যেভাবে বদলে গেল পাঠকের স্বভাব

বই এখন যতটা না পাঠের উপকরণ, তার চেয়ে বেশি মালিকানা লাভের বস্তু। বদলে গেছে পাঠকের স্বভাব এবং বই পড়ার ধরন। কিন্তু কীভাবে?

বই পরিণত হয়েছে মানুষের ব্যক্তিগত পণ্যে। যৌথ পাঠ এখন আর নেই বললেই চলে। তাই আজকাল পাড়া-মহল্লার গ্রন্থাগারগুলো থাকে পাঠকশূন্য। প্রথম ছবিতে পুরান ঢাকার রামমোহন রায় লাইব্রেরি ও পাঠগৃহের পাঠক শূন্য চিত্র। অপর দিকে রাজধানীর সুপরিসর বইয়ের দোকানগুলোয় দেখা যায় পাঠকের ভিড়।ছবি: প্রথম আলো

ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ১০ তলা ভবনের চতুর্থ তলায় একটি গ্রন্থাগার আছে। শুনেছি এক লাখের ওপর বই আছে সেখানে। গিয়ে বসে পড়া যায়। সদস্য হলে বই ধার নিয়ে বাসায় আনা যায়। বইয়ের এক বিশাল সমুদ্র, অথচ খুব বেশি পাঠককে সেখানে যেতে দেখা যায় না। ওই ভবনে লিফট দিয়ে যাঁরা ওঠেন, তাঁদের অধিকাংশের গন্তব্য ভিন্ন একটি তলায়, যেখানে আছে বিরাট এক বইয়ের দোকান। এ ভবনে আসা ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বইয়ের ক্রেতা।

বেশ কিছুকাল হলো গ্রন্থাগার আর পাঠকের গন্তব্য নয়। দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পাঠাগারগুলোয় এখন মাকড়সার জাল। ফেব্রুয়ারি মাস এলে আমাদের হা–হুতাশ আরও বেড়ে যায়। পত্রপত্রিকার পাতায় ছবি ছাপা হয়: সাবেকি এবং সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারগুলোয় সারি সারি প্রাচীন কাঠের আলমারি, তার আধভাঙা পাল্লার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে ধুলাজমা, উইয়ে কাটা ফসিলপ্রায় বইপত্র, খাঁ খাঁ পড়ার টেবিল। এ যেন ঘষা কাচের ভেতর দিয়ে দেখা পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ির উঠান, স্নানঘর—এক কঠিন দীর্ঘশ্বাস।

তবে আমরা জানি, আমাদের পাঠসংস্কৃতি এত নিরানন্দ নয়। দেশে বইয়ের পাঠক আগের চেয়ে কমেনি। বেড়েছে বরং। সেটা ঢাকা শহরে ক্রমাগত বাড়তে থাকা বইয়ের দোকান, নতুন নতুন প্রকাশনা সংস্থা, বইমেলায় প্রতিবছর বাড়তে থাকা বইয়ের সংখ্যা থেকে স্পষ্ট।

বইয়ের পাঠকের স্বভাব বদলেছে। লোকে বই ধার নেয় না। বই কেনে। বই এখন যতটা না পাঠের উপকরণ, তার চেয়ে বেশি মালিকানা লাভের বস্তু। পথের পাঁচালী বা ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুডকে এখন আমাদের হাতের নাগালের দূরত্বে থাকতে হয়—শয়নকক্ষে, না হলে বসার ঘরে, নতুবা পড়ার ঘরে।

গণগ্রন্থাগার এক হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি। সারা বিশ্বেই এ চিত্র। ব্রিটেনের মতো পড়ুয়া জাতির দেশে ইদানীং এ নিয়ে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। গ্রন্থাগার আদতে বইয়ের জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। পুনর্নিমাণের সূত্রে শাহবাগের কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি ভবনটি যে বেশ কিছুদিন আগে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, শহরের প্রধান পাঠাগারটি যে বছর দুয়েকের বেশি সময় ধরে ‘অস্তিত্বশীল’ নয়, এ খবর খুব বেশি লোকে জানে বলে মনে হয় না। এর কোনো প্রভাব আমাদের নাগরিক জীবনের আর কোথাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

বই নামের বস্তুটি এই যে গ্রন্থাগারের গণপরিসর থেকে সরে এসে কেবলই আমাদের ব্যক্তিগত গৃহকোণে আশ্রয় নিয়েছে, পাঠক থেকে আমরা যে ক্রেতায় পরিণত হয়েছি, এটা কি শুধুই এক প্রসাধনিক পরিবর্তন? বই পড়ার সংস্কৃতিতে কোনো মৌলিক পরিবর্তন কি সাধিত হয়নি?

পাবলিক লাইব্রেরি বা গণপাঠাগার বইয়ের যৌথ মালিকানার ধারণা তৈরি করে। পঠনকে তা যৌথ কর্ম হিসেবে উপস্থাপন করে। পাঠককে তা করে তোলে একটি কমিউনিটিবর্গ।

বইয়ের আদি যাত্রা শুরু হয়েছিল আসরে পাঠের জন্য। ছাপাখানা আবিষ্কারের আগে বই যৌথ পাঠের জন্য তালপাতা বা ভূর্জপত্রে লেখা হতো। বই ছিল ওরাল বা মৌখিক সংস্কৃতির সহযোগীমাত্র, সুপ্ত উচ্চারণ বুকে নিয়ে মূক হয়ে পড়ে থাকা গ্রামোফোনের ভিনাইল চাকতির মতো। বই সংরক্ষিত হতো অভিলেখাগারে। বাসাবাড়িতে বই তখন ছিল চিন্তারও অতীত।

কমিউনিটি দ্রব্য হিসেবে ধর্মগ্রন্থ ছাপা ছিল প্রথম যুগের যান্ত্রিক ছাপখানার কাজ। এমনকি বইয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা গড়ে তোলার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে গত শতাব্দীর আগের শতাব্দীতে, সেটাও পাবলিক লাইব্রেরির একটা অভিজাততান্ত্রিক অনুকরণমাত্র।

গৃহকোণে নিরালায় বসে, অলস মুহূর্তে বিছানায় উপুড় বা চিত হয়ে শুয়ে তন্ময় বই পাঠের যে দৃশ্য তৈরি হয়েছে ভিক্টোরিয়ান ইউরোপে, সেই দৃশ্য, সেই মগ্ন পাঠকই শেষ পর্যন্ত টিকে গেছে বলে মনে হয়। কিন্তু এটা আসলে এক বিভ্রম। কেন, সেটা আরও পরে বলি।

বইয়ের ক্ষেত্রে যা ঘটে গেছে, অতি সম্প্রতি চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও তার কাছাকাছি ব্যাপার ঘটতে শুরু করেছে। প্রেক্ষাগৃহের যৌথ পর্দার জায়গায় ব্যক্তিগত পর্দার দিকে যাত্রা করেছে চলচ্চিত্র। সিনেমা দেখা ক্রমাগত এক নিভৃত অভিজ্ঞতায় পরিণত হচ্ছে। ওদিকে হেডফোন এসে সরিয়ে দিয়েছে সংগীতের যৌথ শ্রবণ। মহল্লার মোড়ের পানের দোকানে এখন আর ট্রানজিস্টরে বেজে ওঠে না ‘মেরে দিল ইয়ে পুকারে আজা’। আমাদের রুচির চৌহদ্দিতে পড়ে না, এমন গান আর আমাদের কানে প্রবেশের সম্ভাবনা নেই। এতে চলচ্চিত্র যেমন বদলে যাচ্ছে, গানও বদলে যেতে শুরু করেছে বলে আমার অনুমান।

বইও কি বদলে যাচ্ছে না? মানে বইয়ের কনটেন্ট?

নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা ছাড়া বলা কঠিন। আপাতত বইয়ের বহিরাঙ্গিক কিছু পরিবর্তন এখনই চোখে পড়ে। গ্রন্থাগারে পুনরাবৃত্তিময় যৌথ পাঠের জন্য বইয়ের শক্ত বাঁধাই যতটা আবশ্যকীয়, এর প্রচ্ছদসহ অন্যান্য সৌষ্ঠবের নন্দনতাত্ত্বিক পরিবেশনা ততটা নয়। এখন উল্টে গেছে অগ্রাধিকার। বইয়ের সব মনোযোগ এখন সৌষ্ঠবে, আঙ্গিকে।

বইয়ের পণ্যে পরিণত হওয়া এবং বৃহৎ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের উত্থানের এ যুগে আরও কিছু নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম হয়েছে। সবচেয়ে বড় ঘটনাটি হলো, বইয়ের মালিকানার ধারণা। বই পাঠের আগ্রহকে ছাপিয়ে বইয়ের মালিকানা লাভের তাড়না আমাদের কাছে বড় হয়ে উঠছে। আমরা এমন এক ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা গড়ে তুলছি, যেখানে পঠিত বইয়ের চেয়ে অপঠিত বইয়ের সংখ্যা ক্রমাগত বড় হয়ে উঠছে এবং এ প্রকারে বই পাঠের চেয়ে বই অ–পাঠ হয়ে উঠছে প্রধান ঘটনা। জাপানি ভাষায় ‘সুন্দোকু’ বলে একটা শব্দ আছে, যার আভিধানিক অর্থ অপঠিত বইয়ের স্তূপ। পরে পড়ব বলে যেসব বই আমরা স্তূপ করে রেখে দিই, সেগুলোই সুন্দোকু। ইংরেজিভাষী জগতের অনেকে কলিন্স ডিকশনারিতে এই শব্দ সংযোজনের পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, এটা আর অবসকিওর কোনো জাপানি শব্দ নয়, সুন্দোকুর অভিজ্ঞতা আমাদের অভিন্ন বৈশ্বিক নাগরিক অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়েছে।

