নারীবাদী পাঠ আমাদের দেখিয়েছে যে সাহিত্যে নারীর উপস্থাপন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষের ‘পয়েন্ট অব ভিউ’ থেকে সৃষ্ট, পাঠক-সমালোচকেরাও নারীচরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এ প্রসঙ্গ মনে রেখে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে চোখ ফেরানো যাক আখ্যানের রাজনীতির দিকে।
নারীবাদ একটি তত্ত্ব এবং রাজনৈতিক অবস্থান, কেউ জন্মসূত্রে নারী হলেই তিনি এই তত্ত্বে বিশ্বাসী হবেন, এ মতবাদের অনুসারী হবেন, এমনটা বিধেয় নয়। কিন্তু লেখক যখন নারী, তখন কোনোক্রমেই লৈঙ্গিক রাজনীতি–পরিসরের বাইরে তিনি নন।
লেখক হওয়ার জন্য একজন নারীর নিজস্ব একটি ঘর থাকতে হয়, আর হাতে কিছু অর্থকড়ি—ভার্জিনিয়া উলফ বহু আগে এমন কথা বলে গেছেন। আবার একই সঙ্গে তিনি শেকস্পিয়ারের কল্পিত বোনের চরিত্র ভেবে নিয়ে দেখিয়েছেন, কেন একজন নারী সব যোগ্যতা আর প্রতিভা থাকার পরও সমসাময়িক পুরুষের মতো সাফল্য পেতে পারেন না, পিতৃতান্ত্রিক সমাজকাঠামো কীভাবে তাঁকে পদে পদে পেছনে টেনে ধরে। কোনো নারীর বিজ্ঞানী, বৈমানিক, চিকিৎসক বা স্থপতি হওয়ার পথে যে বাধা, লেখক হওয়ার জন্যও কি সেই একই ধরনের প্রতিবন্ধকতা কাজ করে, নাকি উল্লিখিত পেশাগুলোর তুলনায় লেখক হওয়া নারীর জন্য কিছুটা সহজ? নারী যখন লেখক হন, তখন কি তিনি নারীবাদী চেতনায় বিশ্বাসী হন? এমন কোনো বাধ্যবাধকতা কি আছে? উলফ যে সময়ে আ রুম অব ওয়ান্স ওউন লিখেছেন, তারপর পেরিয়ে গেছে প্রায় ১০০ বছর। এখন কি নারীর জন্য লেখক হওয়া সহজ হয়ে গেছে?
শুরুতেই বলে নিই, নারীবাদ কিংবা নারীর সম-অধিকারের সীমা আসলে কোথায়, সেই রেখা খুব অস্পষ্ট ও অনির্ধারিত। নারীবাদের যেমন বহু ধারা-উপধারা, শাখা-উপশাখা রয়েছে, তেমনি পশ্চিমা নারীবাদ পাড়ি দিয়েছে বহু পথ। তৃতীয় ঢেউ (থার্ড ওয়েভ) পেরিয়ে এখন বিশ্বজোড়া চলছে নারীবাদের চতুর্থ ঢেউ (ফোর্থ ওয়েভ)। এই ফোর্থ ওয়েভ মূলত সব শ্রেণিপেশা, ধর্মবিশ্বাস ও সমস্ত সামাজিক অবস্থানের নারীদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে থেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে নারীবাদচর্চার স্বীকৃতি দেয়। কাজেই নারী লেখকের লেখায় শুধু সিমোন দ্য বোভোয়া কিংবা মেরি ওলস্টোনক্রাফটের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শুনতে চাইলে হবে না। ইংল্যান্ডপ্রবাসী নাইজেরিয়ান লেখক বুচি এমেচেতা তাঁর উপন্যাসগুলোতে সারা জীবন নারীর সংগ্রামের কথাই লিখে গেছেন, কিন্তু নিজেকে নারীবাদী হিসেবে দাবি করেননি। তাঁর মতে, ফেমিনিজম একটি শ্বেতাঙ্গ পশ্চিমা ব্যাপার।
