বাংলা আর পাঞ্জাবের দুনিয়াকে দেখার আর অনুভবের দৃষ্টিতে একটা লক্ষণীয় মিল আছে। এই দুই সংস্কৃতির ভাবমানসের গভীরে বিরাজ করে বিরহের সুর। পাঞ্জাবি কবিতার আদি পুরুষ বাবা ফরিদ থেকে বুল্লে শাহ হয়ে অমৃতা প্রীতম আর বাংলার চণ্ডীদাস, লালন, শাহ আবদুল করিম সেই কোন ফেলে আসা জগতের বিরহগান গেয়ে গেছেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলো। সবচেয়ে বেশি দায় ভোগ করল বাংলা আর পাঞ্জাবের জনগণ। দেশভাগ নিয়ে লেখা উর্দু উপন্যাস দো লোগ-এর লেখক গুলজার পাঞ্জাবের মানুষ। তাঁর ভালোবাসার বিচরণভূমি বাংলা। সিনেমায় কাজ শুরু শচীনদেব বর্মনের বন্দিনী ছবিতে গান লিখে, ১৯৬৩ সালে। চলচ্চিত্র পরিচালক বিমল রায়কে তিনি গুরু মানতেন। জীবনসঙ্গিনী রাখির কাছ থেকে শুনতেন রবীন্দ্রসংগীত। পরে নিজে উর্দুতে অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর গান।
এই গুলজার যদি দেশভাগ নিয়ে উপন্যাস লেখেন, সেখানে যে সুর বাজবে তা বাংলাভাষীদের কাছে মোটেই অপরিচিত ঠেকবে না। উপন্যাসটির মূল উর্দু নাম দো লোগ। এর ইংরেজি অনুবাদ গুলজার নিজেই করেছেন। তবে সফিকুন্নবী সামাদী বাংলা অনুবাদ করেছেন মূল উর্দু থেকে। তিনি বাংলার শিক্ষক। গবেষণা করেছেন উর্দু ছোটগল্পের প্রবাদপুরুষ মুনশি প্রেমচন্দ আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তুলনামূলক আলোচনা নিয়ে। সেই সূত্রে শিখতে হয়েছে হিন্দি ও উর্দু। গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন কড়া ‘মাস্টারমশাই’ স্বনামধন্য ক্ষেত্র গুপ্ত। ফলে সফিকুন্নবী সামাদীর অনুবাদে মূল থেকে বিচ্যুতির আশঙ্কা নেই।
দেশভাগ ঘটে গেছে আজ থেকে ৭৫ বছর আগে। আজকের নতুন প্রজন্মের কাছে সে বইয়ে লেখা ইতিহাস। কখনো হয়তো সাহিত্যে, নাটক বা সিনেমায় সেই প্রসঙ্গ আসে। তাহলে আজ এর প্রাসঙ্গিকতা কী? এই প্রশ্ন গুলজারের কাছেও করেছিলেন উর্দু সাহিত্যগবেষক পবন কুমার। গুলজার যা বললেন, তার মানে দাঁড়ায় এই যে ১৯৪৭ শেষ হয়ে যায়নি। তাঁর কথায় এসেছিল ১৯৮৪ সালের শিখ গণহত্যার কথা। সুকৃত পাল কুমারের কাছে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন নিজে জন্মভূমি ছেড়ে আসার সময় রাস্তার পাশে দাঙ্গায় নিহত পচাগলা মৃতদেহের স্তূপের কথা, যারা দাহ বা গোর কিছুই পায়নি। তারা ভারতবর্ষের পথের পাশে পড়ে ছিল পাহাড় হয়ে। গুলজারের ভাষায় এসব দৃশ্য—‘জম গ্যায়া থা মেরে আন্দর’ (জমে রয়ে গিয়েছে আমার ভেতরে)। সেই জমে যাওয়া দুঃস্বপ্ন গলে গিয়ে লেখা হয়েছে এই উপন্যাস। আকারে তা হয়তো উপন্যাসিকা। কিন্তু এর সময়ের ব্যাপ্তি ১৯৪৬ সাল ও ১৯৯৯ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পর্যন্ত।
কেন এই উপন্যাস ১৯৪৭ পার হয়ে আজকের দিন পর্যন্ত গড়িয়েছে? এর কারণ হয়তো এই যে প্রগতিশীল উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের সংগঠনের হাতে হাত রেখে দেশছাড়া কিশোর মোটর মেকানিক গুলজার সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন। তিনি ফয়েজের মতো মনে করেন, এই ক্ষত–বিক্ষত আলো রাতের কামড়ে ছিন্নভিন্ন ভোর মানুষ চায়নি।
দেশভাগ সাহিত্য নিয়ে উর্দুর একটা শাখা আছে। তাকে বলা হয় ‘তাকসিম আদাব’। গুলজার নিজে ছোটগল্প লিখেছেন সেই ধারায়। তাঁর ছোটগল্পের সংকলন রাবি পার পড়লে পাঠক বুঝতে পারবেন, তিনি মান্টো, কৃষন চন্দরের উত্তরাধিকার। গুলজারের উপন্যাসটি শুরু হয় ১৯৪৬ সালে, সীমান্তবর্তী ক্যাম্বেলপুরে। বিলাত থেকে ডেকে আনা এক সাদা সাহেব ভারতবর্ষের মানচিত্রে পেনসিল দিয়ে দাগ কাটছেন। আর ক্যাম্বেলপুরের অধিবাসীরা শুনতে পাচ্ছেন দেশ ভাগ হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারেন না এই ‘দেশভাগ’ শব্দটার মানে কী? ক্যাম্বেলপুর থেকে একটা ট্রাকে চেপে বেরিয়ে পড়েন একদল মানুষ—ফৌজি ট্রাকচালক, দুই স্কুলশিক্ষক, গ্রামের অভিজাত, গুজব ছড়ানো তরুণ, নির্যাতিত কিশোরী...আছে কিছু জোচ্চোর, যারা এই সদ্য দেশহীন মানুষগুলোকে আশা দিয়ে নিজের ভাগ্য বদলাতে চায়।
তাঁরা কে কোথায় যাবেন, জানেন না। যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মৃতদের পুঁতে দেওয়া হচ্ছে মাটিতে। এই মাটি জীবিত বা মৃত—কারোর নয়। গুলজারের উপন্যাসের এসব মানুষের জন্মভূমি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যায়নি। সেই মাটি এখনো অন্য রাষ্ট্রের মধ্যে আছে, যেখানে তাঁরা আজ বিদেশি। দেশ ছেড়ে আর কোনো দেশ পাওয়া হয় না তাঁদের।
২০২২ সালে দেশভাগের ৭৫ বছর হলো। এত দূর থেকে আসা কণ্ঠগুলো থেমে গেছে। কিন্তু শব্দকে ছাপিয়ে যায় সেই নীরবতা। কারণ, গুলজারের দেশছাড়া মানুষগুলো এখনো কোনো ‘নিজের দেশ’-এ পৌঁছাতে পারেনি।
দুজন
গুলজার
অনুবাদ: সফিকুন্নবী সামাদী
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: আগস্ট ২০২২, প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, ১১৯ পৃষ্ঠা, দাম: ২৫০ টাকা।
বইটি পাওয়া যাচ্ছে
prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে।