হাইকার্স শেল্টারে নিশিযাপন

সরলরেখার মতো ট্রেইলে নিঃসঙ্গ হাইকার। ছবি: লেখক
সরলরেখার মতো ট্রেইলে নিঃসঙ্গ হাইকার। ছবি: লেখক


যুক্তরাষ্ট্রের শ্যানানডোয়া অঞ্চলের বনানীতে হাইক করছি। পিঠে ব্যাকপ্যাকের ভারী বোঝা। ঘণ্টা কয়েক ফোকাসডভাবে হাঁটতে হাঁটতে অতঃপর ব্লুরিজ পাহাড়ের ছত্রচ্ছায়ায় হাইকার্স শেল্টারটি খুঁজে পেয়ে ধড়ে জান ফিরে আসে। শেল্টারের কটেজটি ছোট্ট, তাতে মাত্র দুটি কামরা। একটিতে হাইকিং ট্রেইল মেনটেইন করার যন্ত্রপাতি ডাই করে রাখা। অন্য কামরায় ঝড়-তুফানে মেঝেতে স্লিপিংব্যাগ পেতে ব্যাকপ্যাকাররা ঘুমাতে পারে। সরলরেখার মতো একটি ট্রেইলে হাঁটতে গিয়ে আজ দেখা হয়, নিঃসঙ্গ এক হাইকারের সঙ্গে। সে আগামী দুই সপ্তাহের আবহাওয়ার চার্ট ক্যারি করছে। আজ রাতে যে ব্যাপক ঝড়জলের সম্ভাবনা আছে, এ বিষয়ে তার কাছ থেকে আমি জেনেছি। আমার তাঁবুটির শিক ভেঙে যাওয়ায় জঙ্গলে রাত কাটানো বাবদে খুব বেফানা হালতে আছি। হাইকার তরুণটি মানচিত্র ঘেঁটে আমাকে এ শেল্টারের ডিরেকশন বাতলে দিয়েছে।

শেল্টারের সামনে পাতা আছে পিকনিক টেবিল। বেঞ্চে ব্যাকপ্যাক রেখে বসতেই হালকা কুয়াশায় হিম হিম লাগে। কিন্তু উঠে গিয়ে আশপাশ থেকে কাঠ কুড়িয়ে ক্যাম্পফায়ারের আগুন জ্বালানোর উৎসাহ পাই না। হঠাৎ করে পত্রালিতে শিশির ঝলমলিয়ে আলো ছড়ায় এক পশলা রোদ। দেখি, পন্ডোরসা পাইনগাছের তলা থেকে লাজুক মুখে তাকিয়ে আছে একটি মাদি হরিণ। পাশের আরেকটি গাছে কাঠের তৈরি মুখোশে দাড়িওয়ালা এক মানুষের মুখাকৃতি। ঠিক বুঝতে পারি না মুখোশটি ওখানে ঝুলিয়েছে কে। এখানে বসে থেকে কিছু করারও নেই, তাই শেল্টারে ঢুকে ব্ল্যাংকেট বিছিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসি। একটি বিষয় ভেবে অবাক লাগে, লাগাতার আট দিন শ্যানানডোয়ায় হাইক করার কথা ছিল না। আমার ব্যাকপ্যাকে খাবারের সাপ্লাই ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু এই দুর্বিপাকের ভেতরও দেহমনে খেলছে আরও অধিক হাইকের এনার্জি। মনে হয়, আরও কিছু পাহাড়-বনানী ও প্রান্তর পাড়ি দেওয়ার রিদমে উদ্দীপিত হয়ে আছে যুগপৎ মন ও শরীর। এখন থেমে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। খাবারের অপর্যাপ্ত সাপ্লাই—আমি জানি যে, এ নিয়ে সমস্যা হবে চলার পথে। তবে আমি বার্টার বা বিনিময় করার জন্য বেশ কিছু জিনিস সঙ্গে নিয়ে চলছি। স্টক এখনো শেষ হয়ে আসেনি। পথে নিশ্চয়ই কারও না কারও সঙ্গে দেখা হবে, যে ইন্টারেস্টিং কোনো জিনিসের বিনিময়ে আমাকে দেবে প্রোটিন রিচ খাবার।

দিনকে দিন একনাগাড়ে হাইক করার দুর্গতি আমাকে আতঙ্কিত করে না। তবে একধরনের তৃষ্ণা, কী রকম যেন অপ্রাপ্তি আমার ভেতর ঘুরে মরে। তবে কি চলার পথে যাদের সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ ইন্টারেকশন হচ্ছে, আমার অবচেতন মন প্রত্যাশা করছে, তাদের কাছ থেকে আবেগঋদ্ধ কিছু এবং কিছু একটা না পাওয়ার শূন্যতায়, কিংবা কিছু একটা পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায়—তবে কি আমার দেহমন রেসপন্স করছে অস্থিরভাবে হাইক করে? এ বিষয় থেকে চিন্তাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার জন্য আমি সচেতনভাবে ব্যাকপ্যাক থেকে ওয়াকম্যান বের করি। ব্রাহমসের নতুন সিডিটি শোনা হয়নি। রোমান্টিক যুগের এই জার্মান মিউজিশিয়ানের সংগীত আমি খুব কম শুনেছি। সিডিতে ব্রাহমসের একটি ভায়োলিন কনসার্ট বেজে উঠলে মন ভরে ওঠে নিঃসঙ্গতায়। কিছুক্ষণ পর আমি চোখ বন্ধ করে সংগীতের ট্র্যাজিক অভারচার পিসটি শুনি। আমার ভেতরে যেন বিষাদের অঙ্গারে জ্বলে সুরের ধিকিধিকি অনল, মনে হয় এ নির্জনতা খুবই ঈপ্সিত। পাশের কোনো গাছ থেকে অদৃশ্য পতঙ্গ যেন রোগীর ত্বকে আকুপাংচারের সুই দিয়ে আঁকছে নির্জনতার শরীরে সুচালো ধ্বনিময় নকশা।

ব্রাহমসের মিউজিক কম্পোজিশন এবার হয়ে আসে নৃত্যছন্দময়। শেল্টারের দরজা খুলে যায়। খানিকটা কুয়াশা ঢুকে পড়ে কামরায়। তার পেছনে বাতাসের আর্দ্রতায় উড়ছে বেলা শেষের আলো। তাই আমি তার মুখের রেখা দেখতে পাই না। তবে নক্ষত্রমণ্ডলের চিত্রে যে রকম রেখা টেনে দেখানো হয় তিনটি তারার অবস্থান, সে রকম তার দুই কান ও নাকে গাঁথা রুপালি পাথরের স্টাড সৃষ্টি করে দ্যুতিময় ত্রিভুজ। ভারী ব্যাকপ্যাক ফ্লোরে রেখে সে আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘সো, ওয়ান হাইকার ইজ অলরেডি হিয়ার। মনে করেছিলাম, এ শেল্টার সম্পূর্ণ খালি পাব।’ আমি এক কান থেকে ইয়ারফোন খুলে জানতে চাই, ‘আমি থাকাতে তোমার কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে?’ সে জবাব দেয়, ‘ও হেল নো, ঝড় আসছে তো, তাই পথে আমি আরেকটি শেল্টারে থামি, দ্যাট ওয়াজ প্যাকড ফুল, ছোট্ট ঘরে আট-নয়জন হাইকারস আশ্রয় নিয়েছে।’ মেয়েটি এবার বেঞ্চে বসে দুই হাতে অগোছালো চুল মুঠো করে হাই ছেড়ে আবার বলে, ‘লর্ড, অল ডে আই হাইকড, সে লুম্বার-লস্ট ট্রেইল থেকে অল দ্য ওয়ে হেঁটে এসেছি। এদিকে কোথাও খাবার পানি আছে কি?’ আমি তাকে একটি ফ্রুট জুসের প্যাকেট দিই। সে পান করতে শুরু করলে কিছু তরল গড়িয়ে পড়ে তার ময়লা টপে। প্যাকেট মুখ থেকে সরিয়ে, ভেজা বুকের ওপর হাত রেখে এমনভাবে হাসে যেন সে তার হারিয়ে যাওয়া রিটার্ন টিকিটটি খুঁজে পেয়েছে। আমি একটি হাই এনার্জি বিস্কুট টেবিলে রাখলে সে র‍্যাপার ছিঁড়ে তা মুখে দিতে দিতে বলে, ‘আই অ্যাম জাস্ট স্টারভিং। সারা দিন কিছু মুখে পড়েনি। লিটিল বাইটস অব ফুড ফিলস সো গুড। কাল বিকেলের দিকে আমার ফুড-স্টকে টান পড়ে। কাজুবাদামের প্যাকেট ছিল ব্যাকপ্যাকে কয়েকটা, অনেক খুঁজলাম, কিছুতেই তা লকেট করতে পারলাম না।’

