>
ভারতীয় নতুন ধারার সিনেমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতা কুমার সাহানি। বাঙালি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের সরাসরি ছাত্র ছিলেন তিনি। কাজ করেছেন বিশ্বখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক রবার্ট ব্রেঁসোর সঙ্গে। ডিসেম্বরের শুরুতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৫তম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও বিকল্প চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি যোগ দিয়েছিলেন প্রধান অতিথি হিসেবে। এ সময়ে কুমার সাহানির একটি সাক্ষাৎকার নেন ভারতের পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে তাঁরই ছাত্র বাংলাদেশের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের সভাপতি জাহিদুর রহিম অঞ্জন
জাহিদুর রহিম অঞ্জন: আপনি তো অনেক দিন পর আবার বাংলাদেশে এলেন, কেমন লাগছে সব?
কুমার সাহানি: বাংলাদেশ নিয়ে আমার এত সব মধুর স্মৃতি যে এখানে বারবার ফিরে আসতে চেয়েছি। মাঝে ২০ বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু আমি কখনোই সেই সব স্মৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়িনি। আমার মনে হয়েছে কোনো না কোনোভাবে এটা ঘরে ফিরে আসা। তুমি তো জানো, ঋত্বিকদা আমার গুরু। আমি কখনো ভাবতে পারি না তিনি বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশ থেকে এসেছেন, তাঁর শিকড় তো এখানেই। আমি মূলত সিন্ধুর লোক, ছোটবেলায়ই আমরা বসবাসের জন্য বোম্বে (মুম্বাই) চলে এসেছি। শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেদনা আমি জানি। এখানকার প্রকৃতি আর মানুষের উষ্ণ সান্নিধ্য আমাকে নিজের বাড়ির কথা মনে করিয়ে দেয়, যেন আমি মাতৃজঠরে ফিরে এসেছি।
অঞ্জন: সিনেমা বানানোর ধারণা আপনার মাথাতে কীভাবে এল?
কুমার: তুমি যখন ছিন্নমূল হবে, তখন তোমাকে সব সময় কিছু না কিছু হারানোর যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হবে। ভাষা হারানোর বেদনা তার মধ্যে অন্যতম। আমি একটা বড় একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে উঠেছি। ছোটবেলায় সিন্ধুতে আমি মাত্র দুই মাস স্কুলে গিয়েছিলাম। স্কুল আমার একদমই ভালো লাগেনি। একদিন মাকে এসে বললাম, ‘আমি আর স্কুলে যাব না।’ মা বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমার বড় ভাইয়েরা আছে, ওরা তোমাকে এক একজন এক এক বিষয়ে শিখিয়ে দেবে।’ ওখানে আমি কিছুটা সিন্ধি ভাষা শিখেছিলাম। এরপরে বোম্বে এসে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হলাম। আমি আসলে কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার নিজস্ব কোনো ভাষা ছিল না। ভাষার এই অনুসন্ধানই আমাকে সিনেমায় নিয়ে এসেছে। বলা যায়, সিনেমাই আমার নিজের ভাষা।
অঞ্জন: ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়ার সময়ই আপনি অনেক পণ্ডিত, শিল্পীদের সান্নিধ্যে এসেছেন। ডি ডি খোসাম্বি, অশোক কেলকার, ঋত্বিক ঘটক তাঁরা কীভাবে আপনাকে প্রভাবিত করেছেন?
কুমার: অবশ্যই তাঁদের প্রভাব আমার ওপর ভীষণভাবে কাজ করেছে। আমি যত ছবি বানিয়েছি, কোনো না কোনোভাবে সেগুলো ঋত্বিক ঘটক দিয়ে মোহাচ্ছন্ন। এটা অনেক অংশে ঐন্দ্রজালিক। তাঁর কাছ থেকে চলচ্চিত্রকার হিসেবে আমার নিজস্বতাকে বুঝতে শিখেছি। আর খোসাম্বি অথবা কেলকর আমাকে ইতিহাসের সঙ্গে সংযুক্ত হতে সাহায্য করেছেন। আমি যখনই কোনো দৃশ্যে ধারণ করি, তার মধ্যেকার ইঙ্গিত আর ইতিহাস আমার সামনে হাজির হয়। এখানে ইতিহাসের অর্থ হচ্ছে, কোনো না কোনোভাবে এর পেছনে ‘হিউম্যান এজেন্ট’ কাজ করে। এই ইতিহাস ও ইঙ্গিতময়তা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অঞ্জন: আপনার একটা সাক্ষাৎকারে আপনি উল্লেখ করেছেন ঋত্বিক ঘটক কীভাবে আপনাকে শব্দের নতুন জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।
কুমার: ঋত্বিক ঘটক আমাদের সামনে শব্দের বিকল্প জগতের গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। দুটি শব্দকে পাশাপাশি রাখলে তারা শুধু একে অন্যের সঙ্গে সাদৃশ্যেই তৈরি করে তা–ই শুধু নয়, তৃতীয় কোনো ভাব প্রকাশের অনুষঙ্গে পরিণত হয়। এ কারণেই রুশ চলচ্চিত্র নির্মাতা সের্গেই আইজেস্টাইনের ওভার টোনাল মন্তাজের ধারণাকে আমার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। ক্যামেরা বা মাইক্রোফোন আমাদের জন্য সবকিছু বাস্তবসম্মতভাবে ধারণ করে বটে, কিন্তু শিল্প কাজ করে এর ঊর্ধ্বে, সৃজনশীলভাবে। বাস্তববাদীদের সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব এখানেই। আমার ছবি বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু বাস্তববাদী সিনেমা নয়।
অঞ্জন: আমরা সচরাচর যে ধরনের ছবি দেখতে অভ্যস্ত, আপনার আখ্যানবিন্যাস, নির্মাণকৌশল তা থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র। আপনার ছবি কি ভারতীয় দর্শন অথবা শিল্প–ভাবনার সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত?
কুমার: অবশ্যই আমার ছবি ভারতীয় অনুভূতিকে ধারণ করে। তবে এটাকে আমি তথাকথিতভাবে ভারতীয় বলতে চাই না। প্রতিটি শিল্পচিন্তার একটি স্থানিকতা আছে। মানুষ আর জল হাওয়াই তো শিল্পের উৎসস্থল। এখনকার সময়ে স্থানিকতা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু একটু বড় পরিসরে দেখলে বোঝা যায়, এ অঞ্চলের মানুষের ভাবনার ঐক্য তাদের শিল্পচিন্তায়ও ছায়াপাত করেছে। ধরো, আমাদের মার্গ সংগীতের শ্রুতির ধারণা, এটা শুধু ভারতীয় নয়, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত প্রবহমান। ফলে আমাদের সংগীত অন্যদের চেয়ে আলাদা। সেটার ছাপ তো কোনো না কোনোভাবে তোমার ছবিতে এসে যাবে। একইভাবে জীবনের অভিজ্ঞতা, জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের থেকে আমাদের ক্ষেত্রে আলাদা। সেটাকে যদি ভারতীয় বলো, তো ভারতীয়। তবে অবশ্যই সেটা বৃহৎ অর্থে।
অঞ্জন: আপনি তো রবার্ট ব্রেঁসোর সঙ্গে কাজ করেছেন, আবার ঋত্বিক ঘটক আপনার গুরু। তাঁরা দুজনেই আপনার সিনেমাকে প্রভাবিত করেছেন। কিন্তু এই দুই মহান শিল্পী তো একে অন্যের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা...
কুমার: হ্যাঁ, এটা ঠিক, তাঁরা দুজনেই একেবারে ভিন্ন ধরনের নির্মাতা। কিন্তু তাঁদের দুজনের ছবিই অর্থবহ ও ইঙ্গিতপূর্ণ, সেই অর্থে যে তাঁরা দুজনেই বাস্তবতার ধারণাকে অস্বীকার করেছেন। আমি যখন ফ্রান্সে যাই, তখন জা লুক গদার বা ফ্রাসোয়া ত্রুফোর মতো পরিচালকেরাই তারকা নির্মাতা, কিন্তু ব্রেঁসোর বালথাজার দেখার পরে আমি ঠিক করেছিলাম যদি কারও সঙ্গে কাজ করতে হয়, তবে তিনি হবেন রবার্ট ব্রেঁসো। কারণ, মানবচিন্তার মূলসূত্রগুলোর সঙ্গে ঋত্বিক ও ব্রেঁসো—তাঁদের দুজনের কোথাও না কোথাও মিল আছে। আমার মতে, তাঁরা দুজনেই সুফিদের মতো প্রাতিষ্ঠানিকতাকে অস্বীকার করেছেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন ঐশ্বরিক শক্তির সঙ্গে তোমার নিজেকেই সংযুক্ত হতে হবে। বোঝাপড়া আসলে নিজের আত্মার সঙ্গে নিজেরই। সেভাবে দেখলে ঋত্বিকদা ও ব্রেঁসো খুব আলাদা নন। আমিও বিষয়গুলোকে সেভাবেই দেখতে চেয়েছি।
অঞ্জন: আপনি তো অনেক বিখ্যাত শিল্পীর ওপর ও সংগীত নিয়ে ছবি তৈরি করেছেন। বানিয়েছেন ভবন তরন, ব্যম্বু ফ্লুট আর অবশ্যই খেয়ালগাথা–এর মতো ছবি। এর পেছনে কোনো নির্দিষ্ট কারণ আছে কি?
কুমার: এটা আমার জন্য একধরনের পরিভ্রমণ। তাঁদের মধ্য দিয়ে আমি নিরন্তর কিছু না কিছু শিখতে থাকি। কেলু চরণ মহাপাত্র একজন অসামান্য নৃত্যশিল্পী। হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া আমার প্রথম ছবি মায়া দর্পণ–এ একটু বাজিয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কাজ করলে জীবন সম্পর্কেও তুমি অনেক কিছু শিখতে পারবে। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, মহাবিশ্বকে সম্ভাষণ করার অনেক পদ্ধতি আমরা ভুলে বসে আছি। যেমন ধরো প্রার্থনা। প্রকৃত প্রার্থনা বলে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এমনি করে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হারিয়ে ফেলছি। এটা খুবই দুঃখজনক।
অঞ্জন: আপনার প্রায় সব ছবিতেই কে কে মহাজন ক্যামেরায় কাজ করেছেন। তাঁর সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন।
কুমার: আমাদের শুরুটা ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে। আমার ডিপ্লোমা ফিল্ম কে কে মহাজন করেছেন। আমার প্রথম ছবিতেই আমি তাঁর কাছ থেকে অনেক অসম্ভব কিছু চাইছিলাম, আর তিনিও আমাকে উচ্চারণ–অযোগ্য ভাষায় তিরস্কার করতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আমার কাজটা করে দিতেন। আমার মনে আছে, চলন্ত ট্রেনে তিনি কীভাবে শট নিয়েছিলেন, আর ক্যামেরা বাক্সের রুপালি দিক দিয়ে আলো তৈরি করেছিলেন। তিনি সবচেয়ে কম সুযোগ–সুবিধার মধ্যে সবচেয়ে ভালো কিছু তৈরি করার ক্ষমতা রাখতেন। আর মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য। ধরো, কোনো পাহাড়ের ওপরে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা না বলে বসে থাকতে পারতাম। তাঁকে তখন আমার লামা সাধুদের মতো মনে হতো। কিছু না বলেও আমরা যোগাযোগ তৈরি করতে পারতাম। এমন ক্যামেরাশিল্পী ভারতবর্ষে বিরল।
অঞ্জন: আপনার এখনকার ভাবনা কী? নিশ্চয়ই নতুন কিছু ছবির পরিকল্পনা আছে।
কুমার: অর্থনৈতিকভাবে আমি এমন ভালো অবস্থার মধ্যে নেই যে ইচ্ছা করলেই ছবির কাজে হাত দিতে পারি। মানুষের মূল্যবোধের ভেতরে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। জানি না আর কখনো আমি ছবি বানাতে পারব কি না। দেখো ভারতে কী হচ্ছে। আমি তো ভাবতেই পারি না আমরা কোথায় যাচ্ছি, আর এর থেকে মুক্তির পথই বা কী?