একজন আখ্যান রচয়িতা নারী হলেই তাঁকে তাত্ত্বিক নারীবাদের বিষয়ে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে কিংবা বিস্তারিত জানাশোনা না থাকলে তাঁকে লেখক হিসেবে খারিজ করে দেওয়া যাবে, এমন ভাবাটা সম্ভবত বাতুলতা। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস থেকে আমরা জানি, যে আন্দোলনের ফলে এ দিবস পালনের রীতি শুরু হয়, সেটি ছিল মূলত শ্রমিক নারীদের কর্মঘণ্টা কমানোর আন্দোলন। নারী চিরকাল সস্তা শ্রম, ক্ষেত্রবিশেষে বিনা মূল্যে শ্রম দিয়ে এসেছে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে। যখন তাঁরা এই শ্রমশোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, তখনই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা লাঠিসোঁটা নিয়ে, কামান-বন্দুক নিয়ে চুপ করাতে চেয়েছে তাঁদের। আবার অন্যদিকে আমাদের দেশের নারীবাদচর্চার শীর্ষস্থানে আসীন বেগম রোকেয়া, যিনি শুধু সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্বই দেননি, বহু নারীবাদী রচনার স্রষ্টাও, তিনি কিন্তু মূলত মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত নারীদের শিক্ষিত হওয়ার আলাপ করেছিলেন, পর্দা বা অন্তরাল থেকে বের হয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার তাগিদ দিয়েছিলেন মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত নারীদের। নিম্নবিত্ত আর শ্রমিকশ্রেণির নারীরা সব সময়ই অর্থ উপার্জন করে এসেছেন, ঘরের বাইরে গমনাগমনের বিধিনিষেধ তাঁদের ছিল না। এই প্রসঙ্গে অবরোধবাসিনীতে বেগম রোকেয়া বলেছেন, পর্দা না করলেই স্বাধীনতা অর্জিত হয় না, যদি হতো, তাহলে শ্রমিক নারীরা সম-অধিকার পেতেন। বেগম রোকেয়া যেহেতু উচ্চশ্রেণির নারীদের অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করছিলেন, সেই সময়ের সাপেক্ষে লেখাপড়া যে পর্দা বজায় রেখেই করা সম্ভব, সেটি তাঁকে প্রমাণ করতে হয়েছিল। কাজেই বাংলাদেশে যখন আমরা নারীবাদ বা নারীর স্বাধীনতার কথা বলি, মূলত সেই আলাপ হয়ে যায় মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত নারীদের সম-অধিকারের আলাপ। বর্তমানের নারীবাদচর্চা বা নারী দিবস পালনের প্রবণতা, একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, শহুরে শিক্ষিত নারীদের একচেটিয়া। সাহিত্য যাঁরা লেখেন আর পড়েন, তাঁরাও এই শ্রেণিরই অন্তর্ভুক্ত।
লিখতে হলে একজন নারীর নিজস্ব কামরা ছাড়াও থাকতে হয় বাচ্চা দেখাশোনার জন্য আয়া, রান্নার লোক, নিদেনপক্ষে একজন গৃহকর্মী। নয়তো পারিবারিক আর পেশাগত দায়িত্ব পালনের পর লেখালেখির অবকাশ নারীদের হয়ে ওঠে না।
সাহিত্যে নারীর উপস্থাপন, যা পুরুষ লেখকের সৃষ্টির মাধ্যমে হয়েছে, স্বভাবতই তার সবই পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। নারী চরিত্রদের দিয়ে পুরুষ লেখক যা বলান বা করান, তার সবই পুরুষের অভিজ্ঞতার ফসল, মা, বোন, স্ত্রী, প্রেমিকা, কন্যা কিংবা বারবনিতা, নারীকে পুরুষ আঁকেন তাঁর নিজের মনের রঙে, রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, ‘আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা’, পুরুষ লেখকের সৃষ্টি নারী চরিত্রগুলো আসলে তা-ই। নারী যখন নারীর গল্প বলেন, নারী চরিত্র সৃষ্টি করেন, তখন তাঁর দেখার চোখ, আঁকার তুলি অবশ্যই পুরুষের চেয়ে আলাদা হওয়া উচিত, হয়ও। নারী সব সময়ই সাহিত্যের বিষয় হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, তলস্তয়ের আনা কারেনিনা, টমাস হার্ডির টেস কিংবা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কুন্দনন্দিনী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রাজলক্ষ্মী কিংবা সমরেশ মজুমদারের দীপাবলি—নারীকে কেন্দ্র করে সাহিত্য লেখায় সব যুগের পুরুষ লেখক সমান আগ্রহী ছিলেন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, নারী যখন সাহিত্য সৃষ্টি করতে শুরু করেছেন, তখন দেখা গেল, তাঁদের মূল চরিত্ররাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী। জেন অস্টেনের জেন এয়ার থেকে শুরু করে হালের চিমামান্দা এনগোজি আদিচির অ্যামেরিকানা, এলিফ শাফাকের থ্রি ডটার্স অব ইভ, টনি মরিসনের সুলা—সবই নারীকেন্দ্রিক উপন্যাস। বাংলাদেশের নারী লেখকদের লেখায় নারী চরিত্রকে কেন্দ্র করে লেখার প্রবণতা দেখা যায়। ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস অসুখী দিন-এর মূল চরিত্র হিসেবে শাহীন আখতার বেছে নিয়েছেন নারী চরিত্র, সখী রঙ্গমালা তো পুরোটাই রঙ্গমালা আর ফুলেশ্বরী রাইয়ের গল্প। হালে নতুনদের মধ্যে পারমিতা হিম লিখেছেন নারগিস নামের এক উপন্যাস, সেখানেও মূল চরিত্র নারী। এ বছর বইমেলায় বেস্টসেলার হিসেবে আরেক তরুণ লেখক ইলমা বেহরোজের পদ্মজা উপন্যাসের নাম এসেছে। এটিও নারীর লেখা নারীকেন্দ্রিক কাজ। বিশ্বজোড়া নারী লেখকদের এই প্রবণতার পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে বলে ধারণা করি। প্রথম ও প্রধান কারণ হতে পারে এই যে এত শতাব্দী ধরে সাহিত্যে নারীর যে উপস্থাপন, যে লেন্স দিয়ে পুরুষ লেখক নারীকে দেখেছেন এবং দেখিয়েছেন, সেই উপস্থাপনের ঘাটতি পূরণের জন্য লেখক-নারী সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বলতে চেয়েছেন নারীরই বয়ান। আবার আরও একটি কারণ হতে পারে এমন, পুরুষের জীবন আর পুরুষের দুনিয়াটা অধিকাংশ নারী লেখকের খুব বেশি দেখা নেই। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া বাস্তবধর্মী উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতাও থেকে থাকতে পারে। তবে প্রথম কারণটিকেই অধিক যৌক্তিক আর গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়।
‘গাইনোসেন্ট্রিক রিডিং’—নারীবাদী পাঠ,যা কিনা ‘অ্যান্ড্রোসেন্ট্রিক’ বা পুরুষবাদী পাঠের বিপরীত, আমাদের দেখিয়েছে যে সাহিত্যে নারীর উপস্থাপন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষের ‘পয়েন্ট অব ভিউ’ থেকে সৃষ্ট, পাঠক-সমালোচকেরাও নারী চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তাই নারীর লেখা আখ্যানকে অনেক সময়ই ‘মেয়েলি লেখা’ বলে খারিজ করার চেষ্টা হয়েছে, নারী যখন পুরুষের কলমে, পুরুষের ব্যবহৃত ভাষায় লিখতে চেষ্টা করেছেন, সেই লেখাকেই ‘স্ট্যান্ডার্ড’ হিসেবে ধরেছেন একশ্রেণির পাঠক-সমালোচক। আবার উল্টো দিকে নারীর দৃষ্টিতে ‘কাউন্টার ন্যারেটিভ’ সৃষ্টি করার চেষ্টা যে একেবারে হয়নি, তা-ও নয়। পশ্চিমে মার্গারেট অ্যাটউড লিখেছেন দ্য পেনেলোপিয়াড, যা ইলিয়াড আর ওডিসির মতো মহাকাব্যে নারীর প্রতি নিপীড়ন আর শোষণের বিবরণ তুলে ধরে। আবার বাংলায়ও এ ধারার লেখা আছে, মল্লিকা সেনগুপ্ত লিখেছেন সীতায়ন, রামায়ণ-এর শেষ পর্যায়ে সীতার সঙ্গে ঘটা জঘন্য অন্যায়ের বয়ান পুনর্লিখিত হয়েছে সীতার দৃষ্টি থেকে। নারী লেখকদের ভাষা নিয়েও সৃষ্টি হয় নানা বিতর্ক। নারী তাঁর নিজস্ব ভাষায় লিখবেন নাকি এত দিন ধরে চলে আসা পৌরুষিক ভাষায় লিখবেন, কোনটা করলে তিনি লেখক হিসেবে ‘উতরে যাবেন’—সেই প্রসঙ্গও ওঠে নানা আলোচনায়। এখন প্রশ্ন হলো, নারী লেখক যা-ই লিখুন, পুরুষাধিপত্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নারীর আর্তনাদকে তুলে ধরুন কিংবা পুরুষের শেখানো ভাষায় গতানুগতিক পুরুষতান্ত্রিক লেখাই লিখুন, তাঁর পাঠকপ্রিয়তা কেমন? নারীর লেখা কতটা জনপ্রিয়?
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বিবিসি বাংলার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ নারীর লেখা বই। প্রতিবেদক সাইয়েদা আক্তার কথা বলেছিলেন সেলিনা হোসেন, নাসরীন জাহান আর অদিতি ফাল্গুনীর সঙ্গে। প্রতিষ্ঠিত এই লেখকেরা নারীর বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে পারিবারিক বাধার সঙ্গে প্রকাশনা সংস্থাগুলোর অসহযোগিতাকেও দায়ী করেন। এর পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে ওই একই গণমাধ্যমে এ বিষয়ে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২০১৮ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে প্রতিবেদক রাকিব হাসনাতকে এক পাঠক জানান, সাধারণ পাঠকদের মধ্যে নারী পাঠকেরাও নারী লেখকদের বই সম্পর্কে খুব বেশি আগ্রহ দেখান না। কিছু পাঠক বলেন, নারীরা সাধারণত গল্প-উপন্যাস, কবিতা লেখেন, ‘সিরিয়াস’ বিষয়ে (সম্ভবত প্রবন্ধ বা গবেষণা বুঝিয়েছেন শব্দটি দিয়ে) নারীদের লেখাপত্র কম। প্রতিবেদনে প্রকাশকদের ভাষ্য এমন ছিল যে পাঠকেরা সেলিনা হোসেন কিংবা তসলিমা নাসরিনের মতো দু-একজন বাদে নারী লেখকদের বই কিনতে খুব বেশি আগ্রহী হন না বলে লগ্নি করা অর্থ পুনরুদ্ধার করার উদ্দেশ্যে ঝুঁকি নিতে চান না প্রকাশকেরা। এ ধরনের মন্তব্যগুলোকে অনেক সময়ই ‘অজুহাত’ বলে মনে হয়, ২০২৪ সালের বেস্টসেলার বইয়ের নাম আগেই উল্লেখ করেছি সে জন্য। সেলিনা হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু বা বেগম রোকেয়ার সুলতানা’স ড্রিম প্রকাশের পরেই বেস্টসেলার হয়নি। সব বই বেস্টসেলার হয় না, হবে না জেনেও প্রতিবছর বইমেলায় চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার বই বের হয়, যার মধ্যে নারীর লেখা এক-চতুর্থাংশের কম।
