‘লাঠিয়াল’ ছবিতে ফারুক ও ববিতা
‘লাঠিয়াল’ ছবিতে ফারুক ও ববিতা

সাধারণের কাছে কেন জনপ্রিয় নায়ক ফারুক?

আজ প্রয়াত হয়েছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ‘মিয়া ভাই’ হিসেবে খ্যাত নায়ক ফারুক। চলচ্চিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি। সাধারণ দর্শক কেন গ্রহণ করেছিলেন তাঁকে?

মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে ফারুকের। তাঁর অভিনীত শতাধিক চলচ্চিত্রের অধিকাংশই ছিল ব্যবসাসফল। শুধু তা–ই নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে জনমানুষের কাছে সুবিশাল গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন তিনি। যেসব চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ফারুক জনসাধারণের ‘নায়ক’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘আলোর মিছিল’, ‘লাঠিয়াল’, ‘সারেং বৌ’, ‘সুজন সখী’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘নয়নমণি’, ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘মিয়া ভাই’, ‘সাহেব’, ‘লাঠিয়াল’ প্রভৃতি।

যদি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ফারুক কেন জনপ্রিয় হয়েছিলেন, তার কার্যকারণ বিশ্লেষণ করা হয়, তখন বেশ কিছু প্রসঙ্গ উঠে আসে। ফারুকের জনপ্রিয়তার পেছনে তাঁর সাবলীল অভিনয়ক্ষমতা তো বটেই, রয়েছে আরও কিছু সমাজিক বিষয়–আশয়।

চিত্রনায়ক ফারুক

বলা দরকার, ফারুক—যাঁর পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান—বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তিনি খ্যাত ছিলেন ‘মিয়া ভাই’ হিসেবে। আজ ১৪ মে বাংলাদেশ সময় সোমবার সকাল সাড়ে ৮টায় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু ঘটল। আর এর সঙ্গে সমাপ্তি ঘটল একটি অধ্যায়ের।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া সদ্য স্বাধীন দেশে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে সঙ্গে  চলচ্চিত্রেরও নতুন সূচনা ঘটেছিল। এই সূচনা পর্বে বিশেষ অবদান ছিল মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফেরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশের অবকাঠামোগত পুনর্নিমাণের পাশাপাশি সংস্কৃতির বিনির্মাণও অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল তখন। ফলে যুদ্ধ–পূর্ববর্তী দশকে এ দেশে বিশেষভাবে জনপ্রিয় সংস্কৃতির রূপ পরিগ্রহকারী চলচ্চিত্র মাধ্যমের প্রতিও ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ আগ্রহ। তারই ধারাবাহিকতায় এসব মুক্তিযোদ্ধার অংশগ্রহণে স্বাধীনতার অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই এ দেশের চলচ্চিত্র মাধ্যমটি পুনরায় জনমানুষের সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিতে সমর্থ হয়েছিল। আর সে সময় চলচ্চিত্র মাধ্যমে নানাভাবে যুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদেরই একজন ছিলেন নায়ক ফারুক।

খেয়াল করলে দেখা যাবে, ফারুক অভিনীত অধিকাংশ চরিত্রই ছিল এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধি তথা গ্রামীণ যুবকের চরিত্র। ফলে সদ্য স্বাধীন দেশে গড়ে ওঠা নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা মুখ্যত গ্রাম থেকে এসেছিল, তারা ফারুক অভিনীত চরিত্রের মধ্যে নিজেদের খুঁজে পায়। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর দেশের আর্থসামাজিক অবস্থায় নানাভাবে পীড়িত জনগোষ্ঠীও গ্রহণ করেছিল ফারুককে।

‘সারেং বৌ’ ছবিতে কবরী ও ফারুক

কেন তারা এই নায়ককে গ্রহণ করেছিল?

কেননা, ফারুক অভিনীত চলচ্চিত্রসমূহ—সে ‘নয়নমণি’, ‘সুজন সখী’ কি ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’—দৃষ্টান্ত হিসেবে যেটিকেই দেখা যাক হোক না কেন, এখানে দর্শক ফারুককে দেখতে পান প্রতিবাদী রূপে, সামাজিক–পারিবারিক নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন এ নায়ক। এ কারণেও তাঁর চলচ্চিত্রগুলো ‘বক্স অফিসে হিট’ করার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ দর্শকের নৈকট্য পেয়েছিলেন ফারুক।

ফারুক অভিনীত অধিকাংশ চরিত্রই ছিল এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধি তথা গ্রামীণ যুবকের চরিত্র। ফলে সদ্য স্বাধীন দেশে গড়ে ওঠা নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা মুখ্যত গ্রাম থেকে এসেছিল, তারা ফারুক অভিনীত চরিত্রের মধ্যে নিজেদের খুঁজে পায়। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ–উত্তর দেশের আর্থসামাজিক অবস্থায় নানাভাবে পীড়িত জনগোষ্ঠীও গ্রহণ করেছিল ফারুককে।

আবার সেই সময়ের গ্রামীণ সমাজে বৈষম্যের শিকার দর্শকও নায়ক ফারুক অভিনীত চরিত্রের মধ্যে নিজের ব্যর্থতা আড়াল করার মতো সান্ত্বনা হয়তো খুঁজে পেয়েছিলেন। কেননা, ফারুক অভিনীত চরিত্রসমূহ যেভাবে মাতবর শ্রেণি তথা সমাজের উঁচু শ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, সেই লড়াইয়ের স্বপ্ন বাস্তবিক মানুষ নিজের ভেতর বারবারই অনুভব করেছেন। কিন্তু পরিবেশ–পরিস্থিতির কারণে তাঁরা হয়তো সেই লড়াই করতে করতে পারেননি। ফলে চলচ্চিত্রের পর্দায় ফারুক যখন লড়াই করেন, তখন স্বভাবতই উল্লসিত হন দর্শক। মোটকথা সে সময়ের যাঁরা দর্শক, তাঁরা নিজেদের স্বপ্ন, প্রেম, আশা, প্রত্যাশা, সঙ্গী নির্বাচন ও সঙ্গীর প্রতি দায়বদ্ধতা, দুঃখ-যন্ত্রণার নানা প্রতিরূপ কিংবা যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন ফারুক অভিনীত চরিত্রসমূহের ভেতর। সংগত কারণেই অতি সহজেই নায়ক ফারুক এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দর্শকের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

‘সুজন সখী’ ছবিতে কবরী ও ফারুক

সদ্য স্বাধীন দেশের অর্থনৈতিক ও পরিকাঠামোগত প্রায় ভঙ্গুর একটি সমাজে নিত্যদিন মানুষের ঘরে-বাইরে যে সংগ্রাম চলমান ছিল, সেই সব বিষয়াই তখনকার চলচ্চিত্রে বিশেষভাবে স্থান পেয়েছিল। যার মধ্যে খাদ্যের জন্য সংগ্রাম, সমাজে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার লড়াই—এগুলো যেমন ছিল, একইভাবে ছিল পরিবার-পরিজন ও সঙ্গীর প্রতি দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গও। স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে ফারুক অভিনীত চরিত্রগুলোয় এসব উপাদানের আপাত বাস্তবিক রূপায়ণ দেখতে পেয়েছিলেন দর্শকে। তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছিলেন সমাজের নানা স্তরে বিরাজমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহী গ্রামীণ যুবকের প্রতিনিধিকে। তাই তিনি সহজেই হয়ে উঠেছিলেন এ দেশের মানুষের কাছের মানুষ তথা গ্রামেরই একজন ‘মিয়া ভাই’।

‘নয়নমণি’ ছবিতে আনোয়ারা ও ফারুক

ফারুকের জনপ্রিয়তার নেপথ্যে এসব সামাজিক প্রপঞ্চের সঙ্গে সঙ্গে আগেই বলেছি, ক্রিয়াশীল ছিল তাঁর সাবলীল অভিনয়ক্ষমতা। বিশেষত তাঁর চরিত্রগুলোর কথোপকথন ভঙ্গিমা ও কণ্ঠস্বর। বলা ভালো, ফারুকের কণ্ঠস্বরের মধ্যে যে স্বকীয়তা ছিল, তা কখনোই মানুষের কাছে অপরিচিত কিংবা আরোপিত হিসেবে চিহ্নিত হয় না; বরং এটা ছিল কাছের মানুষের বলা কথার মতোই। এ ছাড়া তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলো যেভাবে সিনেমার পর্দায় উপস্থাপিত হতে দেখা যায়, তাতে এগুলো মূর্ত হয়েছিল সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে। সবকিছুর পরও নিজের অভিনয়ক্ষমতা দিয়েই ফারুক সাধারণ মানুষের ভেতর এই অনুভূতি জারিত করতে পেরেছিলেন যে ‘আমি তোমাদের লোক’।

সেকালের বাস্তবতায়, সমাজে যখন ছিল প্রবল বিদ্রোহ ও বিপ্লব–প্রতিবিপ্লব, তখন এই ‘তোমাদের লোক’ হওয়া কিন্তু সহজ ছিল না। কিন্তু ফারুক তাঁর চরিত্ররূপায়নের ক্ষেত্রে এটি পেরেছিলেন তাঁর অভিনয় ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে।

সব শেষে বলা যায়, এ দেশের খেটে খাওয়া ও নিম্নমধ্যবিত্ত–মধ্যবিত্ত শ্রেণির চলচ্চিত্র দর্শকেরা নায়ক ফারুক অভিনীত গ্রামীণ যুবকের চরিত্রগুলো গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরাই আকবর হোসেন পাঠানকে নায়ক ফারুক বা ‘মিয়া ভাই’ হিসেবে বরণ করেছিলেন।