মেয়েটি তার ঠোঁটে লেগে থাকা বিস্কুটের গুঁড়া হাতের তালুতে মোছে যেন কী একটা মনে পড়েছে—এ রকম অভিব্যক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর আমার কাছে এসে এক কানে ইয়ারফোন না থাকার ফলে মিউজিকের ছড়িয়ে পড়া শব্দ শুনে বলে, ‘লর্ড, ইউ আর লিসেনিং ব্রাহমস্ হাঙ্গেরিয়ান ড্যান্স—এ কম্পোজিশনটি আমার এত প্রিয়!’ রেসপন্সে আমি সিডি বন্ধ করে ক্যাসেট বের করে বলি, ‘তোমার কাছে ওয়াকম্যান থাকলে তুমি এ ক্যাসেট শুনতে পারো।’ ‘অফকোর্স, আই হ্যাভ এ ওয়াকম্যান।’ বলে সে তার ব্যাকপ্যাকে খোঁজাখুঁজি করে। ওয়াকম্যান একটা পায় বটে, কিন্তু ব্যাটারি খুঁজে না পেয়ে তার নিজের চুল খামচে ধরে সে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘অনিটা, হোয়াই ইউ আর সো ডিস অর্গেনাইজড? হোয়াই ইউ লুজ এভরি লিটিল থিং? অনিটা...হোয়াই?’ বলে চুল ধরে টানতে থাকলে তার হাতে উঠে আসে ময়লা কিছু সোনালি চুল। আমি তাতে রিঅ্যাক্ট করে বলি, ‘কামঅন, ডান্ট বি হার্ড অন ইউ, আমিও তো অনেক কিছু খুঁজে পাচ্ছি না, অনিটা।’ বলে আমার ওয়াকম্যানে ব্রাহমসের সিডিটি ভরে তাকে তা ইউজ করতে বলি।

সে হাঙ্গেরিয়ান ড্যান্স শুনতে শুনতে নৃত্যের স্টেপে তার শরীর ঘুরিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘ওয়ানা ড্যান্স উইথ মি?’ ‘নো, নট রিয়েলি, ফিলিং টু টায়ার্ড।’ বলে আমি অসম্মতি জানালে সে চোখ মুদে একা একা নাচে।তারপর থেমে পড়ে ওয়াকম্যান আমার দিকে ফেরত দিতে দিতে বলে, ‘আই লাইক মাই সিডি ওয়াকম্যান বেটার।’ সে গোঁজ হয়ে অভিমানী মুখে বসে আছে দেখে আমি দুটি স্পেয়ার ব্যাটারি তাকে দিয়ে বলি, ‘অনিটা, কোনো কিছুর বিনিময়ে নেবে ব্যাটারি দুটো?’ উৎসাহের সঙ্গে ব্যাটারি হাতে নেয় সে। কিন্তু ফাস্ট্রেটেড হয়ে বলে, ‘আই ডোন্ট নো হোয়াট টু বার্টার, সবকিছু এমন অগোছালো হয়ে আছে, বিনিময়ের কোনো আইটেমও তো আমার কাছে আছে বলে মনে হয় না।’ ব্যাটারিগুলো তাকে এমনি এমনি দিয়ে দিতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু বার্টারের প্রিন্সিপল এটা নয়। তাই অপেক্ষা করি। মুহূর্তে তার অভিব্যক্তি বদলায়। দুই চোখে রহস্য ফুটিয়ে ঠোঁট বৃত্তাকার করে অন্তরঙ্গ হওয়ার ইশারা দিয়ে সে বলে, ‘হাউ অ্যাবাউট দিস?’ মাথা ঝাঁকিয়ে আমি অসম্মতি জানিয়ে তার পাশে বসে বলি, ‘ইট ইজ টু আর্লি, অনিটা।’ সে দুই চোখ তুলে নীরবে যেন আমাকে বোঝার চেষ্টা করে।

অতঃপর অভিব্যক্তিতে একধরনের বিভ্রান্তি ছড়িয়ে অনিটা ফের বলে, ‘শুট, আই ক্যান্ট থিংক ক্লিয়ারলি নাও।’ আমি প্রস্তাব করি, ‘হাউ অ্যাবাউট ইটিং টুগেদার?’ বলি, ‘লুক অনিটা, আমার কাছে ইন্সট্যান্ট জাপানি নুডলস আছে। তুমি কি আমার সঙ্গে ডিনারে জয়েন করবে?’ বলে আমি তার দিকে তাকালে সে ব্যাটারি দুটি ফিরিয়ে দিয়ে বলে, ‘লিসেন, আই নিড টাইম টু থিংক অ্যাবাউট দিস।’ আমি তার জবাবের অপেক্ষা করি। কিন্তু বার দুই শোল্ডার শ্রাগ করে ঘুরে বসলে, সে যে অপমানিত বোধ করছে, তা বুঝতে পারি। আমার করারও তো কিছু নেই। তাই সরে এসে পায়ে কম্বল জড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসি।

ক্ষুধার ভোঁতা অনুভূতি নিয়ে ঝিমিয়ে পড়েছিলাম। পুরিতে যেন বাঘ পড়েছে—এ ধরনের ঝাঁকুনিতে ঝিমুনি কেটে যায়। হুড়মুড় করে বুটের ভারী পদক্ষেপে শেল্টারে হাঁটছে বৃহৎ চেহারার এক হাইকার। সে লালচে-হলুদ চুল-দাড়িতে ঢাকা মুখে আমার ব্যাকপ্যাকের দিকে তাকিয়ে, কাঠের ভারী টেবিল টেনে সরিয়ে ওখানে তার ব্যাকপ্যাক রাখে। এক্সট্রা বেডরোল, তাঁবু, স্পিরিট স্টোভ ও লন্ঠন ইত্যাদি মিলিয়ে তার মালসামান বিস্তর। গোছগাছ করতে করতে আধো অন্ধকার সয়ে এলে, এক কোনায় গোঁজ হয়ে বসা অনিটাকে তার চোখে পড়ে। ব্যাকপ্যাকার এবার এক্সাইটেড হয়ে বলে, ‘অনিটা, হিয়ার ইউ আর। গট ইউ গার্ল! সেই যে ফক্স হলো ট্রেইল থেকে রিস্ক নিয়ে একা নাইট-হাইকে বেরোলে, তারপর থেকে তো একেবারে লাপাত্তা।’ এ ব্যাকপ্যাকারের কথাবার্তায় একধরনের বাজখাঁই ব্যাপার আছে। তার বুমিং ভয়েসে শেল্টার গমগম করে। কিন্তু অনিটার কাছ থেকে কোনো রেসপন্স আসে না। সে নির্বাক বসে থেকে সুই-সুতা দিয়ে তার ফেটে ছিঁড়ে যাওয়া ওয়াকিং-শু সেলাই করছে। নবাগত ব্যাকপ্যাকার এবার ছোঁ মেরে তার আধ-ছেঁড়া জুতাটি তুলে নিতে নিতে বলে, ‘আমি এখনই জুতা জুড়া মেরামত করে দিচ্ছি, সুইট গার্ল।’ তাতে অনিটা রিঅ্যাক্ট করে, ‘হেই, ইউ আর বিয়িং টু অ্যাগ্রেসিভ ম্যান। স্টে অ্যাউয়ে ফ্রম মি।’ একটু পজ নিয়ে আবার ‘আই লাইক ইউ টু নো দ্যাট, আই হেইট ইউ, টোটালি হেইট ইউ।’ বলে অনিটা শোল্ডার শ্রাগ করে অন্য দিকে মুখ ফেরালে, সদ্য আসা হাইকার তার হাত ধরে বলে, ‘ইউ আর দ্য মোস্ট ইন্টারেস্টিং হাইকার আই হ্যাভ এভার মেট ইন অ্যা হাইকিং ট্রেইল। দিস ইজ ট্রু। ওনেস্ট টু গড। কাম ক্লোজ অ্যান্ড গিভ মি এ হাগ।’ বলে ভালুক যে রকম মৌচাকে হামলে পড়ে, সেভাবে অনিটাকে জাপটে ধরে চুমো খায়।

