আজ সকালে প্রয়াত হয়েছেন ‘কালি ও কলম’ সম্পাদক আবুল হাসনাত। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশিত হলো এই লেখা।
হাসনাত ভাই, আবুল হাসনাত, অসুস্থ ছিলেন, ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে, জানতাম। কিন্তু এটা তাঁর শেষযাত্রার আয়োজন হবে, স্বপ্নেও ভাবিনি। শিল্পীবন্ধু মোবাশ্বির আলম মজুমদার (রোববার) সকালে ঘুম ভাঙিয়ে চরম কথাটা জানাল বটে, আবার নিশ্চিত করতে বলল অন্য সূত্র থেকে। সেটা নিশ্চিত করল বন্ধু আলতাফ শাহনেওয়াজ। হাসনাত ভাইয়ের ধানমন্ডির বাসায় গেলাম, সেখান থেকে তাঁর কর্মক্ষেত্র বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে। এই করোনা মারিতেও ভরে উঠেছে বেঙ্গলের উঠান। কিন্তু আমি ভাবছিলাম দিঠির কথা। হাসনাত ভাইয়ের কন্যা দিঠি। তিনি নিউইয়র্কে আছেন। হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক দিনের হলেও ঘনিষ্ঠতা সেখানেই।
না, দিঠি আসতে পারবেন না বাবার শেষযাত্রায়। অ্যাম্বুলেন্সের কপাট খুলে দেওয়ার পর দেখলাম তাঁকে। এ অবস্থায় আমি কাউকে দেখতে চাই না। কারণ, ঠিক চেনা যায় না। তবু কাউকে কাউকে দেখতে হয়। একটি মেয়ে ভিডিও কলে দিঠিকে যুক্ত করলেন। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে দেখালেন তাঁর বাবাকে, শেষবার। এই দৃশ্য সহ্য করা সম্ভব হলো না। বেরিয়ে এলাম।
হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে কথা হতো দুই লাইন। ফোনেও কথা হতো মাঝেমধ্যে, তা–ও ওই দুই লাইনই। অনেক সময় এমনও হয়েছে, ফোনে কথা বলছি। বেশ কিছুক্ষণ পরে বুঝেছি, ও প্রান্তে হাসনাত ভাই অনেক আগেই লাইন কেটে দিয়েছেন। প্রসঙ্গের বাইরে কথা বলা তাঁর ধাতে ছিল না। তাঁর বাসায় গেছি দু–একবার নানা কাজে। একবার গিয়েছিলাম ‘প্রথম আলো’র জন্য ভূমেন্দ্র গুহর সাক্ষাৎকার নিতে। সঙ্গে ছিলেন আনিস ভাই, ‘প্রথম আলো’র সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক। আমরা ঢুকছি, বেরিয়ে গেলেন হাসনাত ভাই। কথা হলো ওই দুই লাইন। সেই হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে দুই লাইন ছাড়িয়ে গেলাম যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত ২৭ ও ২৮তম বাংলা বইমেলায়।
হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে কথা হতো দুই লাইন। ফোনেও কথা হতো মাঝেমধ্যে, তা–ও ওই দুই লাইনই। অনেক সময় এমনও হয়েছে, ফোনে কথা বলছি। বেশ কিছুক্ষণ পরে বুঝেছি ও প্রান্তে হাসনাত ভাই অনেক আগেই লাইন কেটে দিয়েছেন। প্রসঙ্গের বাইরে কথা বলা তাঁর ধাতে ছিল না। তাঁর বাসায় গিয়েছি দু–একবার নানা কাজে।
জ্যাকসন হাইটসের একটি স্কুলে আয়োজিত হয়েছিল বইমেলা। স্টল যখন সাজানো হচ্ছে, হাসনাত ভাই বললেন, আমাদের বেঙ্গল পাবলিকেশন্সের স্টলটা প্রথমার পাশে দাও। আমিও আনন্দের সঙ্গেই হাসনাত ভাইয়ের পাশে থাকলাম। আমরা যে যত বড় কুতুবই হই না কেন, ওখানে দাঁড়িয়ে বই বিক্রি করা ছাড়া গতি নেই। ১০০ টাকার বই ৫ ডলার। সহজে কেউ দিতে চায়? বই ফেরত আনার চেয়ে চার ডলার, এমনকি তিন ডলারে হলেও দিয়ে দিতে হবে। বিক্রির সময় বাংলাদেশের টাকার সঙ্গে ডলারের হিসাবটা তো করা লাগে। ৪৫০ টাকার একটা বই ৫ ডলার হিসাবে দিলে এক দাম, ৪ বা ৩ ডলারের হিসাবে দিলে আরেক দাম। হাসনাত ভাই বলেন, রাশেদ, দেখেন তো কত টাকা আসে?
আমি বলি, ১০০ টাকায় ৫ ডলার হিসাবে, নাকি ৪ বা ৩ ডলার।
হাসনাত ভাই বলতেন, আপনার যেটা সুবিধা মনে হয় দিয়ে দেন। বই তো আর নিয়ে যেতে চাই না।
তো আমি প্রথমার বই বেচি, বেঙ্গলের বইও বেচি। ২০১৮ আর ২০১৯ সাল—দুবারই। মাঝেমধ্যে দিঠি আসেন। সঙ্গে তাঁর অসম্ভব লক্ষ্মী একটা মেয়ে। দিঠির ফুফু আসেন মাঝেমধ্যে। আমরা সবাই খুব আড্ডায় জমে যাই। তখন হাসনাত ভাইকে আর ঢাকার হাসনাত ভাই বলে চেনা যায় না। তিনি গল্প করেন, অনেক কথা বলেন, হা হা করে হাসেন। কেউ একটা বই নিতে চাইলে বইটা আমাকে দিয়ে বলেন, দেখুন তো রাশেদ, এটা কত ডলার হয়? আমি মুঠোফোনে ক্যালকুলেটর বের করে দাম বলি। তিনি আরও কমিয়ে দেন। লোকে ডলারে বই কিনছে, এতেই তিনি ঝলোমলো।
মেলা রাত ১০টা পর্যন্ত। কিন্তু ঠেলে এটাকে আমরা ১১টায় নিয়ে যাই। হাসনাত ভাই, দিঠি বা তাঁর ফুফু থাকলে ওঁরা আটটায় চলে যান। যাওয়ার সময় হাসনাত ভাই বলেন, আপনার যেভাবে ইচ্ছা বিক্রি করেন। আমরা গেলাম। আমি ছেড়ে দিই ওঁদের। তারপর প্রথমা আর বেঙ্গল দুটোরই সওদাগর হয়ে বসি। পরদিন সকালে এসে আগের রাতের বিক্রি বুঝিয়ে দিই, ১১৭ ডলার, ৬৪ ডলার। এসব মনে আছে।
না, দিঠি আসতে পারবেন না বাবার শেষযাত্রায়। অ্যাম্বুলেন্সের কপাট খুলে দেওয়ার পর দেখলাম তাঁকে। এ অবস্থায় আমি কাউকে দেখতে চাই না। কারণ, ঠিক চেনা যায় না। তবু কাউকে কাউকে দেখতে হয়। একটি মেয়ে ভিডিও কলে দিঠিকে যুক্ত করলেন। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে দেখালেন তাঁর বাবাকে, শেষবার। এই দৃশ্য সহ্য করা সম্ভব হলো না। বেরিয়ে এলাম।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাসনাত ভাইয়ের পাশে। মঞ্চে পাঁচজন লেখকের আলোচনায় দেখি আমি ও হাসনাত ভাই একই অধিবেশনে। ঢাকায় ‘ভোরের কাগজ’–এ বা ‘প্রথম আলো’য় সাহিত্য সম্পাদক থাকাকালে তাঁর কবিতা নিয়েছি, ছেপেছি। ‘কালি ও কলম’–এর জন্য তিনি কবিতা চেয়েছেন। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর অকস্মাৎ মৃত্যুর পর ফোন করে বিশেষ সংখ্যার জন্য লিখতে বললেন। লিখেছিও। কখনো আলোচনা করানোর জন্য প্রথমা প্রকাশনের বই চেয়েছেন। কখনো দরকারি কোনো বইয়ের খোঁজ নিয়েছেন। কিন্তু কথা ওইটুকু। দুই লাইন।
নিউইয়র্কে আমি প্রগলভ হাসনাত ভাইকে আবিষ্কার করেছি।
দ্বিতীয়বার, অর্থাৎ ২০১৯ সালের বইমেলায় যাওয়ার এক মাস আগে বললেন, রাশেদ, এবার আমরা একই ফ্লাইটে যাব। আমি মতিকে বলব। মানে আমাদের মতি ভাই, ‘প্রথম আলো’ সম্পাদক মতিউর রহমান। ওঁরা ছোটবেলার বন্ধু। পরস্পরকে তুই বলতেন। ‘প্রথম আলো’ অফিসে গেলে দুজনে বসে অনেক গল্প করতেন। তাঁর সম্পর্কে মতি ভাই আমাদের অনেক গল্প বলতেন। বিশেষ করে ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনের কথা। একুশ উপলক্ষে স্মরণিকা প্রকাশের কথা। ‘গণসাহিত্য’ পত্রিকা প্রকাশের কথা। আজ ধানমন্ডিতে হাসনাত ভাইয়ের বাসায় মিনু আপার সঙ্গে দেখা করে নেমে মতি ভাইকে ফোন দিলাম। বললাম, আপনি একটি অনুষ্ঠান করে হাসনাত ভাইয়ের সামনে তাঁর সম্পর্কে বলবেন বলেছিলেন। আজ সে কথা বারবার মনে পড়ছে। মতি ভাইয়ের ব্যথিত কণ্ঠস্বর আমাকে আরও প্লাবিত করল। সেই বিষাদ নিয়ে এখন আমি কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছি। ভাবছি, কেন আমি আলতাফ শাহনেওয়াজের অনুরোধের ঢেঁকি গিললাম!
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com