলাদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এমন গল্প খুঁজে বের করতে চায়, নতুন লেখকদেরও সুযোগ দিতে চায়।

নতুন কেউ যদি নিজের আইডিয়া নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়, সে সোজা ফিল্ম সিন্ডিকেটের অফিসে রওনা দিতে পারে। গল্প পছন্দ হলে সেটার চিত্রনাট্য তৈরি, এমনকি ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কাছে বিক্রিরও দায়িত্ব নেবে প্রযোজনা সংস্থাটি। তারা এর মধ্যে সেটা করেওছে। চলতি বছরেই এমন একটি সিরিজ আসবে, যেটা নিয়ে বড় ফ্র্যাঞ্চাইজি করতে চায় তারা। এই সিরিজ বানাবেন এমন এক নির্মাতা, যিনি আগে স্রেফ কেবল একটি মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করেছিলেন! কিন্তু তাঁর আইডিয়ার মধ্যে ‘বারুদ’ থাকায় বড় ফ্র্যাঞ্চাইজি করার পরিকল্পনা করতে দুবার ভাবেনি ফিল্ম সিন্ডিকেট৷

তারা মনে করে, অন্য সৃজনশীল মননকে সামনে নিয়ে আসা তাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তবে সংকটও কম নেই। নতুন কনটেন্ট নিয়ে কাজ করতে হলে অনেক নতুন লেখক দরকার। কিন্তু দেশে লেখালেখি বা নির্মাণ সেভাবে পেশা হয়ে উঠতে পারেনি। মীর মোকাররম হোসেন বললেন, ‘আমাদের যে অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠান আছে, সেখান থেকে বাণিজ্যিক কাজ করি, এটা আমাদের জীবিকা। ফিল্ম সিন্ডিকেটের কাজগুলো আমরা করি প্যাশনের জায়গা থেকে, এটাও এখনো আমাদের জীবিকা হয়ে উঠতে পারেনি। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। নতুন যাঁরা লেখালেখি করছেন, তাঁদের জন্য যদি আমরা একে জীবিকার জায়গা করে তুলতে না পারি, তাহলে তাঁদের ধরে রাখতে পারব না। তাঁরা অন্য পেশায় চলে যাবেন।’

কথায় কথায় মীর মোকাররম হোসেন জানান ফিল্ম সিন্ডিকেট নিয়ে নিজেদের স্বপ্নের কথাও, ‘ভাষাভাষীর সংখ্যার বিচারে বাংলা হয়তো পৃথিবীর পঞ্চম ভাষা, কিন্তু চলচ্চিত্রের দিক থেকে আমাদের অবস্থান বহু পিছিয়ে। সেটা তো হওয়ার কথা ছিল না। আমরা যদি অনেক মানুষকে যুক্ত করতে পারি, অনেকগুলো সৃজনশীল মননকে সামনে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে হয়তো বাংলা কনটেন্টকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব। আমরা অনেক সংগ্রাম করেছি ঠিক; কিন্তু আমরা চাই এখন যারা নতুন কাজ করছে, তাদের যেন ওই সংগ্রাম করতে না হয়। তারা যেন প্ল্যাটফর্ম পায়। আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা নিয়ে তাদের সৃজনশীল মনের দুয়ার খুলে হয়তো সাহায্য করতে পারব।’

আসছে সিনেমা

তাকদীর, কারাগার, কাইজার, ঊনলৌকিক, জাগো বাহের মতো সিরিজের জন্য পরিচিতি ফিল্ম সিন্ডিকেটের। জানা গেল চলতি বছরই সিনেমা নির্মাণ করবে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি। ফিল্ম সিন্ডিকেটে নির্মাতা আছেন চারজন—তানিম নূর, সৈয়দ আহমেদ শাওকি, সালেহ সোবহান অনীম ও কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়। চারজনেরই চারটি চিত্রনাট্য চূড়ান্ত। এর মধ্যে কে আগে সিনেমা বানাবেন তা ঠিক হয়নি। তবে এই চারজনের একজনই যে বানাবেন, সেটা নিশ্চিত।

