‘কথা ক’ গানের প্রচ্ছদে রয়েছে রক্তাক্ত রাজু ভাস্কর্যের ছবি
‘কথা ক’ গানের প্রচ্ছদে রয়েছে রক্তাক্ত রাজু ভাস্কর্যের ছবি

যে সুর জনতার

ছাত্র-জনতার সাম্প্রতিক লড়াইয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শামিল হয়েছিল কবিতা, গান, র‌্যাপ, পোস্টার, কার্টুন আর গ্রাফিতি। এই বিদ্রোহ ও বিপ্লবের ভাষায় ধরা আন্দোলনের মর্মকথা নিয়ে সচিত্র দলিল বিদ্রোহে–বিপ্লবে।

‘নাম বললে চাকরি থাকবে না’—এমন অবদমন আর অদৃশ্য ভয় ছিল আমাদের বহুদিনের সঙ্গী। ছিল স্ব-আরোপিত নিষেধাজ্ঞাও। ফলে জুলাইয়ের পরিসরে—২ তারিখ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কারের লড়াই যখন নতুন করে দানা বাঁধল, তখনো মানুষের মুখে কোনো রা ছিল না। তবে পরিস্থিতি পাল্টে গেল শেখ হাসিনারই একটি বক্তব্যে, ‘মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার’—গতানুগতিক বিভাজনের রাজনীতির ওপর ভর করে এই যুক্তিসংগত আন্দোলনকে ভাগ করতে চাইলেন তিনি। অপমানে ফুঁসে উঠল শিক্ষার্থীরা।

পরের ঘটনা বলপ্রয়োগের। ১৫ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর বেধড়ক পিটুনি, ১৬ জুলাই রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিরস্ত্র আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে পুলিশের গুলি এবং তাঁর অন্যায় হত্যা—সবই দেখলাম আমরা। দেখলাম, বুক টান করে দাঁড়িয়ে আছেন সাঈদ, গুলি ছুটে আসার পরেও কিছু বুঝতে পারছেন না, একসময় লুটিয়ে পড়লেন রাস্তায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ভিডিও দেখার পর গর্জন না করে আর উপায় কী! দীর্ঘদিনের জড়তাবশত আমজনতার বড় অংশ তখনো আড়েঠারেই কথা বলছিল।

এই পটভূমিতে ১৬ জুলাই ইউটিউব আর ফেসবুকে আলোড়ন তুলল একটি র‌্যাপ গান, ‘বায়ান্নরতে চব্বিশে তফাত কই রে? কথা ক…/ আমার ভাই-বইন মরে রাস্তায় তর চেষ্টা কই রে? কথা ক…’। সেজান নামে নারায়ণগঞ্জের তরুণ গায়কের র‌্যাপটি গর্জে ওঠার জন্য সেই দ্বিধায় নিশ্চুপ জনতার বিবেকে যেন চাবুক বসাল।

কোন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে উচ্চকিত হলো আপামর জনতা?

আমাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিভূমি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। ছাত্রদের বুকের রক্ত যেভাবে বায়ান্ন ও একাত্তরে ঝরেছিল, তেমনি স্বাধীন দেশে এই ২০২৪ সালের লড়াইয়ের প্রান্তরও একইভাবে রক্তাক্ত। তাই ‘লাঠির জোরে কলম ভাঙা’র বেদনায় সংক্ষুব্ধ এই গানে সমকালীন বয়ানে হাজির হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ভাববস্তু। মানুষকে মুখ খুলে কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি গানটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতির দিকেও ইঙ্গিত করেছে, ‘দেশ গড়ার সবক দিয়া কামের সময় সইরা যাস!/ কার রক্তে পাড়া দিয়া বিজয় মিছিল কইরা যাস?/ মায়ের বুক খালি কইরা রঙ্গের মহল গইড়া যাস…।’

নারায়ণগঞ্জের আরেক নবীন র‌্যাপ গায়ক হান্নানের ‘আওয়াজ উডা’র মধ্যেও দেখা মেলে একই রকম ইশারা। ১৮ জুলাই প্রকাশিত গানটির শুরু ও শেষে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের কথা, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’

মুক্তিযুদ্ধ আর শেখ মুজিবকে দীর্ঘকাল দলীয় বৃত্তে কুক্ষিগত করে রেখেছিল যারা, তাদের বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করেই এতে মূর্ত হয়েছে হালফিল পটভূমি, ‘গদিত বইছে স্বৈরাচার কত কিছু সইয়া আর/ তর পজিশন টিক্কা থাকব কত ভাই ক মইরা আর…/ আবু সাঈদরে গুল্লি করলি অর্ডার দিল কই থেকা?/ এবার রাস্তায় লাখো সাঈদ কইলজা থাকলে ঠেকাগা!’

গানের ক্ষেত্রে এ আন্দোলনে ‘আওয়াজ উডা’ই প্রথম হাসিনা সরকারকে ‘স্বৈরাচার’ বলার হিম্মত দেখিয়েছে। ‘কথা ক’ আর ‘আওয়াজ উডা’ই ভাইরাল হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কারণ, এগুলোর কথায় জনতার অন্তরের আকুতি তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।

আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর প্রবল জনতরঙ্গের জোয়ারে গান হয়ে ওঠে এক কার্যকর হাতিয়ার। এ সময় থেকে ৫ আগস্ট—আন্দোলনকারীদের ভাষায় ‘৩৬ জুলাই’—সরকার পতন অব্দি ইউটিউব ও ফেসবুকে যেসব গান আপলোড হয়েছে, তার শিল্পীরা বেশির ভাগই তরুণ ও অনামি। আমাদের গণনায় গানের সংখ্যা ৩৭, অবশ্য এর বাইরেও কিছু গান থাকতে পারে।

চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, গানগুলোর মধ্যে ৩১টিই র‌্যাপ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘গদি ছাড়’, ‘দেশ সংস্কার’, ‘বাংলা মা’, ‘দাম দে’, ‘স্বাধীনতার গন্ধ’, ‘রাজাকার’, ‘আবু সাঈদ’, ‘রণক্ষেত্র’, ‘দেশ কারোর বাপের না’, ‘শকুনের চোখ’, ‘চব্বিশের গেরিলা’, ‘জয় বাংলা’ ইত্যাদি। অন্যান্য গানের মধ্যে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে শিরোনামহীনের ‘কেন’, শূন্য ব্যান্ডের ‘শোনো মহাজন’, কাকতালের ‘রক্ত গরম, মাথা ঠান্ডা’ এবং পারিসার ‘চলো ভুলে যাই’।

সংগত কারণেই অধিকাংশ র‌্যাপ গানে শিল্পীর নাম নেই। বেশির ভাগের কথা-সুরে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মূল ভাব উপাদানের নতুনতর ব্যবহার পরিষ্কার। বেশ কয়েকটিতে ব্যবহৃত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার অংশ, সম্পূর্ণ নতুন অর্থে ও তাৎপর্যে। গানের কথায় আর আছে হাসিনা সরকারের দমন-পীড়ন, আবু সাঈদ ও ছাত্র-জনতার হত্যাকাণ্ড এবং দুঃশাসনের সর্বাত্মক চিত্র। যেমন ‘দেশ সংস্কার’-এ উপস্থিত বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁসকারী আবেদ আলীর প্রসঙ্গ, ‘এমন এককাল থেকে ভুল শিখাইলো/ উদ্যোক্তা প্রশ্ন বেইচা লাখে কামাইল/ আবেদ আলী ড্রাইভার, হাতে বানায় বিসিএস ক্যাডার/ দেশে ঘরে ঘরে বিপ্লব আনাইল।’

কোটা সংস্কারের দাবিতে যে আন্দোলনের সূচনা, তা পরিণতি পেল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে।

প্রশ্ন উঠতে পারে যে আন্দোলনের সাংগীতিক পরিসরে এবার র‌্যাপের এত আধিক্য কেন?

১৯৭০–এর দশকে মার্কিন মুলুকে জন্ম নেওয়া সংগীতধারা র‌্যাপের শিকড় পোঁতা আছে আফ্রিকান–আমেরিকান কালো মানুষের সাব–কালচার বা উপসংস্কৃতির ভেতর। র‌্যাপ বাদ্যযন্ত্রসমেত গাওয়া তালনির্ভর এমন এক অন্ত্যমিলযুক্ত সংগীত, যার মাধ্যমে সমাজের নিচুতলার নিপীড়িত মানুষ কথা কয়। এর স্থান উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক নন্দনতত্ত্বের বাইরে। খিস্তিমাখা চাঁছাছোলা কথ্যভাষা এর প্রাণভোমরা।

এক যুগেরও বেশি সময় বাংলাদেশ ছিল ভয়ের সংস্কৃতির আবর্তে। মানুষ এর জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বাক্‌হীন। অন্যদিকে আমাদের মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সাংস্কৃতিক বয়ানে ছিল পতিত শাসকগোষ্ঠীর আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ। এসব র‌্যাপের উদ্ভব ঘটেছে এই পরিমণ্ডলের বাইরে।

‘ব্যবসার এই পরিস্থিতি/ মুরগি খুঁজি তিতি তিতি’, ২০২২ সালে আলী হাসানের গাওয়া ‘ব্যবসার পরিস্থিতি’তে মানুষ মজেছিল কেন? তাতে জনজীবনের প্রতিবিম্ব ধরা পড়েছিল বলে। উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক ভাষা প্রতিবাদে অক্ষম হয়ে পড়ায় জনতার গর্জন যেন নতুন সাংস্কৃতিক ভাষার অপেক্ষা করছিল। র‌্যাপের জন্য পরিস্থিতি তৈরি হয়ে উঠছিল।

তাই আন্দোলনের সময়ে পুরান ঢাকার আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে র‌্যাপের সুর-তরঙ্গ মিলিয়ে ‘রাজাকার’ গানটিতে শ্লেষ আর বিক্ষোভে অনীক যখন গেয়ে ওঠেন, ‘যা আছে তা–ও হারায় যদি—এই ভয়ে চাটতাছো গদি/ তাইলে এখন প্রশ্ন করি, কোনটার বেশি দাম?/ দুই-চার দিনের জন্য ক্ষমতা, টাকাপয়সা নাকি প্রাণ?/ বলো কোনটার বেশি দাম?’, তখন মনে হয়, এসব গান বিক্ষুব্ধ আত্মার, এই সুর জনতার।

সেজান

কথা ক

সেজান

বায়ান্নরতে চব্বিশে তফাত কই রে? কথা ক

দ্যাশটা বলে স্বাধীন তাইলে খ্যাচটা কই রে? কথা ক

আমার ভাই–বইন মরে রাস্তায় তর চেষ্টা কই রে? কথা ক

কালসাপ ধরসে গলা প্যাঁচায়, বাইর কর সাপের মাথা কো?

জোর যার, মুল্লুক তার! আগে ক, মুল্লুক কার?

লাঠির জোরে কলম ভাঙ্গে, শান্তির নামে তুলল খার

কাইল মারলি, পরশু মারলি, মারতে আইলি আজ আবার!

রাজায় যহন প্রজার জান লয় জিগা তাইলে রাজা কার?

আমার মানচিত্র কান্দে আইজকা দেইখ্যা দ্যাশের হাল রে

লাল–সবুজের পতাকা মা পুরাডাই দেহি লাল রে

তলোয়ার হইয়া কাটে যাগো হওয়ার কথা ঢাল রে

পাপের জিহ্বায় সইতারে না উচিত কথার ঝাল রে

মাইয়া–পোলা ফ্রন্টলাইনে, অনলাইনেও সিন ডা

টোকাই ঘুরে চাক্কু হাতে, ঠোল্লা চুড়ি পিন্দা

মারতে আইলে মাইরা দিবি, মুর্দা নাইলে জিন্দা

রাইত দেইখা ডরাইস না কেউ, রাইতের পরেই দিনডা

নিজের ভাইয়ের গোস্ত খাস বিবেকের তলপ্যাডে পোঁচ মাইরা,

যারা তুলে আওয়াজ অগো টিটকারি দেস পোস্ট মাইরা

ছাত্র দিসে ভাষা আইন্যা, দ্যাশ বানাইসে ছাত্ররা

যেই হাতে কলম–খাতা ওই হাতে দেস হাতকড়া

জবান খুললেই জবান সিলাই, আর সিলাইব কয়জনের

একজনে মা পইড়া গেলেও খাড়ায় যাইব ছয়জনে

জন্ম লইসি মরতে মরার ডর দেহাইস না আমাগো

এক সেজানে মরলেও লাখো সেজান কইব কথা ক

বায়ান্নরতে চব্বিশে তফাত কই রে? কথা ক

দ্যাশটা বলে স্বাধীন তাইলে খ্যাচটা কই রে? কথা ক

আমার ভাই–বইন মরে রাস্তায় তর চেষ্টা কইরে? কথা ক

কালসাপ ধরসে গলা প্যাঁচায়, বাইর কর সাপের মাথা কো?

সংক্ষেপিত

হান্নান

আওয়াজ

উডা

হান্নান

আওয়াজ উডা বাংলাদেশ, আওয়াজ উডা বাংলাদেশ

রাস্তায় এত রক্ত কাগো আওয়াজ উডা

আওয়াজ উডা বাংলাদেশ, আওয়াজ উডা বাংলাদেশ

রাস্তায় গুল্লি করল কেডা

আওয়াজ উডা বাংলাদেশ

আমরা বলে রাজাকার কয় দি দেশের রাজা কার?

ছাত্র আওয়াজ না উডাইলে দেশের ভিত্রে হাহাকার

গদিত বইসে স্বৈরাচার কত কিছু সইয়া আর

তর পজিশন টিক্কা থাকব কত ভাই ক মইরা আর

নামছি বুকে পতাকা দেশ বেচতাছস কয় টেকা?

সিলেট যহন ডুইব্বা গেসে পানি আইছে কই থেকা?

আবু সাঈদরে গুল্লি করলি অর্ডার দিল কই থেকা?

এবার রাস্তায় লাখো সাঈদ কইলজা থাকলে ঠেকাগা!

আমার বইন যে মাইরা দিলি, তর ঘরেরটা মারতি তুই?

তর না দেইখ্যা মাইরা দিলি, নিজের ওইলে পারতি তুই?

হকের কেউ খাইয়া লাইলে, এমনে কি আর ছাড়তি তুই?

একটা মারবি দশটা পাডাম, আর কয়ডারে মারবি তুই!

শহীদ হইল আবু সাঈদ এরপর গেল আসিফও

রাফি গেল তারও পরে গেল ওয়াসিম–আদনানও

সোনার বাংলা রয়া যাইব, সোনার ছেলে বাদ্দা গো

কাপুরুষের পরিচয় তগো কইলজা রাখছি মাপ দা গো

ছাত্র ছাড়া লীগ হয় নাই তর লীগের কামডা ঠিক হয় নাই

স্বাধীন বাংলা কইছে খালি, বাংলা আর স্বাধীন হয় নাই

দেশটা যে কারও বাপের একা ওর বাপে কয়া যায় নাই

হের বাপে যা কইরা গেছে ওর ভিত্রে এডি রয়া যায় নাই

যেই বুকে কালকে মেডেল ঝুলব ওই বুকে আজকে গুল্লি কে

কথা হইল মুর্দার দেশে ন্যায়ের আওয়াজ তুলবি কে

বায়ান্নরটা ভুলতারি নাই চব্বিশেরটা ভুলবি কে

শিক্ষার মাজা ভাঙবি তাইলে স্কুল–কলেজ খুললি কে!

বাঙালি তো বোকা ভাই আমরা পায়ে পায়ে ধোঁকা খাই

এত বছর চুইষ্যা খাইছোস পরের পাঁচেও তরে চাই

ঘরের সন্তান যে ঘরে নাই এই চিন্তা আপায় করে নাই

কত ঝড় যে আইল–গেল চেয়ার আপার লড়ে নাই

না কোনো লীগের আমরা, না আইছি কোনো দলেরতে

নামছি রাস্তায় কাফন মাথায় টাইন্না আনুম তলেরতে

সাঈদ, আমি গুল্লি লমু হাসিমুখে নলেরতে

স্টুডেন্ট গো আওয়াজ দাবা, কমান্ড আইসে দলেরতে?

আওয়াজ উডা বাংলাদেশ, আওয়াজ উডা বাংলাদেশ

রাস্তায় এত রক্ত কাগো, কথা ক বাংলাদেশ

আওয়াজ উডা বাংলাদেশ, আওয়াজ উডা বাংলাদেশ

আমার ভাই–বইন মারছে কেডা

আওয়াজ উডা বাংলাদেশ