চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর আজ ৫০তম জন্মদিন। নির্মাতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর থেকে সিনেমাসহ নানা কারণেই তিনি আলোচিত হয়েছেন বারবার। কেন তিনি আলোচনায় থাকেন, তার সুলুক সন্ধানেই এই লেখা।
দুই দশক ধরে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নানা কারণেই আলোচিত। অনেক সময়ই ‘টক অব দ্য টাউন’ হয়ে ওঠে তাঁর নির্মাণগুলো। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, তাঁর ক্ষেত্রে কেন এমন ঘটে?
চরিত্রায়নে ফারুকী বদল এনেছেন অনেকটাই। তাঁর নির্মিত নাটক–সিনেমাগুলোয় আনুষ্ঠানিকতার খোলস থেকে মুক্ত হয়েছে অভিনয়। শুধু কি এসব কারণেই তিনি আলোচিত হন, নাকি ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেও বিষয়টি দেখার সুযোগ রয়েছে?
ফারুকীর ছবিতে সমাজের এমন সব বিষয়–আশয় উঠে আসতে দেখি, সমাজের মধ্যে যার অস্তিত্ব থাকলেও সমাজ তা নিয়ে একরকম মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। যেমন লিভ ইনের মতো স্পর্শকাতর বিষয় উঠে আসে তাঁর ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ সিনেমায়। অর্থাৎ আমাদের সমাজে যা যা ঘটে, কিন্তু যা নিয়ে আমরা কথা বলি না, তা অবলীলায় ফারুকী তুলে আনেন তাঁর সিনেমার ফ্রেমে।এইভাবে যা নিয়ে সমাজ আড়ালে–আবডালে ফিসফিস করে কথা বলে, সেসব কিছু সহজ সাবলীলভাবে নিজের সিনেমায় তুলে ধরার কারণেও পক্ষে–বিপক্ষে আলোচনায় থাকে ফারুকীর সিনেমা।
একটা বিষয় লক্ষণীয় যে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এ সময়ের অন্যতম নির্মাতা, যিনি এক নন, দলবলসহ প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছেন। যদিও তাঁর ‘ভাই-বেরাদর’ গ্রুপে কেন সে অর্থে নারী নির্মাতা নেই, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবু যাঁদের নিয়ে ফারুকীর এই দল, তাঁদের মধ্যে অনেকেই আজ কেবল শুধু প্রতিষ্ঠিতই নন, বরং নির্মাণের দিক থেকেও উল্লেখযোগ্য কাজ করে চলেছেন। এই যেমন ‘মহানগর’–খ্যাত নির্মাতা আশফাক নিপুন কিংবা বাংলাদেশের অন্যতম স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম চরকির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেদওয়ান রনি। এবং এই প্রক্রিয়া চলমান বলেই দেখা যায়, নির্মাতা ফারুকীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আপনজন আছেন, যাঁরা প্রকৃত অর্থেই তাঁর নির্মাণযাত্রার সঙ্গী—প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে।
আজ ২ মে, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর যে ৫০তম জন্মদিন, তা ‘ছবিয়াল’-এর প্রাক্তন বা বর্তমান যে কারও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রোফাইলে গেলেই বোঝা যাবে। সবাই ফারুকীকে ‘মেন্টর’ হিসেবে বছরের পর বছর স্বীকার করে গেছেন, যাচ্ছেন। এটা নির্মাতা ও ব্যক্তি মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর অন্যতম ইতিবাচক দিক বটে।
এবার যদি নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নির্মাণযাত্রার দিকে লক্ষ করা যায়, দেখা যাবে যে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তিনি নির্মাণকৌশলে ভিন্নতা আনার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সেই কৌশল এমন, যা মানুষকে দ্বন্দ্বে ফেলে এবং যা নিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে নাটক–সিনেমায় কথ্য ভাষার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য, যা মানুষকে ইতি ও নেতিবাচকতা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের মাঝখানে ফেলে দেয়। এমনকি নির্মাণের বিষয়বস্তু নির্বাচনও একটা বিশেষ কারণ ফারুকীর ‘টক অব দ্য টাউন’ হয়ে ওঠার।
২০০৪ সালে ‘ব্যাচেলর’ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ হলো, এর আগে চলচ্চিত্রে এইভাবে সে সময়কার ব্যাচেলরদের জীবন মানুষ আর কোথাও দেখেনি। তাই অধিকাংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণির তরুণ সে সময় নিজেরই যাপিত জীবনের কাছাকাছি গল্প দেখে ওই সিনেমার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিলেন, একাত্ম বোধ করেছিলেন।
