>মানুষকে সহজেই স্পর্শ করত তাঁর কথার জাদু। জননন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সত্তরতম জন্মদিন ১৩ নভেম্বর। তাঁকে নিয়ে আয়োজন
এই দুই গদ্য প্রিয় এক কবির শেষ মুহূর্তের ছবি আঁকতে গিয়ে হুমায়ূনের আর্ত উচ্চারণ যেমন পাঠককে দারুণভাবে স্পর্শ করে, তেমনি প্রিয় পত্রিকার সঙ্গে লেখকের যাপনমুহূর্তের টুকরো ছবিও ভেসে আসে তাঁর সকৃতজ্ঞ-বয়ানে। যথারীতি এসব গদ্যেও তাঁর গল্পবিস্তারের ভঙ্গিটি অপ্রকাশ্য নয়। হুমায়ূন আহমেদের ননফিকশন গদ্যলেখার সূত্রমুখ হিসেবে এ তিনটি রচনাকে পাঠ করা যেতে। এই লেখাগুচ্ছে পাঠক হুমায়ূনের জীবনের কয়েকটি পর্বের উৎসমুখও খুঁজে পাবেন। লেখাগুলো এখন পর্যন্ত অগ্রন্থিত। সত্তরতম জন্মবার্ষিকীতে প্রিয় এই সাহিত্যস্রষ্টার প্রতি আমাদের বিনীত শ্রদ্ধা।
এখানে সমকালীন বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।
১. কবি আহসান হাবীব: শেষ দেখা
অসুস্থ কবিকে দেখতে গেলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তারিখ ৯ জুলাই তাঁর মৃত্যুর আগের দিন। আমি, নির্মলেন্দু গুণ এবং সালেহ চৌধুরী। ঢুকবার মুখেই বাধা। একজন রোগী মারা গেছে। তার মেয়ে কিংবা তার স্ত্রী আকাশ ফাটিয়ে কাঁদছে। মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
ওয়ার্ডে ঢুকে দেখি সারি সারি রোগীর মাঝখানে হাবীব ভাই। গেঞ্জি গায়ে বিছানায় পড়ে আছেন। শিশুর মতো লাগছে তাঁকে। মাথার কাছে তাঁর ছেলে মঈনুল আহসান (কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের) মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। সমস্ত পরিবেশটিই মনের ওপর চাপ তৈরি করে। দেশের একজন সেরা কবির জন্য এমন দীন ব্যবস্থা কেন? মঈনুল আহসান বলল, ‘এটাই ভালো ব্যবস্থা। চোখের সামনে একজন ডাক্তার সব সময় থাকেন।’ হবে হয়তো। আমি অবশ্য আশা করেছিলাম অসুস্থ কবির শয্যাটি হবে অন্য রকম। একটু আলাদা।
হাবীব ভাইয়ের মাথার কাছে একটা চার্ট ঝুলছে। সেখানে ইংরেজিতে লেখা—পোয়েট আহসান হাবীব। তাঁর জন্য মিকশ্চারের একটি বোতল এল; সেখানেও লেখা পোয়েট অহসান হাবীব। দেখতে ভালোই লাগল। হাসপাতাল মনে রেখেছে এই রোগী একজন কবি।
মঈনুল আহসান বলল, ‘আব্বার তেমন কোনো অসুবিধা নেই। তাঁর জন্য আগামীকাল মেডিকেল বোর্ড বসবে।’ বুঝতে পারছি সে নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিচ্ছে। সে কি বুঝতে পারছে সময় ফুরিয়ে আসছে?
সালেহ চৌধুরী এবং নির্মলেন্দু গুণ কবির পায়ে পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ছোটখাটো কথাবার্তা হতে থাকল।
তিনি জানালেন, তাঁর শরীর ভালোই আছে। কিন্তু কিছু খেতে পারছেন না। কিছুই হজম হয় না। এ ছাড়া আর অন্য কোনো অসুবিধা নেই। তিনি গেঞ্জি টেনে পেট অনেকখানি উদাম করে ফেললেন। নির্মলেন্দু গুণ পেটে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। একসময় বললেন, ‘হাবীব ভাই, টিভিতে আপনার ইন্টারভিউটা দেখলাম, খুব ভালো হয়েছে।’ হাবীব ভাই হাসলেন। আমার মনে হলো, হাবীব ভাই তো ভালোই আছেন। কথাবার্তা অবশ্য বলছেন নিচু স্বরে। এবং বেশ কয়েকবার লক্ষ করলাম, ফিসফিস করে নিজের মনে কী যেন বলছেন। কিন্তু আমাদের সঙ্গে যখন কথা বলছেন, তখন (কণ্ঠ কিছুটা জড়ানো হলেও) চিন্তার কোনো অসংলগ্নতা নেই। একপর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার বইয়ের সংখ্যা কত?’ একজন গুরুতর অসুস্থ মানুষ, যাঁর সেই মুহূর্তে নিজেকে নিয়েই চিন্তা করার কথা, তিনি অন্যের প্রসঙ্গে কীভাবে এতটা আগ্রহ রাখেন কে জানে?
একটি ছেলে তাঁর জন্য লাল মিকশ্চারের একটি বোতল নিয়ে এল। হাবীব ভাইকে পেছনে বালিশ দিয়ে বসানো হলো। তিনি বললেন, তাঁর ক্ষিধে পেয়েছে। সয়াপ্রোটিন বিস্কুট সম্পর্কে দু–একটা কথা বললেন। লক্ষ করলাম, আমরা কি কথাবার্তা বলছি সেগুলি তিনি খুব মন দিয়ে শুনতে চেষ্টা করছেন। মাঝে মাঝে ধরতে পারছেন না। তখন জিজ্ঞেস করছেন, ‘সালেহ কী বলল? নির্মলেন্দু কী বলল?’
হাবীব ভাইয়ের সহকারী তরুণ কবি নাসির আহমেদকে দেখলাম সারাক্ষণই কবির সেবা করবার সুযোগ খুঁজছেন। কখনো পায়ে হাত বোলাচ্ছেন, কখনো গায়ে হাত বোলাচ্ছেন। কী গভীর ভালোবাসা তাঁর চোখেমুখে। তা তো হবেই, হাত ধরে এঁদের কবিতার অলিগলি চিনিয়েছেন, এসেছেন ঋণ শোধ করতে।
একটি মেয়ে এল কবিকে দেখতে। হাবীব ভাই ক্ষীণকণ্ঠে তার খোঁজখবর করলেন। মেয়েটিকে মনে হলো সে কেঁদে ফেলবে। গল্পকার ভাস্কর চৌধুরী এলেন। তাঁর গায়ে ইউএসএ ছাপ মারা ঝলমলে টি-শার্ট, কিন্তু মুখটি বিষণ্ন।
আমরা সবাই তাঁকে ঘিরে বসে রইলাম। ছোটখাটো কথা বলতে লাগলাম নিজেদের মধ্যে। হাবীব ভাই বসে আছেন বালিশে হেলান দিয়ে। তাঁর মাথা ভর্তি শরতের মেঘের মতো ধবধবে সাদা চুল। হাবীব ভাইকে লাগছে প্রাচীনকালের ঋষিদের মতো। একটু দূরে বসে থাকা নার্স বারবার কৌতূহলী হয়ে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে।
আমরা প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো থাকলাম তাঁর সঙ্গে। আমার খুব ইচ্ছা করছিল তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করি। কিন্তু তিনি যদি কিছু মনে করেন আমি তাঁকে শেষ বিদায় জানাচ্ছি, সেই ভয়েই ওদিকে গেলাম না। বললাম, ‘হাবীব ভাই, হাসপাতালের পরিবেশটা আমার ভালো লাগছে না। আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন বাড়ি চলে যান।’
হাবীব ভাই মৃদুস্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ, ফিরে যাব। আমার বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে।’
কবির বাড়ি ফেরা হয়নি। কিংবা কে জানে হয়তো ফিরেছেন। আঁধার বাড়ির কোনো রহস্যই তো আমাদের জানা নেই।
২. আমি এবং দৈনিক বাংলা
উনিশ শ সাতষট্টি সনের কথা। সবেমাত্র ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। থাকি মুহসীন হলে। বিশাল হল। শুধু হল নয়, ইউনিভার্সিটির সবকিছুই বিশাল। সবকিছুই অচেনা। বন্ধুবান্ধবও তৈরি হয়নি, মোটামুটিভাবে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছি বলা যেতে পারে। এর মধ্যেই এক কাণ্ড—রাতের বেলা ঘুমাবার আয়োজন করছি, হঠাৎ শুনি তুমুল হইচই। এনএসএসএফের ছাত্ররা নাকি কাকে ধরে পেটাচ্ছে। আমার চোখের সামনেই ঝাঁকড়া চুলের কয়েকজন ছাত্র হকিস্টিক হাতে ছুটে গেল। ছয়তলা থেকে বিছানা–বালিশ নিচে ছুড়ে ফেলা হতে লাগল—ভয়ানক অবস্থা।
অত্যন্ত লজ্জা ও বিনয়ের সঙ্গে স্বীকার করছি, এ রকম একটা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমার মধ্যে ‘কাব্যভাব’ উপস্থিত হলো। দরজা বন্ধ করে আমি পরপর দুটি কবিতা (?) লিখে ফেললাম। পৃথিবীর যাবতীয় ব্যর্থ কবিদের মতো আমারও ধারণা হলো, শ্রেষ্ঠ কবিতা দুটি এই মাত্র লেখা হয়েছে। পাঠক–পাঠিকাদের কাছে অতি দ্রুত এদের পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে আমার পরবর্তী পবিত্র দায়িত্ব।
সেই রাতের গন্ডগোল ও হইচই সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আমি গভীর রাত পর্যন্ত কবিতা দুটির অসংখ্য কপি তৈরি করে পরদিন ভোরেই সব পত্রপত্রিকায় পাঠিয়ে দিলাম। তবে কবির নামের জায়গার নিজের নাম দেওয়ার সাহস হলো না। ছোট বোনের নাম লিখলাম—মমতাজ আহমেদ শিখু।
শুরু হলো প্রতীক্ষার পালা। বলাই বাহুল্য মহিলা কবি মমতাজ আহমেদ শিখুর কাব্যপ্রতিভা সম্পর্কে সম্পাদকেরা আমার সঙ্গে একমত হলেন না। কবিতা দুটি কোথাও ছাপা হলো না। একসময় বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হয়ে গেল। ছুটি কাটাতে বাবা–মার কাছে গিয়েছি। তখন এক কাণ্ড। একদিন দৈনিক বাংলা (তখন দৈনিক পাকিস্তান) খুলে দেখি দুটি কবিতাই মহিলা পাতায় ছাপা হয়েছে। (‘ফানুস’: দিতে পারো এক শ ফানুস এনে। আজন্ম সলজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই...। ‘সময়’: সময়, ঘোড়া এক শিকারী বুড়ো...)।সাহিত্যজগতে আমি আত্মপ্রকাশ করলাম মহিলা কবি হিসেবে। আহ্ কী আনন্দের দিনই না ছিল সেটি! দৈনিক বাংলাকেমনে হয়েছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পত্রিকা।
সুখের বিষয়, আমার কাব্যভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পড়াশোনার চাপে কবিতা মাথায় উঠল। তা ছাড়া নিজেকে মহিলা কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার তেমন ইচ্ছাও আমার ছিল না।
এর প্রায় বছর তিনেক পরের কথা। হঠাৎ একদিন রসায়ন বিভাগের সভাপতি ড. মুকাররাম হোসেন খন্দকার মারা গেলেন। তাঁর সঙ্গে আমার তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। তবু তাঁর মৃত্যু আমাকে নাড়া দিল। কারণ, মৃত্যুর আগের দিন তিনি ল্যাবরেটরিতে এসেছিলেন এবং অত্যন্ত আন্তরিক ভঙ্গিতে আমাকে বলেছিলেন, তোমরা আমাকে এত ভয় পাও কেন? চশমা ছাড়া আমার মধ্যে ভয় পাওয়ার আর কী আছে বলো? স্যারকে নিয়ে ছোট্ট একটা প্রবন্ধ লিখে ফেললাম। নাম ‘পড়বে না তাঁর পায়ের চিহ্ন’।
লেখাটা পকেটে নিয়ে ভয়ে ভয়ে গেলাম দৈনিক বাংলায়। কার কাছে লেখা দিতে হয় কিছুই জানি না। হয়তো চোখের সামনেই তাঁরা লেখাটা ফেলে দেবেন। কিংবা গম্ভীর মুখে বলবেন, কিছুই হয়নি।
দোতলার একটি ঘরে কয়েকজন বসেছিলেন। তাঁদের কাউকেই আমি চিনি না। সবাই অস্বাভাবিক গম্ভীর। আমি ক্ষীণস্বরে বললাম, আমাদের একজন স্যার মারা গেছেন। তাঁর ওপর আমি একটা লেখা এনেছি।
‘কবে মারা গেছেন?’
‘আজই মারা গেছেন।’
‘আর সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেলেছ?’
‘জি। ছোট লেখা।’
‘ঠিক আছে। রেখে যাও।’
আমি টেবিলে লেখাটি রেখে প্রায় ছুটে পালিয়ে এলাম। অবাক কাণ্ড—তারপর দিনের দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হলো, ‘পড়বে না তাঁর পায়ের চিহ্ন’। নিজের নামে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত আমার প্রথম রচনা। দৈনিক বাংলা আমাকে অভিভূত করে ফেলল।
উনিশ শ বাহাত্তর সনের কথা। জীবনের ওপর দিয়ে বড় রকমের ঝড় বয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে বাবা শহিদ হয়েছেন। মায়ের হাত শূন্য। আমরা তিন ভাইবোন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। টাকাপয়সার অভাবে আমাদের পড়াশোনা বন্ধ হবার মতো সমস্যাও দেখা দিয়েছে। ভয়াবহ অনিশ্চয়তা।
এর মধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে আমার প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে। একটি বইও বিক্রি হচ্ছে না। বইটির প্রকাশক একদিন মহাবিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আহমদ ছফা সাহেব হেনতেন কত কিছু বলে বইটি গছিয়ে গেছেন। এখন মহামুসিবত। তিন মাসে দশ-বারোটা বিক্রি হয়েছে কি না সন্দেহ।’
আমি অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
‘মানুষজন ধরাধরি করে আলোচনার ব্যবস্থা করেন। তাতে যদি কিছু বিক্রি হয়।’
‘কাকে ধরব?’
‘কবি-সাহিত্যিকদের ধরবেন। পত্রিকার লোকদের ধরবেন।’
‘কবি-সাহিত্যিক কাউকে আমি চিনি না। তাঁরাও কেউ আমাকে চেনেন না। আমার কোনো গল্প কোথাও প্রকাশিত হয়নি।’ একমাত্র প্রকাশিত রচনা ‘পড়বে না তাঁর পায়ের চিহ্ন’। কে আমাকে নিয়ে আলোচনা করবে? কার এত গরজ পড়েছে।
আমি নিজেও খুব লাজুক স্বভাবের। নিজের লেখা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করার মতো সাহস আমার কোথায়?খুব মন খারাপ করে গুটিয়ে নিলাম নিজেকে। লেখালেখি আমাকে দিয়ে হবে না। বাংলাদেশের মানুষ একজন অপরিচিত লেখকের রচনায় আগ্রহী নন।
আমার এ রকম দুঃসময়ে এগিয়ে এল দৈনিক বাংলা। সে সময়কার দৈনিক বাংলায় অনেক রথী-মহাথীর সমবেশ। তাঁরা একের পর এক আমার চটি উপন্যাসটি প্রসঙ্গে লিখলেন। কবি হাসান হাফিজুর রহমান, কবি শামসুর রাহমান, আহমেদ হুমায়ূন, সালেহ চৌধুরী। তাঁরা আমাকে রাতারাতি বিখ্যাত করে ফেললেন। একজন অখ্যাত–অজ্ঞাত, লাজুক লেখকের লেখা এঁদের ভালোবাসায় ভরসা ফিরে পেল। বুঝতে পারল, সে একা নয়।
দৈনিক বাংলার জন্মদিনেপুরোনো সব কথা মনে পড়ছে। এই পত্রিকাটি আমার পেছনে এসে না দাঁড়ালে আমি কি পারতাম লেখালেখি চালিয়ে যেতে?
হয়তো পারতাম, হয়তো পারতাম না। কিন্তু আমার দুঃসময়ে এই পত্রিকাটি ভালোবাসার বিশাল বাহু প্রসারিত করেছিল আমার দিকে। সেই ঋণ কখনো শেষ হবার নয়। এই পত্রিকার জন্মদিনে কিছু লিখতে পেরে বড় ভালো লাগছে।
দৈনিক বাংলা তুমি সুখে থাকো। ভালো থাকো।