প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতে ব্যর্থ হয়ে রেডক্রসের অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার হিসেবে যে ইতালি থেকে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কর্মজীবনের শুরু, সে দেশেই পরবর্তী সময় তাঁকে এবং তাঁর বইপত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে টরন্টো স্টার পত্রিকার তরুণ সাংবাদিক হিসেবে ইতালি থেকে পাঠানো রিপোর্টে দেশটির শাসক বেনিতো মুসোলিনির কিছু সৎগুণ বের করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু ছয় মাস পরই তাঁর মনোভাব সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল। লোকটিকে ইউরোপের সবচেয়ে বড় ধাপ্পা বলে অভিহিত করে তিনি লেখেন, ‘তিনি যদি আমাকে বের করে নিয়ে আগামীকাল সকালে গুলিও করতেন, আমি তাঁকে একটা ধাপ্পা হিসেবে বিবেচনা করতাম। গুলি করাটাও হতো একটা ধাপ্পা।’
পরবর্তী সময়ে নিউ রিপাবলিক কাগজেও ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকারকে নিয়ে বিদ্রূপাত্মক লেখা লিখেছিলেন হেমিংওয়ে। দুবছর পর উপন্যাস আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস প্রকাশিত হওয়ার পর ইতালি সরকার সে দেশে বইটির প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। বইটি গোপনে অনুবাদ করার অপরাধে লেখিকা ফের্নান্দো পিভানোকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। অথচ সে সময় অন্য আমেরিকান লেখকদের বইয়ের ইতালীয় সংস্করণ দিব্যি চলছিল দেশটিতে।
নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনে মুসোলিনির প্রতি হেমিংওয়ের ব্যঙ্গবিদ্রূপই একমাত্র কারণ ছিল না, উপন্যাসটিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালির পরাজয়, অপমানজনক পশ্চাদপসরণ, সৈনিকদের কাপুরুষতা ও বিশৃঙ্খলা চিত্রিত করাই ছিল মূল কারণ। তাঁর যুদ্ধবিরোধী মনোভাব, স্পেনের গৃহযুদ্ধে রিপাবলিকানদের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন এবং ফ্যাসিস্টবিরোধী প্রচারণাও এই পদক্ষেপের পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছিল। মুসোলিনি সরকারের পতন ঘটলে ১৪ বছর নিষিদ্ধ থাকার পর তাঁর বই ইতালিতে প্রকাশাধিকার পায়। ফলে এক বছরের মধ্যে স্বল্পপরিচিত এক প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয় দ্য সান অলসো রাইজেস-এর ইতালীয় সংস্করণ। পরবর্তী সময়ে বামঘেঁষা প্রকাশক এইনাউদি প্রকাশ করে দ্য সান অলসো রাইজেস, ফার্স্ট ফর্টি নাইন স্টোরিজ, গ্রিন হিলস অব আফ্রিকা, ডেথ ইন দ্য আফটারনুন ও টু হ্যাভ অ্যান্ড হ্যাভ নট। তবে আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস ও ফর হুম দ্য বেল টোলস এই প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়নি।স
এতগুলো বই বের করলেও রয়্যালটি নিয়ে এইনাউদির সঙ্গে হেমিংওয়ের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে পড়েছিল। তাঁর অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটির মালিক কমিউনিস্ট হলেও রয়্যালটি থেকে লেখকদের বঞ্চিত করতে দ্বিধা করেন না। তাই এইনাউদিকে আর কোনো বই না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।
এদিকে ফেয়ারওয়েল ও বেল টোলস প্রকাশের ইচ্ছা প্রকাশ করে হেমিংওয়ের সবগুলো বইয়ের একক প্রকাশনা ও বিপণনের দাবি নিয়ে আসেন ইতালির বনেদি প্রকাশক আর্নল্ডো মনদাদোরি। ফাশিস্তি পার্টির একসময়ের সদস্য মনদাদোরিকে নিজের বইয়ের প্রকাশক হিসেবে মেনে নিতে চাননি হেমিংওয়ে। কিন্তু যুদ্ধের সময় সুইজারল্যান্ডে করা চুক্তির কারণে এবং এইনাউদির আর্থিক লেনদেনের অস্বচ্ছতা দেখে রাজি হতে হয়েছিল তাঁকে।
তিন বছর পর চতুর্থ স্ত্রী মেরিকে নিয়ে হেমিংওয়ে যখন ইতালির পর্যটন শহর স্ত্রেসায় যান, মনদাদোরি তাঁর সম্মানে এক জমকালো পার্টি দিয়েছিলেন নিজের ভিলায়। থমাস মান, সিনক্লেয়ার লুইসের মতো লেখকেরাও একসময় আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন এখানে। এখানেই মনদাদোরি হেমিংওয়েকে জানান, ফেয়ারওয়েল ও বেল টোলস-এর রয়্যালটি বাবদ তাঁর পাওনা হয়েছে ১০ লক্ষাধিক লিরা, অর্থাৎ প্রায় ১ হাজার ৬০০ ডলার। সেই পাওনা থেকে সেদিনই নগদ ৪ লাখ লিরা অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৬০০ ডলার দিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে।
স্ত্রেসায় থাকাকালীন প্রকাশক এইনাউদিও হেমিংওয়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসে তাঁর নতুন বই বের করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। হেমিংওয়ে উল্টো জানতে চান যে বকেয়া রয়্যালটির টাকাগুলো কখন পাচ্ছেন তিনি। এইনাউদি এ সময় দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আইনের অজুহাতে টালবাহানা করলে হেমিংওয়ে জানান যে মাত্র সেদিনই মনদাদোরি তাঁকে ৪ লাখ লিরা নগদ দিয়েছেন। অগত্যা এইনাউদি তাঁকে ৫ লাখ লিরার একটা চেক লিখে দিয়েছিলেন।
বাকি জীবন মনদাদোরির প্রকাশনার সঙ্গেই ছিলেন হেমিংওয়ে। কিন্তু এদিকে যে ৫টা বই এইনাউদি বের করেছিল, সেগুলোর জন্য ৪ লাখ লিরার পর ৬ বছরে আর এক পয়সাও দেওয়া হয়নি, তাই বকেয়া রয়্যালটির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৩ লাখ ৯৪ হাজার লিরাতে, অর্থাৎ প্রায় ১৫ হাজার ডলার। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা যা, তাতে ইচ্ছা করলেও এই পরিমাণ টাকা দেওয়ার সংগতি ছিল না তাদের। তাই আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কোম্পানিতে ৮ কোটি লিরা মূলধন ঢালার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পরিচালনা পর্ষদ। এই মূলধন সংগ্রহের অংশ হিসেবে এইনাউদি প্রস্তাব করেন, হেমিংওয়ে চাইলে তাঁর পাওনা রয়্যালটির একটা অংশের পরিবর্তে কোম্পানির শেয়ার গ্রহণ করতে পারেন। শেয়ারে হেমিংওয়ের বিনিয়োগ থাকলেও তাঁর কাছে প্রস্তাবটি ছিল অভূতপূর্ব। তাঁর মৃত্যুর পর দেখা যায় ৩৬টা কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ ছিল তাঁর, এগুলোর বেশির ভাগই নামীদামি কোম্পানি—যেমন ইস্টম্যান কোডাক, জেনারেল মটরস, আমেরিকান টেলিফোন কোম্পানি ইত্যাদি। এসব কোম্পানি থেকে জীবনের শেষ ৫ বছর যত লভ্যাংশ তিনি পেয়েছেন, বইয়ের রয়্যালটি থেকে ততটা পাননি। শেয়ারে বিনিয়োগের ব্যাপারে তাঁর যে বিচক্ষণতা দেখা যায়, সে হিসেবে এইনাউদির মতো দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত ছিল অপ্রত্যাশিত। কিন্তু অবাক ব্যাপার, তিনি তাঁর পাওনা ৯৩ লাখ লিরা থেকে ৫০ লাখ লিরা কোম্পানির শেয়ারে রূপান্তরের প্রস্তাব দেন। কিন্তু এত শেয়ার অবশিষ্ট ছিল না বলে কোম্পানির বোর্ড ৩২ লাখ লিরার শেয়ার তাঁর নামে বরাদ্দ করেছিল। শেয়ার সার্টিফিকেটগুলো তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত গচ্ছিত ছিল ব্যাংকের লকারে।
মোট বকেয়া রয়্যালটি থেকে ৩২ লাখ লিরা শেয়ারে রূপান্তর করার পরও আরও প্রায় যে ৬২ লাখ লিরা অনাদায়ি ছিল, সেটা মাসিক ৩ লাখ লিরার কিস্তিতে আদায় করার একটা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করার জন্য একজন অ্যাকাউনট্যান্টও নিয়োগ করেছিলেন তিনি। আর্থিকভাবে দুর্বল একটা বড় প্রকাশনা কোম্পানির শেয়ার ছাড়া বিনিয়োগের বিপরীতে কোনো লভ্যাংশ তিনি পাননি। অবশেষে একসময় প্রকাশনা জগতে সুনামের কারণে আর্থিক দুর্বলতা সত্ত্বেও কোম্পানিটি বিক্রি হয়ে যায়, আর কিনে নেয় এইনাউদির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান মনদাদোরি। এর মধ্যে হেমিংওয়ের বকেয়া রয়্যালটির অর্থ আদায় করা সম্ভব হয়েছিল কি না, তার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। নিজের অংশীদারত্ব থাকা কোম্পানিটির এই পরিণতি দেখে যাননি হেমিংওয়ে, তার ৩৩ বছর আগেই স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি।