কোলাজ: আপন জোয়ার্দার
কোলাজ: আপন জোয়ার্দার

গণ-অভ্যুত্থানে তারুণ্যের র‌্যাপ

রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পর বাংলাদেশে ঘটে গেল এক অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তৈরি হলো বেশ কিছু র‌্যাপ গান। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে র‌্যাপের এই উত্থান কেন ঘটল?

যখন লিখতে বসেছি, তখন শত শত প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের অসম্ভব নিষ্ঠুর স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন ঘটেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোনো আন্দোলনেই এত বিপুল প্রাণহানি ঘটেনি। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের চেয়ে প্রবল ও রক্তাক্ত ছিল এই গণ-অভ্যুত্থান। তাই অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, ‘আমরা আরেকবার স্বাধীন হলাম!’

হাসিনা সরকারের পতন ঘটে হাইতির কালো দাসদের মতো ‘হয় স্বাধীনতা, নয় মৃত্যু’ অঙ্গীকারে বলীয়ান হয়ে ৫ আগস্ট গণভবন অভিমুখে ছাত্র-জনতার ঢল নামলে।

স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তিমূল উপড়ে ফেলার শক্তি কোথায় পেল ছাত্ররা? তা বিশ্লেষণ করতে হলে তারুণ্যের র‌্যাপসংস্কৃতির দিকে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে। তাকাতে হবে আন্দোলনের পটভূমি আর র‌্যাপ গানের ইতিহাসের দিকেও।

গত কয়েক বছরের সবচেয়ে প্রবল প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল ছাত্ররাই। এবারের আন্দোলনে দেশের জনতাকে পাশে দাঁড়ানোর মতো প্রত্যয় তারা জুগিয়েছিল। জনতাকে পাশে পেয়েছিল। হাসিনা সরকারে পতনের পর এখনো তারা ঘরে ফেরেনি।

এই কিশোর প্রজন্ম ২০১৮ সালে সড়ক আন্দোলনে নেমেছিল। স্লোগান লিখেছিল, ‘রাস্তা বন্ধ, রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে।’ তারা এখন তরুণ হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে এবং অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্তভাবে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে’ এক দফা দাবিতে রূপান্তর করে উৎখাত করেছে অত্যাচারী সরকারকে।

এসব গানে ১৫ বছরে যেসব অনাচার-অনিয়ম হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করা হয়েছে সরকারকে। একই সঙ্গে ‘সুশীল ভাষা’ পরিহার করে রাস্তার ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।

এর বিপরীতে গত ১৫ বছরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কোনো তাৎপর্যপূর্ণ আন্দোলনই গড়ে তুলতে পারেনি। অনেকেই একে ‘জেন-জি’ বিদ্রোহ বলে চিহ্নিত করছেন। আসলে এরা বৈশ্বিক সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত বাংলাদেশের বৈপ্লবিক রূপান্তরকামী প্রজন্ম। ফ্যাসিবাদী আর কোনো শক্তি যেন আর এই মাটি রক্তাক্ত করতে না পারে, সে ব্যাপারেও তারা সজাগ। এরা অদম্য!

তারা নিহত হয়েছে গন্ডায় গন্ডায়, আহত হয়েছে হাজারে হাজারে। ক্যাম্পাসগুলো বন্ধ করে দিলে তারা জনতার কোলে আশ্রয় নিয়েছে এবং তাদেরও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শামিল করে নিয়ে আরও অদম্য হয়েছে। তারা শোক পালন করেছে শোকসংগীত গেয়ে, আর শোককে শক্তিতে পরিণত করেছে স্বৈরাচারবিরোধী যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে।

প্রশ্ন হলো, কোন মন্ত্রে তারা দীক্ষিত হয়েছে? কোন ভাষায় তারা কথা বলেছে? কেন বলেছে? বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ রংপুরের আবু সাঈদের মতো বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর সাহস পেল কীভাবে আরও শত শত শিক্ষার্থী! কীভাবেই-বা রিকশাওয়ালা থেকে সর্বস্তরের জনতাকে তারা নিজেদের লড়াইয়ে শামিল করতে পারল? পারল, কারণ তারা কথা বলেছে বাংলাদেশের হৃদয় থেকে।

