একাত্তরে ঈদের দিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যেসব অনুষ্ঠান প্রচার হয়েছিল

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অবদান ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। ১৯৭১ সালে এই বেতারের বহুমাত্রিক ভূমিকা যেমন আলোড়ন তুলেছিল, তেমনি এর খবর ও অনুষ্ঠান কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাণিত যুদ্ধাস্ত্রের চেয়ে শক্তিশালী হিসেবে কাজ করেছিল। যুদ্ধের একটি বড় এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। এর প্রভাব এত তীব্র যে ক্ষেত্রবিশেষে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বদলে দেয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পরিচালনার কার্যক্রম ঈদুল ফিতরের দিনও অব্যাহত ছিল।

১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর, শনিবার ছিল ঈদুল ফিতর। এদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা—এই তিন অধিবেশনে প্রচারিত অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে অন্য রকম এক ঈদের কথা বলা হয়েছিল। অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে যেমন ঈদের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছিল, একইভাবে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধির জন্যও ছিল নানা আয়োজন।

বাঙালির জীবনে একাত্তরের ঈদ যে স্বাভাবিক কোনো ঈদ ছিল না, সেই বার্তা প্রতিফলিত হয়েছিল প্রতিটি অনুষ্ঠানে। ঈদের দিন প্রথম অধিবেশনে সকাল ৭টায় কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয় স্বাধীন বাংলা বেতারের দিনের কার্যক্রম। এরপর বাংলা ও ইংরেজিতে খবর পরিবেশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অধ্যায়ের তথ্য পাওয়া যায় হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র–এর পঞ্চম খণ্ড, বেতারের শব্দসৈনিক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণায়।

ঈদের দিনের অনুষ্ঠানমালার মধ্যে মানুষকে সবচেয়ে আন্দোলিত ও আলোড়িত করেছিল ‘চাঁদ তুমি ফিরে যাও’ শিরোনামের একটি গান।

সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে প্রচারিত এ গান লিখেছিলেন শহীদুল ইসলাম। সুর করেছিলেন অজিত রায়। আর এটি কোরাসে গেয়েছিলেন শিল্পী রূপা ফরহাদসহ অনেকে। গানের কথায় চোখ বোলালে সেই যুদ্ধদিনে মানুষের মানসিকতা উপলব্ধি করা যাবে।
‘চাঁদ তুমি ফিরে যাও...
দেখো মানুষের খুনে খুনে রক্তিম বাংলা
রূপসী আঁচল কোথায় রাখব বলো?’

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক কামাল লোহানীর স্মৃতিচারণায় ধরা আছে এই মর্মন্তুদ গান তৈরি ও প্রচারের ইতিহাস। তিনি জানান, ঈদের দুই দিন আগে গানটি রেকর্ড করা হয়। গানের মাধ্যমে ঈদের চাঁদকে ফিরে যেতে বলার মতো ঘটনা একাত্তরের আগে এবং পরে শুধু বাঙালি মুসলমানদের জীবনেই নয়, মুসলিম বিশ্বের আর কোথাও হয়েছে বলে জানা যায়নি। একাত্তরের ঈদ যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাঙালির কাছে কতটা অপ্রত্যাশিত ছিল, এই গানের মাধ্যমে তা খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে ফুটে উঠেছিল। গানটির আবেগঘন আবেদন এত তীব্র ছিল যে মানুষ ঈদের দিন এই গান শুনে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন।

এ প্রসঙ্গে স্মৃতিকথায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক ওয়াহিদ লেখেন, ‘...স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সারা দিন বেজেছিল অত্যন্ত আবেগময় অশ্রুসিক্ত এই গান, যা শুনে সেদিন চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। কেঁদেছি, শুধু কেঁদেছি।’ (সূত্র: বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৮ জুলাই ২০১৬)
আগেই বলা হয়েছে, একাত্তরের ঈদ স্বাভাবিক ঈদ ছিল না। বেতারে ‘রমজানের ওই  রোজার শেষে’ শিরোনামের স্মৃতি আলেখ্যে এই ঈদকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছিল, ‘ঈদের আহত চাঁদের গা বেয়ে যেন ঝরছে চাপ চাপ রক্ত’। সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে প্রচারিত এই স্মৃতি আলেখ্য রচনা করেন সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। প্রযোজক ছিলেন মেসবাহ আহমেদ। স্মৃতি আলেখ্যের ভাষা ছিল অত্যন্ত হৃদয়ছোঁয়া। লেখক খুবই দক্ষতার সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের করুণ বাস্তবতায় আসা ঈদকে তুলে ধরেন এভাবে—
‘... ঈদের আহত চাঁদের গা বেয়ে যেন ঝরছে চাপ চাপ রক্ত। বাংলার আকাশ আজ লাল, মাটি আজ লাল। হেমন্তে পাখি গান গায় না। নবান্নের ধান কুমারী মেয়ের মতো বাতাসের প্রথম সোহাগে আর আন্দোলিত হয় না বাংলাদেশের সবুজ ক্ষেত। শাওয়ালের চাঁদ, ...এসেছ রক্তাক্ত দেহে। এসেছ নিহত শিশু আর নারীর লাশের ছবি বুকে গেঁথে।

‘ওরে বাংলার মুসলিম তোরা কাঁদ
এনেছে এজিদ বাংলার বুকে মহররমের চাঁদ।
এসেছে কাসেম, এসেছে সখিনা, সারা দেহে হায় তপ্ত খুন
আজ নয় ঈদ, আজ কোটি কোটি মুখে ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন।’

প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর নাতি ইমাম হোসেনের সঙ্গে কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনার সঙ্গে পাকিস্তানিদের এদেশীয় দোসর ও শীর্ষ দালালদের ভূমিকা তুলনা করে স্মৃতি আলেখ্যে আরও বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধুর মুক্তির সংগ্রামের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বাংলার কিছু বিশ্বাসঘাতক মুসলমান। তাদের মধ্যে নুরুল আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী, ফরিদ আহমদ, কাসেম সোলায়মান, খাজা খায়রদ্দি, গোলাম আজম, মাহমুদ আলী গয়রহ অন্যতম।’

স্মৃতি আলেখ্যটি শেষ হয় কোরাসে কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ‘রমজানের ওই রোজার শেষে’ গানটি গাওয়ার মধ্য দিয়ে।

সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে ছিল ‘বজ্রকণ্ঠ’ (বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ) এবং মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান। এরপর শেষ হয় প্রথম অধিবেশন।

দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয় বেলা ১টায়। উদ্বোধনী ঘোষণার পর যথারীতি বাংলা ও ইংরেজি খবর আর গান প্রচারিত হয়। বেলা ১টা ২৩ মিনিটে শুরু হয় জীবন্তিকা ‘রক্তে রাঙা ঈদ’। বদরুল হাসান রচিত জীবন্তিকাটি ঢাকার দুই যুবক শরীফ ও কবীরের কথোপকথনের সংলাপ দিয়ে শুরু হয়। কাজী নজরুল ইসলামের ‘কৃষদের ঈদ’ কবিতার উদ্ধৃতি উল্লেখ করে তাদের সংলাপে বলা হয়, সেখানে ক্ষুধার্ত কৃষকের ঘরে যেমন প্রতিদিনই রোজা, তাঁদের ঘরে আসা ঈদ যেমন আনন্দহীন, এবারের ঈদও তেমনই। কারণ, লাখ লাখ মানুষের লাশ বুকে নিয়ে সারা বাংলা যখন কবরস্থান,Ñনির্যাতিত শিশু, নারী, বৃদ্ধার কান্নায় বাংলা যখন ক্রন্দসী, মজলুম মানুষের ফরিয়াদে বিশ্বের বাতাস ভারাক্রান্ত, তখন ঈদকে খুশির ঈদ বলে মোবারকবাদ জানানো যায় না। এমন বাস্তবতায় বাঙালি মুসলমানের দ্বার থেকে ঈদের তো ফিরে যাওয়ারই কথা।