কাছাকাছি আরেকটি ধারণা চালু করেছেন নাসিম নিকোলাস তালেব নামের এক সেলিব্রিটি পরিসংখ্যানবিদ। তিনি বলছেন, ‘অ্যান্টিলাইব্রেরি’র কথা। অ্যান্টিলাইব্রেরি হচ্ছে আমাদের ব্যক্তিগত পাঠাগারের সেসব বইয়ের বর্গ, যেগুলো পড়া হয়নি। নিজের বিশাল ব্যক্তিগত লাইব্রেরি নিয়ে উমবার্তো একো যে মশকরা করেছিলেন, অ্যান্টিলাইব্রেরির ধারণা সেখান থেকেই পেয়েছেন তালেব। তিনি বলছেন, ‘আমাদের পাঠের পরিধি যত বাড়বে, ততই বড় হবে অ্যান্টিলাইব্রেরির পরিসর। কেননা, একটি বই পাঠ করা মানেই ওই বইয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত আরও এক শ বই আমাদের অপঠন তালিকায় এসে যুক্ত হয়ে পড়া।’

বই পরিণত হয়েছে মানুষের ব্যক্তিগত পণ্যে। যৌথ পাঠ এখন আর নেই বললেই চলে। তাই আজকাল পাড়া-মহল্লার গ্রন্থাগারগুলো থাকে পাঠকশূন্য।আজিজ সুপার মার্কেটে প্রথমার বইয়ের দোকান

এইখানে আরেকটা ব্যাপার আছে। অ্যান্টিলাইব্রেরির বইগুলো পড়া না হলেও সেগুলোর মালিকানার বোধ আমার মধ্যে থাকে। কেননা, আমার বাসার ঘরে আলমারির তাকে সেগুলো সুসজ্জিতভাবে রাখা। যে জ্ঞান আমি অর্জন করিনি, তার মালিকানার বোধের সঙ্গে এটার যোগ আছে, যোগ আছে যে দেশ আমি দখল করিনি, সে দেশ নিয়ন্ত্রণের ধারণার সঙ্গে। সে হিসেবে অ্যান্টিলাইব্রেরি শব্দটা অত সরল নয়। এর মধ্যে মিশে আছে রাজনৈতিক গূঢ়ার্থ। অ্যান্টিলাইব্রেরির সূত্র ধরে অ্যান্টিনলেজ, অ্যান্টিস্কলারের মতো আরও গূঢ় কিছু শব্দ এসে পড়তে শুরু করেছে।

অনেকে বলেন, পঠিত বইয়ের চেয়ে আমাদের জীবনে অপঠিত বইয়ের প্রভাব অনেক বেশি। কথাটা ভেবে দেখার মতো। আর এইখানে কমিউনিটি রিডিংয়ের ব্যাপারটা ফিরে আসে। এমন অনেক বই আছে, যা আমি পড়িনি, কিন্তু পড়েছি বলে ‘ডেজা ভ্যু’ হয়। যেমন কার্ল মার্ক্সের ডাস ক্যাপিটাল বা জয়েসের ইউলিসিস বা মেলভিলের মবি ডিক। সমাজে এসব বই এমনভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে যে এগুলো পাঠের ভ্রম তৈরি করে, যেন আমাদের হয়ে অন্য কেউ সেগুলো পড়ে দিয়েছে।

এদিক থেকে দেখলে শেষ বিচারে সমাজে বই পাঠ একটা যৌথ কর্ম হিসেবেই ফিরে আসে। একটা গণপাঠাগার আমাদের মনোজগৎজুড়ে বিরাজ করে। বৃষ্টির দিনে জানালার পাশে নিরালায় বসে মগ্ন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি পাঠকেরা অনুভব করতে পারেন না, তাঁরা আসলে ‘সমাজ’ নামের এক অদৃশ্য যৌথ টেবিলে বসে পাঠ করছেন। তাঁদের পাঠাগার যতই ব্যক্তিগত মনে হোক না কেন, কোন বইগুলো থাকবে, তা বাতলে দিচ্ছে সামাজিক পাঠরুচি। শুধু তা-ই নয়, কোন বইয়ের পাশে কোন বই থাকবে এবং কোন বইয়ের পাশে কোনটা থাকবে না, তা-ও নির্ধারণ করে দিচ্ছে বই পাঠের এক অদৃশ্য অথচ প্রভাবশালী গণরুচি। বলিয়ানোকে যে গ্রিশামের পাশে রাখা যাবে না, ঢোঁড়াইচরিত মানস যে চৌরঙ্গির পাশে বসবার নয়, বুদ্ধদেব বসু আর বুদ্ধদেব গুহ যে ভিন্ন তাকের বই, ইলিয়াস আর মিলনের মধ্যখানে যে আরও অন্তত খানবিশেক বই রেখে দিতে হবে—এই ঔচিত্যবোধ আসলে এক সামাজিক ইকেবানা। ব্যক্তি পাঠক ও ব্যক্তিগত লাইব্রেরি এ অর্থে এক বিরাট বিভ্রম।