২০২০ থেকে ২০২২—একটানা দর্শকনন্দিত সিরিজ এনেছে ফিল্ম সিন্ডিকেট। এরপর বিরতি। গত দেড় বছর নতুন প্রজেক্ট পাওয়া যায়নি এই তরুণ নির্মাতাদের কাছ থেকে। কেন এই বিরতি? বড় কিছু নিয়ে আসার জন্যই কি এই দম নেওয়া? নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে এই বিরতি কতটা প্রয়োজন ছিল, তা শাওকি জানালেন, ‘এই সময়ে আমরা নিজেদের দুর্বলতা খুঁজে বের করি, সক্ষমতা বাড়াই। গত দেড় বছর আমরা গল্প খুঁজেছি, পরিকল্পনা সাজিয়েছি। এখন টানা কাজ আসবে।’

গত বছর রীতিমতো আয়োজন করে নতুন ১২টি প্রজেক্টের ঘোষণা দেয় ফিল্ম সিন্ডিকেট, যা ছিল দেশীয় কনটেন্টের জন্য অভিনব এক ঘটনা। সাধারণত নতুন কনটেন্টের ঘোষণা দেয় প্ল্যাটফর্মগুলো, কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। ফিল্ম সিন্ডিকেটটি বরং ১২টি প্রজেক্টের ঘোষণা দিয়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে কারা কোন কাজটি নিতে চায়। নতুন এই প্রজেক্টগুলো হলো ঊনলৌকিক ২, পেন্ডুলাম, গুলমোহর, ডেলটা ২০৫১, দ্বৈত, অদানব ও ফ্রেন্ডস উইদাউট বেনিফিটস। সিনেমার মধ্যে রয়েছে লোহানী, বাইপাস, খোঁয়ারি, পুলসিরাত ও হেল ব্রোক লুজ।

২০২১ সালে চরকিতে রবিউল আলম রবির ঊনলৌকিক মুক্তির পর দর্শকমহলে আলোচিত হয়েছিল। এবার তিনি ঊনলৌকিক ২ নিয়ে আসছেন। রহস্য সিরিজ গুলমোহর এবং ফিচার সিনেমা বাইপাস নির্মাণ করবেন তাকদীর ও কারাগার নির্মাতা সৈয়দ আহমেদ শাওকি। রহস্য থ্রিলার সিরিজ অদানব নিয়ে আসছেন পুনর্জন্ম–নির্মাতা ভিকি জাহেদ। ডেল্টা ২০৫১ নির্মাণ করছেন মানি হানির অন্যতম নির্মাতা কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়। ফিচার সিনেমা খোঁয়ারি ও পুলসিরাত নির্মাণ করবেন জাগো বাহে নির্মাতা সালেহ সোবহান।

ক্রাইম থ্রিলার সিনেমা লোহানী ও রহস্য সিরিজ পেন্ডুলাম নিয়ে আসছেন কাইজার নির্মাতা তানিম নূর। থ্রিলার রহস্য সিরিজ দ্বৈত নির্মাণের মধ্য দিয়ে নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন আয়মান আসিব ও সুস্ময় সরকার। আরও দুই নির্মাতার অভিষেক হচ্ছে ফিল্ম সিন্ডিকেটের হাত ধরে—রাজীব রাফি নির্মাণ করবেন হেল ব্রোক লুজ এবং রিয়াদ আরফিন নির্মাণ করছেন ফ্রেন্ডস উইদাউট বেনিফিটস। এই ১২টি থেকে দু-একটি বাদ যেতে পারে, যুক্ত হতে পারে নতুন কনটেন্ট। এখন যেমন কালপুরুষ নামে একটি সিরিজ আসছে, যেটিকে বড় ফ্র্যাঞ্চাইজিতে রূপ দিতে চায় প্রযোজনা সংস্থাটি। সিরিজটি এ তালিকায় ছিল না।

বক্স: ১

কিছু তথ্য

সালেহ সোবহান অনীম পরিচালনার পাশাপাশি সম্পাদনা, কালার গ্রেডিংসহ পোস্টপ্রোডকশনেও দক্ষ। তাকদীর নির্মাণের পর বাজেট শেষ হয়ে গেলে অনীম নিজেই সম্পাদনা শিখে এর পোস্টপ্রোডাকশন শেষ করেন!