গত দশকে মিসরের তাহরির স্কয়ারের সামাজিক আন্দোলন, ওয়াল স্ট্রিটের আন্দোলন, স্পেন বা তুরস্কের আন্দোলন—সবই বেহাত হয়েছিল। আর তখন সেসব আন্দোলনের ব্যর্থতা পর্যবেক্ষণ করে হোমি ভাবা, হামিদ দাবাসি, আলাঁ বাদিউ, এমনকি আগামবেনের মতো নন্দিত তাত্ত্বিকেরা বলেছিলেন যে ‘স্বাধীনতা’ বা ‘গণতন্ত্র’ ইত্যাদি আমাদের পুরোনো রাজনৈতিক পরিভাষাগুলো ‘এম্পটি সিগনিফায়ার’ বা ‘ফাঁপা চিহ্ন’ হয়ে উঠেছে। কিন্তু নতুন সময়ের রাজনৈতিক ভাষা এখনো গড়ে ওঠেনি বলেই এসব আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। তবে আমাদের তারুণ্য পুরো দুনিয়াকে দেখিয়ে দিল, তারা খুঁজে পেয়েছে এক নতুন ভাষা, যা নতুন রাজনৈতিক বিন্যাসও গড়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রাখে।

যেসব গান, কবিতা বা অন্যান্য শিল্পভাষার প্রকাশ আমরা মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদবিরোধী আন্দোলন, এমনকি শাহবাগ আন্দোলনে দেখেছি, সেগুলো তাদের কাছে ক্লিশে হয়ে গেছে। তারা অনুভব করেছে, সেগুলোর আবেদন একেবারেই ফুরিয়ে গেছে। তাই বাংলাদেশের হৃদয়কে জাগাতে তারা এমন এক শিল্পভাষা বেছে নিয়েছে, যা কোনো অভিজাত বা মার্গ সংস্কৃতির কাছে আমল পায় না; যা উঠে এসেছে নিছকই খেটে খাওয়া মানুষের জীবন্ত ভাষা থেকে। নতুন প্রজন্ম এই সপ্রাণ জীবন ও সংহতির গান গায়।

এরা তাই মূলত বেছে নিয়েছিল বাংলা র‌্যাপ বা হিপহপ গান আর গ্রাফিতি। খুবই অভিনব স্লোগানে স্লোগানে তারা ছেয়ে দিয়েছে প্রতিটি শহরের অধিকাংশ দেয়াল। তবে আমাদের মতে, বাংলা র‌্যাপ গানই এই তারুণ্যকে সাহস আর শক্তি জুগিয়েছে সবচেয়ে বেশি। আর তার সঙ্গে ছিল নানা রকমের গ্রাফিতি।

সুষ্ঠু নির্বাচনহীন, গণতন্ত্রবিরোধী, সরকারের নিষ্পেষণে বাকহীনভাবে এই তারুণ্য বেড়ে উঠেছে অনেকটা নবারুণ চক্রবর্তীর ফ্যাতাড়ুর মতো। কিন্তু এদের রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা তীব্র। ‘আই হেট পলিটিকস’ বলায় আমরা তাদের অপছন্দ করতাম। আমরা বুঝতে পারিনি যে তারা চলমান দলান্ধ পরিবারতান্ত্রিক জনবিরোধী রাজনীতিকে ময়লার মতো আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলেছে। তারা নতুন এক রাজনীতির উত্থানের জন্য অপেক্ষমাণ। প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চাপা ক্ষোভ ও আক্রোশ তাদের জবানে উঠে এসেছে প্রতিবাদী র‌্যাপ গান হিসেবে।

র‌্যাপার হান্নানকে যখন ‘আওয়াজ উডা’ গানের জন্য পুলিশ ধরে নিয়ে গেল, রিমান্ডে পাঠাল, তখন অন্য র‌্যাপাররা একযোগে কলম হাতে গান বেঁধে যুদ্ধ ঘোষণা করল!

র‌্যাপার সেজানের ‘কথা ক’ গানটি আমাদের চোখে পড়ে ১৬ থেকে বন্ধ করে দেওয়া ইন্টারনেট-সুবিধা ২২ তারিখে একটু খুলে দেওয়ার পরেই। সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যকে রক্তের রঙে রাঙিয়ে করা হয়েছে এর প্রচ্ছদ। ইতিমধ্যে রাতে ও দিনে অগণিত ছাত্র আর সাধারণ মানুষ ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নির্বিচার খুন হয়েছে। হাসপাতালে ও মর্গে পড়ে আছে লাশ, আহতদের চিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস, রাস্তায় মানুষের হাহাকার। এ সময়েই ‘কথা ক’ ইউটিউবে আপলোড করা হয়, ‘এ ৫২-র আর ২৪-এ তফাৎ কই রে? কথা ক’। গানটি দেশে-বিদেশে হাজার হাজার শেয়ার হতে থাকে। বিপ্লবী ডাক দেওয়া এমন গান যেন আগে কেউ শোনেনি! কয়েক দিনের হত্যাকাণ্ড বর্ণনের সঙ্গে সঙ্গে হাজার প্রশ্নে এ গান প্রশাসনকে বিদ্ধ করতে থাকে। শোকার্ত শিক্ষার্থীরা যেন আবার উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পায়, ‘ভাই-বোন মরে রাস্তায় তর চেষ্টা কই রে? কথা ক’।

এই গানের আহ্বানের মতো করেই যেন তরুণেরা আবার কথা বলতে শুরু করে।

আর হান্নানের ‘আওয়াজ উডা বাংলাদেশ’ গানটি যেন যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দেয়, চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় প্রবল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। বলে, মুক্তি নয়তো মৃত্যুই এখন একমাত্র গন্তব্য! হান্নান বলে, ‘আবু সাঈদরে গুল্লি করলি, অর্ডার দিলি কই থেক্কা?/ এইবার রাস্তায় হাজার সাঈদ কইলজা থাকলে ঠেকাগা!’

৩০ জুলাই আপলোড করা ‘চব্বিশের গেরিলা’ গানটিতে প্রশ্ন তোলা হয়, ‘আমরাই যখন রাজাকার, তাইলে ক তুই রাজা কার?’

এ সময়ই আমরা আরও অনেক র‌্যাপারের গান দেখি ও শুনি। তবে শুধু শুনলে চলবে না, এসব গানের কথা, সুর, বাদ্যযন্ত্রে উত্থান-পতনের গতি ও বিচ্ছেদ, গায়কির বিশেষ ভঙ্গি, এমনকি দৃশ্যগত পরিবেশনাও বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। অধিকাংশ গানে ব্যবহৃত হয়েছে অ্যানিমেশন, যা অনলাইননির্ভর তরুণদের ভাবপ্রকাশের এক বিশেষ ধরন হয়ে উঠেছে। যুদ্ধের অঙ্গীকার ও ক্রোধ, গানের কথা ও ড্রামের সঙ্গে ইমেজের উত্থান-পতন সম্পূর্ণ মনোযোগ কেড়ে নেয়। আর গানগুলোর শব্দ, ভাষা, বাচনও একেবারে সাধারণ মানুষের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঢাকার স্থানীয় পরিভাষা। ভাষিক দিক থেকে আগ্রাসীও। এসব গানে ১৫ বছরে যেসব অনাচার-অনিয়ম হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করা হয়েছে সরকারকে। একই সঙ্গে ‘সুশীল ভাষা’ পরিহার করে রাস্তার ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের ভাব ও মূর্তিকেও তুচ্ছ করে তোলা হয়েছে, নড়বড়ে করে দেওয়া হয়েছে।

সবচেয়ে লক্ষণীয় হলো, অধিকাংশ গানে পাওয়া যায় অন্ত্যমিলযুক্ত কবিতা আঙ্গিকের লিরিক। আর এসব গানের লিরিক আশ্রয় করেছে ১৯৫২ ও ১৯৭১ সালের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বয়ান। যেমন হান্নানের ‘আওয়াজ উডা’ শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চে দেওয়া ভাষণের রণহুংকার দিয়ে, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ!’ আর শেষে উচ্চারিত হয়, ‘জয় বাংলা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’

‘চব্বিশের গেরিলা’ গানটির টাইটেল ও সশস্ত্র কিছু যুবকের অ্যানিমেটেড ইমেজ নিশ্চিতভাবেই মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা যোদ্ধাদের কথাই স্মরণ করায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের জাতীয় পতাকা এসেছে কথা ও ইমেজ হিসেবে।

বিস্ময়করভাবে দেখা যায়, আন্দোলন চলাকালে তরুণেরা জাতীয় পতাকা মাথায় বেঁধেছে বা বুকে জড়িয়ে নিয়েছে; সুউচ্চ সব স্থাপনার দখল নিয়ে পতাকা উড়িয়েছে। যেন এই পতাকা খামচে ধরেছে এক নতুন শকুন, যার কাছ থেকে দেশকে আবার মুক্ত করতে হবে। এককথায় বলা যায়, চলমান স্বৈরতান্ত্রিক আয়নাঘর থেকে দেশকে মুক্ত করতে তারা বেছে নিয়েছিল আমাদেরই গৌরবজনক ঐতিহাসিক লড়াইয়ের সামষ্টিক স্মৃতি আর চেতনাকে।

কেন তাদের গান আমাদের সামষ্টিক লড়াইয়ের স্মৃতি ও চেতনাকে ধারণ করে, স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর ভাষা ব্যবহার করে তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনাকে উৎখাত করে দিতে সক্ষম হলো, তার সুলুকসন্ধান করতে র‌্যাপ গানের ইতিহাস একটু খুঁজে দেখা দরকার। র‌্যাপ হলো বাদ্যযন্ত্রসহযোগে গাওয়া কবিতার মতো একধরনের গান। নিউইয়র্কের কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকশ্রেণির মাধ্যমে ১৯৭০-এর দশকে এর যাত্রা শুরু। এরপর সারা দুনিয়াতেই তারুণ্যের সাংস্কৃতিক প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে এই গান। বব মার্লের রেগে ও জ্যাজ মিউজিকের সঙ্গে র‌্যাপের রয়েছে আত্মীয়তার সম্পর্ক। ‘গ্যাং কালচার’-এর সঙ্গেও এর নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এমনকি আজকাল যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডে এই শিল্পভঙ্গিকে আদালতে প্রমাণ হিসেবেও দাখিল করা হচ্ছে কোন র‌্যাপের কোন অপরাধী গ্যাংয়ের সদস্য, তা শনাক্ত করতে! যদিও জনপ্রিয়তার কারণে পশ্চিমা বিশ্বে র‌্যাপও এখন হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক পণ্য।

মনোযোগ দিলে দেখা যাবে, পটভূমি বাদ দিয়ে র‌্যাপের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বোঝা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রে যখন দাসপ্রথা চালু ছিল, তখন এই ধারার গানের মাধ্যমেই কালো দাসেরা নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করত, নিজেদের সম্প্রদায়ের স্মৃতি সংরক্ষণ করত, তৈরি করত প্রতিবাদের ভাষা। তারা ব্যবহার করত একধরনের সান্ধ্য ভাষা, যাতে মালিক তাদের গানের অর্থ বুঝতে না পারে।

আরেকটু পিছিয়ে গেলে আমরা র‌্যাপের উৎস খুঁজে পাব আফ্রিকার মাটিতে, তাদের কথ্য ঐতিহ্যের মধ্যে। পশ্চিম আফ্রিকার লোক-ঐতিহ্যে দেখা যাবে ‘নোমো’ নামের এক ধারণা, যাকে ভাবা হয় আদিমানব বলে। দার্শনিক দিক থেকে নোমো হলো শব্দের ভেতরে প্রাণসঞ্চারের সামর্থ্য, যা কোনো বস্তুতে প্রাণও সঞ্চার করতে পারে। আফ্রিকার লোক-ঐতিহ্যের ধারণাটির মাহাত্ম্যই যুক্তরাষ্ট্রের র‌্যাপার ও র‌্যাপ গানের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে শক্তি জুগিয়েছে। এ গান তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। এটি যেমন কালো মানুষের কমিউনিটির গান, স্মৃতি সংরক্ষণের গান, তেমনি প্রতিবাদেরও গান। এ গান তাদের প্রাণ সঞ্চার করে।

‘হয় মৃত্যু, নয় স্বাধীনতা’—এই প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে ফ্রান্সের সান ডমিঙ্গো উপনিবেশের কালো দাসেরা নেপোলিয়নের প্রবল বাহিনীকে পরাস্ত করে স্বাধীনতা ঘোষণা করে তার নাম দিয়েছিল হাইতি। অন্যদিকে বাংলাদেশের নামহীন, গোত্রহীন করে রাখা যুবসমাজ, শিক্ষার্থী আর জনতাও একই রকম অঙ্গীকারে পথে নেমে স্বৈরাচার তাড়িয়েছে। নানামুখী মার খেতে খেতে তারা যেন দাস্য জীবনই পালন করছিল। এই বাস্তবতায় বাংলা র‌্যাপাররা সেই কালো আফ্রিকার উপনিবেশবিরোধী ঐতিহ্যের গায়নরীতি গলায় ধারণ করে গুলি খেতে থাকা, বারবার মরতে থাকা ছাত্র–জনতার জীবনেও প্রাণ সঞ্চার করে দিয়েছিল। জাগিয়ে তুলেছিল বাংলাদেশের হৃদয়। তারা এক মহান গণবিপ্লবও সম্ভব করে তুলতে পেরেছে।

পুরোনো ঐতিহ্যের রাজনীতিকেরা ঘুণাক্ষরেও যেন না ভাবেন যে এ দেশে সাম্য, গণতন্ত্র আর ন্যায়বিচার কায়েম করতে না পারলে তারা কাউকে ছেড়ে কথা কইবে!