আবার আমরা ফারুকীর ছবিতে সমাজের এমন সব বিষয়-আশয় উঠে আসতে দেখি, সমাজের মধ্যে যার অস্তিত্ব থাকলেও সমাজ তা নিয়ে একরকম মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। যেমন লিভ ইনের মতো স্পর্শকাতর বিষয় উঠে আসে তাঁর ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ সিনেমায়। অর্থাৎ আমাদের সমাজে যা যা ঘটে, কিন্তু যা নিয়ে আমরা কথা বলি না, তা অবলীলায় ফারুকী তুলে আনেন তাঁর সিনেমার ফ্রেমে।
এইভাবে যা নিয়ে সমাজ আড়ালে–আবডালে ফিসফিস করে কথা বলে, সেসব কিছু সহজ সাবলীলভাবে নিজের সিনেমায় তুলে ধরার কারণেও পক্ষে–বিপক্ষে আলোচনায় থাকে ফারুকীর সিনেমা। তাঁর ‘টেলিভিশন’–এর কথাই বলা যাক, এতে যে শুদ্ধ ধর্মীয় আবেগ মূর্ত হয়, তা–ও কি এই অঞ্চলের মানুষকে আপ্লুত বা সংযুক্ত করে না নির্মাতার সঙ্গে? এমনকি সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংলাপে, চরিত্রের চিত্রায়নে তুলে আনার ক্ষেত্রে ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান’ও উল্লেখযোগ্য।
মোট কথা, নাটক, সিনেমা বা সিরিজ নির্মাণের ক্ষেত্রে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এমন সব বিষয় বেছে নেন, যা সমাজের মধ্যে চলমান এবং যা নিয়ে লোকমানসে কৌতূহল আছে। এ ক্ষেত্রে ‘ডুব’ বা মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ‘শনিবার বিকেল’ চলচ্চিত্রটিকেও উদাহরণ হিসেবে আনা যায়।
সমাজ তার নিজের প্রয়োজনেই কিছু নিয়ম তৈরি করে, এমন সব দৃশ্যকে সব সময় সমাজ সামনে আনতে চায়, যা তার পক্ষে নিরাপদ ও স্বস্তিকর। কিন্তু অধিকাংশ নির্মাণের ক্ষেত্রে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সেই সব গল্পই তুলে ধরতে চান, সমাজের গলি–ঘুপচিতে যা ঘটে এবং যা নিয়ে নিয়মনিষ্ঠ সমাজ কিছুটা অস্বস্তিতেও থাকে।
মানুষের আদিম তৃষ্ণা এই যে মানুষ যা জানে, সেই গল্পই সে আবার শুনতে চায় এবং দেখতে চায়। ফারুকী আমাদের সেসব গল্পই দেখান। আর এই নির্মাতার আরেকটা ব্যাপার হলো, এ অঞ্চলের মানুষের মনস্তত্ত্ব এবং বোঝাপড়া তাঁর ভালোভাবেই জানা। ফলে তিনি মানুষকে ট্রিগার করার পয়েন্টটিও ভালোভাবে বুঝতে পারেন। এটিও তাঁর কাজ এবং তাঁকে নিয়ে আলোচনা ও তর্ক–বিতর্ক হওয়ার একটি বড় কারণ।
আজ মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর জন্মদিনে তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য নির্মাণ নিয়ে কথা বলেই অকিঞ্চিৎকর এ লেখার ইতি টানব। ফারুকীর এমন একটি কাজ আছে, যা নিয়ে অনেক আলোচনা হওয়ার কথা থাকলেও তেমন কথা হয়নি। সত্তর দশকের পটভূমিতে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের ‘আয়েশামঙ্গল’ উপন্যাস অবলম্বনে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ‘আয়েশা’ নামে একটি টেলিফিল্ম নির্মাণ করেছিলেন। একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কী করে ব্যক্তিমানুষের, বিশেষত সহজ-সরল এক মেয়ের সংসারজীবনকে ছারখার করে দেয়, সেই গল্পের নির্মাণ নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য এবং সেই সংলাপও মনে রাখার মতো। যখন আয়েশা নিখোঁজ হওয়া স্বামীকে খুঁজে না পেয়ে বলে, ‘আমি তো জানি না, আমার স্বামীর কবর কই, তাই এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলই আমার স্বামীর কবর।’
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এভাবে নানা কিছু দিয়ে অন্তরে ঘা দেওয়ার চেষ্টা চালান। সেই ঘা খেয়ে প্রথমত মানুষের খানিকটা অস্বস্তি হয়। অতঃপর একসময় সবাই বুঝতে পারেন, তাঁকে নিয়ে তাঁরা তর্ক–বিতর্ক করছেন। এই পরম্পরায় তাঁর নির্মাণগুলোও আলোচিত হয়ে, হয়ে উঠতে থাকে ‘টক অব দ্য টাউন’। আসলে নির্মাণ ও যাপন দিয়ে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এমন এক নির্মাতা, যাঁকে অগ্রাহ্য করা যায় না কিছুতেই।