তাকদীর বা কারাগার যতই প্রশংসা পাক না কেন, দীর্ঘ বিরতি দিয়ে নির্মাণ করতে চান শাওকি। কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন, এক জীবনে তাঁর মাথায় পাঁচ থেকে ছয়টি গল্পই হয়তো আসবে। সেগুলো এত তাড়াতাড়ি বানিয়ে শেষ করার মানে হয় না।

তাকদীর-এর অন্যতম লেখক নেয়ামত উল্যাহ মাসুমের জন্য সেটাই ছিল প্রথম সিরিজের চিত্রনাট্য। এর আগে সর্বোচ্চ ২০ পৃষ্ঠা লিখেছিলেন তিনি।

তাকদীর-এর গল্প শাওকির মাথায় আসে হইচইয়ের হেড অব কনটেন্টের সঙ্গে মিটিংয়ে যাওয়ার সময়।

ফিল্ম সিন্ডিকেটে সব সময়ের জন্য চারজন সবেতন লেখক কাজ করেন।

ফিল্ম সিন্ডিকেট নামটা প্রথম মাথায় এসেছিল তানিম নূরের। মাথায় ছিল ম্যারি পিকফোর্ড, চার্লি চ্যাপলিন, ডগলাস ফেয়ারব্যাংকস, ডি ডব্লিউ গ্রিফিতদের ‘ইউনাইটেড আর্টিস্ট’ আর অনুরাগ কাশ্যপ, বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানি, বিকাশ বেহেল, মধু মন্টেনাদের ‘ফ্যান্টম ফিল্মস’-এর কথা।

আনুষ্ঠানিকভাবে ফিল্ম সিন্ডিকেটের সদস্য না হয়েও নির্মাতারা প্রযোজনা সংস্থাটির সঙ্গে কাজ করেন। যেমন রবিউল আলম রবি বা ভিকি জাহেদ।

শাওকির সব কাজেই সমাজের প্রান্তিক মানুষের গল্প উঠে আসে। প্রথম সিরিজ তাকদীর-এ ছিল যৌনকর্মীর গল্প, কারাগার-এ ছিল যুদ্ধশিশু। নতুন কাজ গুলমোহর-এও থাকবে এমন কিছু।

বক্স: ২

সিন্ডিকেটের কান্ডারিরা

মীর মোকাররম হোসেন, প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ফিল্ম সিন্ডিকেট

শুরু সাংবাদিকতা দিয়ে। এরপর যুক্ত হন কনটেন্ট প্রযোজনায়। ২০১২ সালে শুরু করেন প্রযোজনা সংস্থা বক্স অফিস। সবার ‘বড় ভাই’ হয়ে আগলে রাখেন; স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশি কনটেন্ট বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার।

রোমেল চৌধুরী, প্রযোজক

ক্যারিয়ার শুরু করেন লেখালেখি দিয়ে। পরে মানি হানি, একাত্তর, কন্ট্রাক্ট, ইতি তোমারই ঢাকা, তাকদীর, কাইজার, কারাগার, কোক স্টুডিও বাংলা ইত্যাদি কনটেন্টের প্রযোজক হিসেবে যুক্ত ছিলেন।

রেহমান সোবহান সনেট, নির্মাতা, প্রযোজক

তথ্যচিত্র ছাড়াও নানা ধরনের ভিডিও কনটেন্ট বানিয়েছেন। প্রজন্ম টকিজ, কথা হবে তো, তাকদীর, ঊনলৌকিক, জাগো বাহে, কারাগার-এর অন্যতম প্রযোজক।

তানিম নূর, নির্মাতা

২০১১ সালে প্রযোজনা সংস্থা ডোপ প্রোডাকশন শুরু করেন। ফিরে এসো বেহুলা, মানি হানি, কন্ট্রাক্ট, কাইজার-এর নির্মাতা।

সৈয়দ আহমেদ শাওকি, নির্মাতা ও প্রযোজক

তাকদীর ও কারাগার–এর নির্মাতা হিসেবে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন। তবে ঊনলৌকিক আর জাগো বাহেতে কাজ করেছেন লেখক ও প্রোডাকশন ডিজাইনার হিসেবে।

কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়, নির্মাতা

প্রচুর বিজ্ঞাপনচিত্র বানিয়েছেন। মানি হানি ও কন্ট্রাক্ট-এর নির্মাতা। কোক স্টুডিও বাংলার ভিজ্যুয়াল পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন।

সালেহ সোবহান, নির্মাতা, সম্পাদক ও প্রযোজক

তাকদীর, ঊনলৌকিক, জাগো বাহে, শাটিকাপ, কাইজার, কারাগার, ক্যাফে ডিজায়ার, গুটির সম্পাদনা তিনি করেছেন। কয়েকটি কনটেন্টের তিনি অন্যতম প্রযোজকও।