কিন্তু যুবক কবীর ঈদুল ফিতরকে ফিরে যেতে দিতে রাজি নয়। ঈদকে সে স্বাগত জানাতে চায় চলমান পরিস্থিতির নিরিখে এভাবে—
‘না, ফিরিয়েও দেব না আমরা। আমরা নতুনভাবে ঈদকে স্বাগত জানাব। (নেপথ্যে মেশিনগানের শব্দ।) ওই শোন,গুলির শব্দ—সংঘর্ষ চলছে হানাদারদের সাথে মুক্তিবাহিনীর। (একটু হাসি) ঢাকায় ঈদের চাঁদ দেখলে ছোট ছেলেরা পটকা ফুটাত উল্লাসে—আজকের পটকা ওই গুলির আওয়াজ, বোমার আওয়াজ।’

বেলা দেড়টায় ছিল পুঁথিপাঠ। শিল্পী শাহ বাঙালি ঈদ নিয়ে পুঁথি পাঠ করেন। ১টা ৪০ মিনিটে বুলবুল ওসমানের উপস্থাপনায় শুরু হয় ‘ছোটগল্প’ নামের সাহিত্যানুষ্ঠান। এরপর যন্ত্রসংগীত ও স্লোগান প্রচারিত হয়।

১টা ৫০ মিনিটে শুরু হয় সৈয়দ আলী আহসানের কথিকা। আর ২টা ৫ মিনিটে ‘রমজানের ওই রোজার শেষে’ স্মৃতি আলেখ্যটি পুনঃপ্রচারিত হয়। দ্বিতীয় অধিবেশন শেষ হয় বেলা ২টা ৩০ মিনিটে।

ঈদের দিন সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হয় তৃতীয় অধিবেশন। অধিবেশনের শুরুতে বাংলা ও ইংরেজি খবরের পর সোয়া ৭টায় ছিল বিশেষ সংগীত আলেখ্য ‘রক্ত রাঙা ঈদুল ফিতর’। আশরাফুল আলম প্রযোজিত এই সংগীত আলেখ্যর রচয়িতা ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। এর উপজীব্য ছিল আগে প্রচারিত হওয়া জীবন্তিকা ও স্মৃতি আলেখ্যর অনুরূপ—বাংলার জমিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিরীহ বাঙালিদের ওপর চালানো গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, নিপীড়ন ও নির্যাতনের ঘটনাগুলোই বিবৃত করা হয়।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিট থেকে রাত ৮টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত অনুষ্ঠানগুলো ছিল যথাক্রমে আশফাকুর রহমানের ‘অগ্নিশিখা’, ‘বজ্রকণ্ঠ’, হাফেজ আলীর সংগীত ‘ঈদুল ফিতর’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘কৃষকের ঈদ’ কবিতার পাঠ, বিশ্ববিবেক ও বাংলাদেশ, গান, আবু তোয়াব খানের ‘পিন্ডির প্রলাপ’ ও যুদ্ধের খবর।

৮টা ২৫ মিনিটে বাজানো হয় জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’। সাড়ে আটটায় ছিল আলমগীর কবীরের ইংরেজি অনুষ্ঠান।

রাত ৮টা ৫০ মিনিটে বাংলা ও ইংরেজি খবর, ৯টায় ‘পল্লীগীতি’ আর ৯টা ১০ মিনিটে আবদুর রাজ্জাক চৌধুরীর ‘সূর্যশপথ’সহ নানা অনুষ্ঠান শেষে সাড়ে ১০টায় শেষ হয় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রের ঈদের দিনের তৃতীয় অধিবেশন।

১৯৭১ সালে সারা দেশ যখন যুদ্ধের নেশায়, স্বাধীনতার আশায় উন্মুখ, তখন ঈদ নিয়ে ভাবার, উদ্‌যাপন করার সময় ছিল না বাঙালির; সর্বোচ্চ ত্যাগে স্বাধীনতা অর্জনই ছিল প্রধান লক্ষ্য।  তাই স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারিত ঈদের অনুষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য ছিলও একই—আনন্দ দেওয়ার বিপরীতে, মুক্তিবাহিনী ও সাধারণ বাঙালির মুক্ত হওয়ার নেশাকে আরও শাণিত করা।