তাই বলে এ দেশের নারীরা যে আখ্যান লেখায় পিছিয়ে আছেন, তা বলা যাবে না। ইদানীং জনপ্রিয় লেখকদের মধ্যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মিশ্র তালিকা তৈরি করা হলে তাতে অনেক লেখকের নাম আসবে, যাঁরা নারী। এ রচনায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে ইতিমধ্যে উল্লিখিত লেখকেরা বাদেও রয়েছেন অনেক নারী লেখক, যাঁরা নিজেদের কাজ দিয়ে মূলধারার সাহিত্যসভায় স্থান করে নিয়েছেন—আনোয়ারা সৈয়দ হক, নাসরীন জাহান, শাহীন আখতার, আকিমুন রহমান, অদিতি ফাল্গুনী, পাপড়ি রহমান, আফসানা বেগম, সাগুফতা শারমীন তানিয়া, রুমা মোদক, লুনা রুশদী, ফাতেমা আবেদীন, কিযী তাহ্নিনসহ এ মুহূর্তে নাম মনে পড়ছে না, এমন আরও অনেকেই আছেন এই তালিকায়। এ লেখায় মূল আলোচ্য ছিল গল্প-উপন্যাস, তাই কবিতা বা গবেষণাগ্রন্থ লেখেন, এমন লেখকদের উল্লেখ করলাম না। এলিফ শাফাক তাঁর ব্ল্যাক মিল্ক অন্য রাইটিং, মাদারহুড অ্যান্ড দ্য হ্যারেম উইদিন বইয়ে ভার্জিনিয়া উলফের আ রুম অব ওয়ান্স ওউন-এর উল্লেখ করে বলেছেন, মিসেস উলফ লেখক হওয়ার জন্য হাতে পয়সাকড়ি থাকতে হবে বলেছিলেন, যা বিস্তারিত বলেননি তা হলো, লিখতে হলে একজন নারীর নিজস্ব কামরা ছাড়াও থাকতে হয় বাচ্চা দেখাশোনার জন্য আয়া, রান্নার লোক, নিদেনপক্ষে একজন গৃহকর্মী। নয়তো পারিবারিক আর পেশাগত দায়িত্ব পালনের পর লেখালেখির অবকাশ নারীদের হয়ে ওঠে না। অমর একুশে বইমেলায় যে নারীদের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা এক–চতুর্থাংশের কম, তার পেছনে কারণ এটিই। নারীকে ঘরে-বাইরে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে হয়। আর লেখালেখিটা যেহেতু এ দেশে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম নয়, তাই এ কাজের জন্য পারিবারিক সহায়তা নারীরা একদম পান না বললে অত্যুক্তি হবে না। চাকরি করে সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে গিয়ে শহুরে শিক্ষিত নারী কিছুটা হলেও সাহায্য আশা করতে পারেন, লেখক হতে গেলে যা অসম্ভব।
এমন প্রশ্ন আসতেই পারে, ৮ মার্চ নারী দিবসে নারীরা যে জোর গলায় সম–অধিকার আর সব ক্ষেত্রে সমান সুযোগ–সুবিধার কথা বলছেন, তাহলে নারীর কর্ম আর অর্জনকে আলাদা করে দেখার, নারী লেখকদের আলাদা ক্যাটাগরিতে মূল্যায়ন করার প্রয়োজন হচ্ছে কেন? আখ্যানে নারীর অবদান নিয়ে দীর্ঘ আলাপ উত্থাপনের যৌক্তিকতাই–বা কোথায়? নারীবাদ সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকায় এহেন প্রশ্ন অনেকেই তোলেন। কথা হলো, জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হওয়ার পরও, দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নারীরা আসীন হওয়ার পরও যখন বইমেলায় প্রকাশিত বইপত্রের এক–চতুর্থাংশও নারীদের লেখা নয়, তখন এ কথা স্পষ্ট বোঝা যায়, বেগম রোকেয়ার এত বছরের সাধনা, নারীদের শিক্ষিত করে তোলার সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি। মধ্যবিত্ত নারী শিক্ষিত হয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন ঠিকই, আমলাতন্ত্র থেকে করপোরেট—সব শাখায় পেশাগত সাফল্য দেখাচ্ছেন সত্যি, কিন্তু নিজের কথা বলার জন্য নারী যথেষ্ট স্থান পাচ্ছেন না, নারীর বক্তব্য শোনার মতো আগ্রহী শ্রোতা, নারীর লেখা পড়ার মতো মনোযোগী পাঠক এখনো এ দেশে নেই।