কাঠ জোগাড় করে চুলা ধরিয়ে নুডলস তৈরি করতে ইচ্ছা হয় না। তাই কম্বল বিছিয়ে ব্যাকপ্যাকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ি। অনিটা এখন অন্য কোনো ট্রেইলে জানাশোনা হওয়া বিশালদেহী এ ব্যাকপ্যাকারের সঙ্গে কখনো ইংরেজি আবার কখনো ডাচ্ ভাষায় কথাবার্তা বলছে। ধুপধাপ করে টেবিল-বেঞ্চ রি-অ্যারেঞ্জ করে সদ্যাগত হাইকার এবার স্পিরিট স্টোভে চুলা ধরায়। হিমে অনিটা ঠিরঠির করে কাঁপছে, তাই তাকে উষ্ণ সুয়েটশার্ট পরিয়ে দিয়ে সে সসপ্যানে কিছু ভাজাভুজি করে। সারা শেল্টারে ছড়িয়ে পড়ে বেকন ফ্রাইয়ের গন্ধ। আমি শুয়ে শুয়েই হাই এনার্জি বিস্কুট খাই। একটু পানি খেতে পারলে ভালো লাগত। এক ঢোকে বেশ খানিকটা গিলে গমগমে হাসির সঙ্গে সদ্যাগত হাইকার অনিটার দিকে ফ্লাস্ক বাড়িয়ে দিলে রামের সৌরভও পাওয়া যায়।

লালচে-হলুদ চুলো এবার টেবিলটিকে আড়াল করে আমার মুখের ওপর বিছানার চাদর দড়ি দিয়ে টাঙিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘লুক অনিটা, আই অ্যাম মেকিং অ্যা কোজি প্রাইভেট স্পেস ফর আস।’ তারপর আমার দিকে ঘুরে বলে, ‘লন্ঠনটা আরও কিছুক্ষণ জ্বালা থাকবে। আই হোপ এতে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।’ রেসপন্সে আমি কোনো জবাব না দিয়ে ঘুরে শুই। চাদরের ওপাশে টেবিলে বেডরোল পেতে বসে ফিসফিসিয়ে তারা নেপালে হাইকিং করার কথা বলে। দুজনই অন্নপূর্ণা সার্কিটে হাইক করেছে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আলাদাভাবে নগরকোটেও তারা দিন কতক কাটিয়েছে। লেট মি শো ইউ সামথিং টেরিবলি ইন্টারেস্টিং ফ্রম নেপাল।’ বলে লালচে-হলুদ চুলো ব্যাকপ্যাক থেকে খুঁজে পেতে একটি বই বের করে দেখালে, ‘দিস ইজ কামাসূত্রা, দ্য ওরিয়েন্টাল সেক্স ম্যানুয়েল, আই নো অল অ্যাবাউট দিস।’ বলে অনিটা খিলখিলিয়ে হাসে। তাদের মধ্যে নানাবিধ আসনে শরীরকে কতটা ফ্লেক্সিবোল করতে হয়, এ বিষয়েও টুকটাক টেকনিক্যাল আলোচনা হয়। অতঃপর তাদের অন্তরঙ্গতার যুগলবন্দী গুহাগাত্রে শৃঙ্গারের রেখাচিত্রের মতো চাদরে ছায়া ফেলে। ‘নো টয় প্লিজ, জাস্ট বি টেন্ডার অ্যান্ড সুপার জেন্টল উইথ মি।’ বলে অনিটা এ পর্যায়ে লন্ঠন নিভিয়ে দেয়।

বাইরে ঝড়-বৃষ্টিতে কড়কড়াৎ করে বাজ পড়ে। দিগ্ভ্রান্ত বাতাস এসে আছড়ে পড়ছে শেল্টারে। এসব প্রাকৃতিক উথালপাতালের মাঝে চাল উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় আতঙ্কিত হতে হতে কখন যে ঘুমে ঢলে পড়েছি, ঠিক বুঝতেও পারিনি। কেমন যেন গোলযোগ, ডাচ্ ভাষায় গালাগালি ও চোটপাটের শব্দে ঘুম ভাঙে। মাত্র সকাল হচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টিও থেমে গেছে। অনিটা ফুঁফিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। লালচে-হলুদ চুলো হাইকার, ‘প্লিজ... ডোন্ট বি সিলি, সুইট গার্ল প্লিজ...।’ বলে তাকে শান্ত করতে চাইলে জালে আটকে পড়া হরিণীর মতো সে টেবিলে পা ছোড়ে। ‘ও, নো, প্লিজ স্টপ।’ বলে বিরাট দেহের হাইকার কঁকিয়ে উঠলে মনে হয়, অনিটা তাকে ধারালো নখে খামচাচ্ছে। ‘স্টপ ইট, আউচ...আউচ...ইট হার্টস। দেয়ার ইজ এনাদার পারসন ইন দ্য শেল্টার, ওহ নো, ই গড।’ বলে সে চিৎকার করে উঠলে, ‘আই ডোন্ট গিভ অ্যা ড্যাম।’ বলে অনিটা তার সংবেদনশীল কোনো প্রত্যঙ্গে বোধ করি রদ্দা মারে। কুককুৎ করে আওয়াজ তুলে লালচে-হলুদ চুলো টেবিল থেকে নেমে, হুড়মুড় করে আমার পা মাড়িয়ে দিয়ে কোঁকায়, ‘আউচ আউচ, ই গড। দিস ইজ ভেরি পেইনফুল, আ...উ। যিশাস,।’ অনিটা ঝুলন্ত চাদর হ্যাঁচকা টানে দড়ি থেকে ছিঁড়ে, তা তার নিরাবরণ কোমরে পেঁচিয়ে, হাতে একটি ক্যানিস্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ‘লিসেন, হাইস্কুলে পড়ার সময় দিস ইজ হোয়াট আই লার্নড ইন জুডো-কারাতে ক্লাস। পিওর সেল্ফ ডিফেন্স। এখনো কাজ করছে।’ লালচে-হলুদ চুলো হাইকার এখন কঁকাতে কঁকাতে মাথা নিচু করে জিনস পরছে। বুটে পা ঢুকিয়ে ফিতা বাঁধতে শুরু করলে অনিটা বলে ওঠে, ‘বিফোর আই কিক ইউ আউট ফ্রম দ্য শেল্টার, লুক অ্যাট মি ওয়ান লাস্ট টাইম।’ লালচে-হলুদ চুলো চোখ তুলে ক্যানিস্টারের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে, ‘প্লিজ, ডোন্ট স্প্রে চিলি-পেপার, ই গড! আই প্রমিজ আই অ্যাম আউট অব হিয়ার।’ সে খপ করে তার ব্যাকপ্যাক উঠিয়ে দুয়ারের দিকে যেতে চাইলে, অনিটা তার চোখ লক্ষ্য করে খুব সামান্য স্প্রে করে। সে চোখ বন্ধ করে দুয়ার পেরোতে গিয়ে চৌকাঠে বাড়ি লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাইরে। অনিটা বেডরোল তুলে তা দুয়ারের বাইরে ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেয় লন্ঠন ও স্পিরিট স্টোভ। এ আইটেম দুটি এক এক করে বাইরে ছুড়তে ছুড়তে সে বলে, ‘চিলি-পেপার স্প্রে এনেছিলাম ভালুকের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য। শ্যানানডোয়ার ভালুকগুলো খুবই সভ্য, বাট ইউ আর নট, ইউ, দ্য অনলি ফাকেন বার্বেরিয়ান আই মেট ইন দিস ট্রেইল। আবার যদি তোমাকে দেখি পেপার স্প্রের পুরো কেনিস্টার তোমার ওপর ব্যবহার করব, আই প্রমিজ।’

পেপার স্প্রের কারণে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে বেশ কিছু মরিচের গুঁড়া। তাতে আমার হাঁচি আসে। কয়েকবার হাঁচি দেওয়ার পর আমি কাশতে থাকলে অনিটা উঠে জানালা দুটো খুলে দিয়ে আমাকে পেপার স্প্রে দেখিয়ে বলে, ‘জাস্ট শাট ইয়োর মাউথ আপ অ্যান্ড গো টু স্লিপ, ও-কে।’ সে টেবিলে বসে বিছানার চাদর তুলে তার নগ্ন বুক ঢেকে হাঁপায়। তারপর সেও কাশতে শুরু করলে আমি কম্বল দিয়ে মুখ ঢেকে মটকা মেরে পড়ে থাকি।