পুরান ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে ইডেন কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রীদের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩
পুরান ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে ইডেন কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রীদের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩

ভাষা, প্রকৃতি ও সংস্কৃতি

অভিধানে ভাষার সংজ্ঞা এ রকম: ভাষা হচ্ছে সেই সব শব্দ ও তার প্রয়োগকৌশল, যা দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করা হয়। এ সংজ্ঞায় ভাষার দু–একটা বৈশিষ্ট্য জানায় মাত্র। যখন বলা হয়, ভাষা হচ্ছে নিজস্ব ভাব প্রকাশের ভঙ্গি, তখনো ভাষা সম্পর্কে খুব অল্প ধারণাই পাওয়া যায়। ভাষার কাজ এসবের চেয়ে বহুগুণ ব্যাপক। ভাষা কেবল ভাব নয়, অ-ভাবকেও প্রকাশ করে। ন্যায়-বৈশেষিক দর্শন এই অভাবের (নঞর্থকতা) ধারণা সামনে এনেছে। ভাষা ভাব-অভাবের উদ্​গাতাও বটে। ভাষা ছাড়া চিন্তার জন্ম হয় না। আবার যে বিষয়ে আমরা চিন্তা করতে পারি না, তার ‘অস্তিত্ব আছে’ এটাও বলা যায় না। কারণ, কোনো কিছুকে আমরা অস্তিত্বশীল হিসেবে দেখি ভাষার ভেতর দিয়ে। প্রশ্ন উঠতে পারে, ভাষা না থাকলে কি কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকত না? ভাষা না থাকলে সেই ‘কোনো কিছু’ ভাষার অতীত হিসেবে আমাদের উপলব্ধির আড়ালেই থেকে যেত। কাজেই ভাষার বিস্তার যতটুকু, ততটুকুই আমাদের চিন্তার বিস্তার। একইভাবে ভাষার মাপে আমরা জগতের সীমানাও মাপতে পারি। অর্থাৎ ভাষা আমাদেরকে যতটুকু দেখায়, আমাদের কাছে জগৎ ততটুকুই।

ভাষার ভেতর দিয়ে জগৎ দেখার মানে কী? মা যখন শিশুকে চাঁদ দেখিয়ে বলে, ‘আয় আয় চাঁদ মামা, টিপ দিয়ে যা’ কিংবা ‘ওরে আমার চাঁদমুখ রে!’ তখন শিশুর কাছে এসব বাক্যের ভেতর দিয়ে চাঁদ কথাটার মানে তৈরি হচ্ছে। নৈয়ায়িক বিশ্বনাথ সিদ্ধান্ত পঞ্চানন এ রকম সিদ্ধান্ত দেন তাঁর ভাষা-পরিচ্ছেদ বইয়ে। তিনি বলেন, ‘আমি’ কথার মানে খুঁজে পাওয়া যাবে ‘আমি-বাক্য’গুলোর ভেতর, যেমন ‘আমি খাই’, ‘আমি সুখী’, ‘আমি ভাবি’, ‘আমি অনুভব করি’ ইত্যাদি। কেউ হয়তো বলতে চেষ্টা করবেন, আমি তো এসব বাক্য নয়, ‘আমার দেহ আছে’, ‘মন আছে’। সিদ্ধান্ত পঞ্চানন বলবেন, ওগুলো সেই একই ‘আমি-বাক্য’ যা ‘আমি’র মানে তৈরি করছে। কাজেই ভাষা জগৎটাকে দেখাচ্ছে মানে, ‘কোনো কিছু’র সঙ্গে ‘অন্য কিছু’র সম্বন্ধ সৃষ্টি করছে। ভাষার দুনিয়া মানে এসব সম্বন্ধের দুনিয়া। তাহলে ভাষার বাইরে ‘কোনো কিছু’র অন্তর্বর্তী সত্তা বলে কি কিছু থাকছে না? ভাষা এসব সরল-জটিল সম্বন্ধ সৃষ্টির ভেতর দিয়ে যে ‘নির্মাণ’কে আমাদের মনের সামনে হাজির করছে, তার ভাষাতীত রূপটা কেমন?

এমন দাবি নিশ্চয়ই করা যায়, ভাষার মাধ্যমে যাকে আমরা সংস্কৃতিরূপে পাই, ভাষার অতীতরূপে সেটাই প্রকৃতি। প্রকৃতিকে ভাষার অতীত বলার কারণ, সেটা যখন ভাষার অধীন হবে, তখনই তা মানুষের নির্মাণ এবং এই নির্মাণই সংস্কৃতি। নৃবিজ্ঞানীরা যেমন বলেন, পরিবেশ-প্রকৃতির যে অংশটা মানুষ নির্মাণ করে, সেটাই সংস্কৃতি। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, মানুষের নির্মিত জগৎ, মানে ভাষাচিহ্নিত জগৎ, আর ততটুকুকেই আমরা জানি। সুতরাং উল্টোভাবে, ভাষার মধ্যস্থতায় যাকে আমরা হারিয়ে ফেলি, সেটা প্রকৃতি।

প্রকৃতিকে হারিয়ে সংস্কৃতিরূপে আমরা কী পেয়েছি? এখানে ‘আমরা’ কথাটি দিয়ে যা বোঝানো হচ্ছে, সেটা প্রাক্​সিদ্ধ নয়, মানে ‘আমরা’ আগে থেকেই ছিল না, ওই ভাষা-সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে তারা ‘আমরা’ হয়ে উঠেছে। এই ‘আমরা’ যা-ই পাক না কেন, প্রকৃতিকে হারিয়ে ফেলার বেদনা বোধ করি তার মনে সব সময় থেকে গেছে এবং তাকে ফিরে পাওয়ার বাসনাও হয়তো চিরস্থায়ী হয়ে আছে। ভাষা-প্রতীকের জগতে ঢুকে তারা যত কিছুই করুক না কেন, তুষ্ট হতে পারছে না। যেহেতু ভাষার ভেতর দিয়ে সে নিজেকে দেখতে পায়, দেখতে পায় নিজের কাজগুলোকে, সেটা নিমেষেই তার কাছে পুরোনো হয়ে যায় এবং তার তৃষ্ণা তাকে নতুন কিছুর দিকে ঠেলে দেয়। ফলে তার পাওয়া আর শেষ হয় না।

সংস্কৃতির অধীন হয়ে আমরা যা যা করি এবং যেসব বস্তুগত উপাদান ব্যবহার করি, দেখা যাবে, কিছু সম্বন্ধ সেগুলোকে একটা ছকের আকার দিয়েছে। ওই ছক আমাদের জীবনযাপনের নকশা। ভাষা বিশ্লেষণ করলেও আমরা ওই রকম ছক খুঁজে পাব। সংস্কৃতি মানেই নানা বিকল্প ও সহযোগের সম্বন্ধ, যেমন আমরা বিকল্প তৈরি করেছি—শার্ট নাকি পাঞ্জাবি, শাড়ি-ব্লাউজ নাকি সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবির সঙ্গে পায়জামা নাকি লুঙ্গি? আবার আছে পূর্বাপর এবং সামনে-পেছনের সম্বন্ধ—আগে মিস্টি নাকি ঝাল, ডাল আগে নাকি শেষে খাওয়া হবে, গোয়ালঘর আগবাড়িতে থাকবে নাকি পিছবাড়িতে। এ রকম হাজারটা সম্বন্ধ জীবনযাপনের ওই ছকে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট করে, যা দিয়ে জাতিসংস্কৃতি বলে একটা পরিচয়কে আলাদা করা হয়।

এখানে মনে রাখা দরকার, জীবনযাপনের এই ছক তৈরিতে ভাষা পুরোপুরি অন্তর্ভেদ্য হয়ে আছে, অর্থাৎ ব্যাপারটা ঘটছে ভাষার ভেতর দিয়ে এবং দুটি দিক এমনভাবে জড়াজড়ি করে আছে যে তাদেরকে আলাদা করা মুশকিল, যেমন কাউকে যখন আমরা ‘সভাপতি’ বলছি, তখন সভাপতি কথাটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকছে ওই সব সম্বন্ধের নকশা। এ কারণে সভাপতি সম্পর্কে কেউ যখন বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, ‘সভাপতি পেছনের সারিতে বসেছেন’, তখন এই বাক্যের বিশেষ তাৎপর্যটা আমরা ওই নকশার ভেতর দিয়ে বুঝতে পারি।

সংস্কৃতির মূর্ত ছকের ভেতর মানুষের ব্যবহৃত বস্তুগত উপাদান এবং তার কর্মকাণ্ডের অভাবনীয় বিকাশ ঘটেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সমাজ-সংস্কৃতির ছকগুলোকে অত্যন্ত জটিল করে তুলেছে। পাশাপাশি যেসব বিমূর্ত ছক মনোজগতে সৃষ্টি হয়ে চলেছে তার হিসাব-নিকাশ করা, তাকে ব্যাখ্যা করাও জটিল হয়ে উঠেছে একইভাবে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম ও রাজনীতির ক্ষেত্রগুলোকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নতুন নতুন পরিভাষা বানিয়েও কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। সংস্কৃতির এই জটিল উপাদানগুলোর কোনো কিছু প্রকৃতিতে নেই, পুরোটাই বাস্তব হয়ে উঠছে ভাষার মধ্যস্থতায়।

খেয়াল করলে দেখা যাবে, ভাষা কার্যকর হয়ে ওঠে বিকল্পায়ন ও সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের ভেতর দিয়ে। ভাষা কাজ করবে না যদি বাক্যের উদ্দেশ্য থেকে বিধেয়কে আলাদা করা না যায়। ভেদ বা বিকল্পের ধারণা ছাড়া ভাষা অসম্ভব। যেকোনো ধ্বনি-প্রতীককেই ভেদ-বিকল্পের ভেতর দিয়ে ভাষিক প্রতীক হয়ে উঠতে হয়। রহিম ও করিমের মধ্যে যদি পার্থক্য করা না যায়, তাহলে বাক্যের ভেতর ঢুকে দুজনের কেউই অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে পারবে না। প্রতীকগুলোর ভেদচিহ্নের ভেতর, ‘কাকা’ এবং ‘কা কা’র ওই সামান্য পার্থক্যটুকুর ভেতর কার্যকর হয়ে ওঠে ভাষা। কিন্তু প্রশ্ন এখানে, ভাষা যে বিকল্প ও ভেদ-বিভাজনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শ্রেণীকরণে তার কোনো উসকানি আছে কি না। নিশ্চয়ই নেই, কারণ ভাষা নিজে সচেতন নয়, বরং আমরা সচেতন হই ভাষার ভেতর দিয়ে।

এখানে একটা ব্যাপার নিশ্চিত করে বলা যায়, ভাষার অধীন হওয়ার পর মানুষ ভেদ-বিকল্পের জগতে পতিত হয়েছে। সে আত্ম-পর, উচ্চ-নিচ, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, যৌক্তিক-অযৌক্তিক ইত্যাদি প্রভেদ যেমন সৃষ্টি করেছে, তেমনই সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার পার্থক্যকেও অনুভব করেছে। তার মনে যতখানি সুখ, ততটাই দুঃখ। গৌতম বুদ্ধ না বললেও আমরা বুঝতে পারতাম, জগৎ দুঃখময়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যতই মনে করুন, জগতে অশুভ স্থায়ী কোনো সত্তা নয়, আমরা বুঝতে পারি, মানুষের সমাজে শুভের চেয়ে অশুভ কিছুমাত্র কম নেই। এখানে একের বিশ্বাসের উগ্রতা অন্যকে ঘায়েল করছে, একের বড়ত্ব অন্যকে ছোট করছে এবং একজনের স্বার্থ অন্যজনকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। মানুষ যত বেশি নতুন যুগের দরজা খুলছে, ততই বেশি করে সে অস্থির, অশান্ত ও অসুখী হয়ে উঠছে।

আছে ভাষা নিয়ে উদ্বেগ ও দুর্ভাবনা। এসব উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার নিগূঢ় কারণ বোধ করি এই যে ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব, আমাদের জাতিসত্তা। ভাষার বদলে যাওয়াটা আমাদের ভয় পাইয়ে দেয়। বহু ভাষা পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। প্রতিবছরই বেশ কিছু ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, বিভিন্ন জাতির হাজার দশেক ভাষা থেকে একবিংশ শতকে টিকে থাকবে মাত্র তিন শ ভাষা। ভাষার বিশুদ্ধতা নিয়েও আছে উদ্বেগ। সেটি কি এ জন্য যে বিশুদ্ধ ভাষা আমাদের পৌঁছে দিতে পারে বিশুদ্ধ চেতনায়? আমরা খোঁজ করি, কোনটা ‘খাঁটি বাংলা’। আমরা প্রশ্ন করি, কেন ভাগীরথী তীরে বাস করা দক্ষিণের লোকদের ভাষা আমাদের মানভাষা হবে? মানভাষার দরকারটাই–বা কী? এটা কি ক্ষমতার ভাষা? আমাদের খুঁজতে হয়, কোন ভাষায় আরবি-ফারসির গন্ধ বেশি, কোনটা সংস্কৃতগন্ধী আর কোনটা ইংরেজি-গন্ধী। একটা বিশুদ্ধ ভাষার স্বপ্ন আমাদেরকে সব সময় তাড়া করে।

কেবল বিশুদ্ধ ভাষার স্বপ্ন নয়, বিশুদ্ধ চেতনার স্বপ্নও কমবেশি আছে সব সমাজ ও সংস্কৃতিতে। কেউ নির্জনবাস করে, কেউ কৃচ্ছ্রসাধন করে, বৈরাগ্য বা সন্ন্যাস নিয়ে ইন্দ্রিয় সংযম করে, আবার কেউ বছরের পর বছর নীরব থাকার সাধনা করে। এসব সাধনার মূলে আছে বিশুদ্ধ চেতনার স্বপ্ন।

মানুষ তার সংস্কৃতি থেকে আবার কি প্রকৃতিতে ফিরে যেতে চায়? বুদ্ধ সংসার থেকে মুক্তির যে পথ দেখান, সেই পথের শেষে আছে নির্বাণ। নির্বাণ মানে নিভে যাওয়া। দুঃখ থেকে পরিত্রাণের জন্য তিনি সংসারের সমাপ্তি চেয়েছেন। তাঁর অনুসারী সহজিয়ারা ফিরতে চেয়েছে সহজ-স্বরূপে। কাহ্নপা বলেন, ‘সহজ’ বাক্যের অতীত, ভাষা দিয়ে একে বোঝানো যায় না। অর্থাৎ এটাই প্রকৃতি, যা থেকে সবকিছু এসেছে। রূপ-জগৎ যত বিচিত্রই হোক, তার পেছনে থাকা ‘সহজ’ নির্বিকল্প, সেখানে আত্ম-পর, উদ্দেশ্য-বিধেয়, এমনকি সংসার-নির্বাণের ভেদও নেই। এই সহজ-স্বরূপে পৌঁছানো গেলে মানুষ সহজ আনন্দ ফিরে পাবে। লালন ফকির বলেন, ‘মনের ভাব প্রকাশিতে/ভাষার উদয় এ জগতে/মনাতীত অধরকে চিনতে/ভাষা বাক্য নাহি পাবে।’ তিনি বলছেন, মনের জগৎটাই ভাষার জগৎ, মনের অতীত যা তাকে ভাষা দিয়ে পাওয়া যাবে না। তাকে পেতে হলে নিজের ভেতর নিজে ‘ফানা’ হতে হবে। কাজেই ‘আপনায় আপনি ফানা হয়ে’ যে ভেদ জানা যাবে, সেটাই বোধ করি সংস্কৃতি ও প্রকৃতির ভেদ। প্রকৃতিকে ‘পর’ করে দিয়ে আমরা ‘আত্ম’কে পেয়েছি। লালন সেই পরাপ্রকৃতির ভেতর লীন হয়ে তাকে উপলব্ধি করতে চাইছেন।

সহজ প্রকৃতিতে ফেরার আকাঙ্ক্ষা কোনো না কোনো রূপ নিয়ে হাজির থাকে মানুষের কাজে-কর্মে। বাংলার সহজিয়া বৈষ্ণব এবং বাউল-ফকিরেরা এই প্রত্যাবর্তনকে বলেন উজান পথে ফেরা। তাঁরা মনে করেন, যুগল প্রেমের সাধনা দিয়ে ফেরা যাবে সৃষ্টির উজানে, হওয়া যাবে সহজ মানুষ, আর সহজ মানুষের কাছেই ধরা দেবে সহজ আনন্দ। সব সংস্কৃতির মানুষই হয়তো এই সহজ আনন্দের খোঁজ করে। কিন্তু বিপজ্জনক পথে এমন সব কাণ্ড করতে থাকে, যা তাকে প্রতিনিয়ত দুঃস্বপ্নের দিকে ঠেলে দেয়।

লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক।