মৃত্যুর কিছুকাল আগে নেওয়া এই সাক্ষাৎকারে সাহিত্য ও ব্যক্তিজীবন নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন আবুল হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শ্যামল চন্দ্র নাথ
শ্যামল চন্দ্র নাথ: দীর্ঘদিন ধরে কবিতা লিখছেন আপনি। আপনার প্রথম লেখা কবে প্রকাশিত হয়?
আবুল হোসেন: আমার প্রথম লেখা ছাপা হয় কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পড়া অবস্থায়। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। আমাদের স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল লেখাটি। এরপর শেষ লেখা বাংলা একাডেমির উওরাধিকার পত্রিকায়।
শ্যামল: অনেকের ক্ষেত্রে এমন ঘটেছে যে লেখালেখির প্রেরণা তাঁরা পরিবার থেকে পেয়েছেন। আবার কারও কারও লেখক হয়ে ওঠার পেছনে পারিবারিক আবহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আপনার ক্ষেত্রে পারিবারের কোনো ভূমিকা ছিল কি?
আবুল: সত্যি বলতে কি তেমনভাবে ছিল না। আসলে আমি কীভাবে লেখক হয়ে উঠলাম, কবিতা লিখলাম, সেটি একটা রহস্যই বটে। আজ তা আর বলতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি, আমার বাবার গানের শখ ছিল। যে সময়ের কথা বলছি, মুসলমান পরিবারে সেই সময় গান গাওয়া ছিল ভীষণ গর্হিত কাজ। বাবার গান গাওয়াই কি আমার ভেতরে কোনো প্রেরণা জুগিয়েছে? জানি না। ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল বাগেরহাটে পাকিস্তানিরা আমার বাবাকে মেরে ফেলে। বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। তাঁকে নিয়ে পরে আমি একটা কবিতাও লিখেছিলাম মনে পড়ে।
শ্যামল: বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন, আপনার প্রথম দিকের কবিতায় রবীন্দ্র-ঘরানার প্রভাব আছে। পরে আপনি সেই প্রভাব থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছেন। কীভাবে ঘটল ঘটনাটি?
আবুল: প্রথম যখন লিখতে শুরু করি, তখন একদিকে রবীন্দ্রবলয়ের প্রবল প্রতাপ, অন্যদিকে তিরিশের কবিদের উত্থানকাল। ফলে আমরা এক যুগসন্ধিক্ষণে লেখালেখি শুরু করলাম। ১৯৩৯-এর আগে আমি যেসব কবিতা লিখেছি, সেগুলোতে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল। কিন্তু পরে আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করি। এ সময় কবিতা পত্রিকায় ‘নবযুগ’, ‘বাংলার মেয়ে’, ‘বাংলার ছেলে’, ‘ট্রেন’—এই কবিতাগুলো যখন বেরোল, নিজেকে খুঁজে পেলাম আমি। ফলে ’৩৯-কে আমি মনে করি আমার যাত্রা শুরুর কাল।
শ্যামল: ৪০ দশকে আপনার সমকালীন কবিদের মধ্যে আপনার বিবেচনায় কারা গুরুত্বপূর্ণ, কাদের এগিয়ে রাখবেন এখন?
আবুল: অবশ্যই সুকান্ত ভট্টাচার্য ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তাঁরা অনেক ভালো লিখেছেন। আমার মনে হয়, এঁরাই তাৎপর্যপূর্ণ। আরেকজনের কথা বলতেই হবে—সমর সেন। সম্ভবত আমি যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ি, তখন তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। কবিতাকে কতটা নিরাভরণ করা যায়, এই চেষ্টা ছিল সমর সেনের। গদ্যকবিতায় তিনি অসাধারণ। তাঁকে আমি খুব উঁচুদরের কবি মনে করি। সমর সেন যখন বুঝতে পেরেছেন, তাঁর আর বলার কিছু নেই, সে মুহূর্তেই থামিয়ে দিয়েছেন কবিতা লেখা। কবি-লেখকদের জন্য এই বোঝাবুঝি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
শ্যামল: কাব্যিক ভাষার বিপরীতে আপনার কবিতায় আমরা বরাবরই কথ্যরীতির ব্যবহার দেখতে পাই। অনেকে বলেন, মুখের ভাষাকে কবিতা করে তুলেছেন আপনি। এ বিষয়ে কী বলবেন?
আবুল: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাবে, বাংলায় একটা কাব্যিক ভাষা গড়ে উঠেছিল, সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা থেকে যার অবস্থান বেশ দূরে। কবিতার ক্ষেত্রে এই প্রবণতাটি অনেক বেশি। আমার কাছে বিষয়টিকে কৃত্রিম মনে হয়। তাই কবিতায় বরাবরই আমি এ কৃত্রিমতাকে বর্জন করতে চেয়েছি। শোনো, বানানো কাব্যিকতাকে আমি ঘৃণা করি। কবি বা কবিতা ভিন্ন ঘরানার কিছু—বিশেষ কোনো প্রজাতি, এমনভাবে কখনো ভাবিনি। কবি আমার কাছে সমাজের অন্যান্য লোকের মতোই একজন। কাব্যের একটা প্রচলিত ভাষা আছে, যে ভাষায় লিখলে সহজেই কবিখ্যাতি পাওয়া যায়, কিন্তু ওই সোজা পথে চলতে আমার ইচ্ছে হয়নি। আমি সব সময় আমার নিজের পথটা খুঁজতে চেয়েছি। মনে হয়েছে, কথ্যরীতি ব্যবহার করলে বাংলা কবিতা ক্রমেই সাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসতে পারবে। তাই কথ্যরীতির প্রতিই ছিল আমার মনোযোগ। অনেকে ভাবেন, আমি কেবল গদ্যকবিতাই লিখেছি। কিন্তু মজার বিষয় হলো, আমার গদ্যকবিতার সংখ্যা খুব কম।
শ্যামল: কবিতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আপনার বিতর্ক হয়েছিল—এ ঘটনা অনেকের জানা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতি মনে আছে?
আবুল: হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কবিতা নিয়ে আমার বিতর্ক হয়েছিল। তাঁর কবিতা নিয়ে আমি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। তিনিও তার জবাব দিয়েছিলেন আরেকটি প্রবন্ধে—এসব অনেক পরের ঘটনা। রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখি ’৩৮ সালে, শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গিয়ে। তখন অবশ্য কথা হয়নি। দূর থেকে শুধু তাঁকে দেখেছিলাম। এরপর ১৯৪০ সালে সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের সঙ্গে গেলাম রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে। প্রথম দিন দেখা হলো না। দ্বিতীয় দিন দেখা হলো। মনে আছে, আমরা আগের দিনও এসেছিলাম জানতে পেরে রবিঠাকুর সেদিন আমাদের বলেছিলেন, আপনারা অদ্দুর থেকে এসেছিলেন! দরজা ভেঙে এলেন না কেন? কথাবার্তায় খুব নাটকীয় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমি তাঁকে বলেছিলাম, শিক্ষার অভাবেই সাহিত্যে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। শুনে কবি বললেন, এই পথেই তোমাদের মুক্তি হবে।
শ্যামল: জীবনানন্দ দাশের সঙ্গেও দেখা হয়েছে আপনার, তাই না?
আবুল: অনেককাল আগের কথা। সব কিছু ঠিকঠাক মনে নেই। যতদূর মনে পড়ে, ভেতরে ভেতরে জীবনানন্দ ছিলেন খানিকটা বিষণ্ন প্রকৃতির। তাঁর মধ্যে কোনো ধরনের চাঞ্চল্য আমি কখনো লক্ষ করিনি। ‘বনলতা সেন’ নিয়ে আমি আলোচনা লিখেছিলাম। একদিন দেখা হতেই তাঁকে বললাম, দেখুন, আমি আপনার কবিতা নিয়ে আলোচনা লিখেছি। আপনার লেখা একেবারে ভিন্ন, অন্যদের চেয়ে আলাদা। আবার কোনো কোনো সময় এমনও হয় যে আপনার লেখা বুঝতেই পারি না। আমার কথা শুনে সেদিন হেসেছিলেন জীবনানন্দ দাশ।
শ্যামল: ১৯৪৭ সালে ভারতবিভাগের পর যখন স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে এলেন, তখনকার কথা মনে আছে?
আবুল: সে বড় কষ্টের স্মৃতি। দেশবিভাগ আমাকে বিপর্যস্ত করেছিল। কলকাতা ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হয়েছিল আমার। ঢাকা তখন আমার কাছে এক অচেনা দেশ। এখানে আমি ছিলাম খুবই একা। বন্ধুবান্ধব তেমন কেউ ছিল না। আবার এখানকার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনেও ছিল দারুণ শূন্যতা। ফলে প্রথম দিকে মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট হয়েছিল।
শ্যামল: এবার একটু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করব, আপনি তো কলেজে পড়া অবস্থায় প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন...
আবুল: প্রেমের কথা বলছ! (হেসে) সে ছিল ভিন্ন সম্প্রদায়ের। তখন তো সমাজব্যবস্থা এখনকার মতো ছিল না। বিশেষত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভীষণ রক্ষণশীলতা ছিল। ফলে আমার দুজনে সিদ্ধান্ত নিলাম যে নিজেদের মধ্যে আমরা যোগাযোগ রাখব কিন্তু বিয়ে করব না। শাহানার সঙ্গে বিয়ের পরও আমার সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল, কথা হতো প্রায়ই। চিঠির লেনদেন ছিল গত কয়েক বছর পর্যন্তও। এখন তো আর লিখতে পারি না। তবে যোগাযোগ আছে। সে এখনো জীবিত। তাই তার নাম বলতে পারব না।
শ্যামল: আপনার জীবনে সবচেয়ে কষ্টজনক ঘটনা কোনটি?
আবুল: আমার মা ও স্ত্রী শাহানার চলে যাওয়া। আমার স্ত্রী তো ১৯৯৪ সালেই আমায় একা করে দিয়ে চলে গেছেন।
যাওয়ার আগে তিনি আমায় নিয়ে ছেলেমেয়েদের করণীয় সমন্ধে অনেক কথা লিখে যান। সন্তানেরা মায়ের সেই কথাগুলো বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলেছে। স্ত্রী ছাড়া এখন মাঝেমধ্যেই বাবার মুখটি খুব মনে পড়ে। তাঁর জন্য কষ্ট হয়।
শ্যামল: আবার সাহিত্য প্রসঙ্গ। কবিতায় দশক বিভাজনরীতিকে কীভাবে দেখেন আপনি?
আবুল: কবিতার আন্দোলন কোনো কিছু মেনে চলে না। দশক সময়ের একটি চিহ্নমাত্র। কোনো একটি দশকে হয়তো কাউকে পাওয়া যেতে পারে। যেমন, বাংলা কবিতায় ঘটেছিল তিরিশের দশকে। এরপর অনেক দিন আর কিছুই ঘটল না। এখানে আমার একটি প্রশ্ন আছে, কাজী নজরুল ইসলামকে কেউ দশকে ফেলে আলোচনা করেননি কেন? জসীমউদ্দীন দশক কোনটা?
শ্যামল: আপনার কি কখনো মনে হয়েছে লেখালেখিতে আরও বেশি সময় দেওয়া দরকার ছিল? অনেকের অভিযোগ, আপনি কবিতা কম লিখেছেন।
আবুল: আগে অনেক লিখতাম। একসময় সেটা কমিয়ে দিই। এই কম লেখার পেছনে আবু সয়ীদ আইয়ুবের সতর্কতা কাজ করেছে। আইয়ুব বলতেন, এত লেখেন কেন? বেশি লিখলে কি লেখা ভালো হয়? একদিন আমায় বললেন, কোনো লেখা কখনো পুনরায় বলবেন না। একবার যা লিখেছেন তা আর লিখবেন না। এসব বলে তিনি জীবনানন্দ দাশের উদাহরণ দিলেন। তবে এখন তো আর লিখতেই পারি না। বলতেও কষ্ট হয়।
শ্যামল: আপনার সাহিত্যজীবনের ঋণস্বীকার যদি করতে হয়, তবে কাদের কথা বলবেন?
আবুল: ঋণের কোনো শেষ নেই। বাংলা ও ইংরেজি কবিতার একটা বড় অংশের কাছে আমি ঋণী। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক প্রফুলচন্দ্র, ডক্টর সুবোধ সেনগুপ্ত, তারকানাথ সেন, ডক্টর রাধাগোবিন্দ বসাক আরও অনেকেই রয়েছেন। সবার নাম এখন মনে পড়ছে না। এ ছাড়া সৈয়দ মুজতবা আলী, তাঁর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন সাহিত্যালোচনায় কাটিয়েছি। তবে আমি সবচেয়ে ঋণী আবু সয়ীদ আইয়ুবের কাছে। তাঁর কাছে পেয়েছিলাম রুচি ও পরিমিতি বোধ।
শ্যামল: কবিতা লেখার ক্ষেত্রে একসময় আপনার যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে সেই দৃষ্টিভঙ্গির কি পরিবর্তন ঘটেছে?
আবুল: শুরুতে যখন কবিতা লিখতাম, কবিতার বিষয় ও ভাষা, ছন্দ ও মিল—এসব নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা ছিল না। লিখতে ভালো লাগত তাই যথেষ্ট। সে সময় অনেক বিষয়েই লিখেছি। ছন্দালংকারেরও আধিক্য ছিল। পরে আমি মানুষের মুখের ভাষার প্রেমে পড়েছিলাম। ফলে অপ্রত্যাশিত লাভ হলো এই, কবিতা হয়ে উঠল সহজ-সরল।