ঈদ মানে হাসি-আনন্দ, ঈদ মানে উৎসবের উদ্বেলতা। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ঈদেও কি ছিল এই আনন্দের ফোয়ারা? যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। অবকাঠামো ধ্বংসপ্রায়। বাংলার আকাশে-বাতাসে তখনো লাশের গন্ধ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সন্ধান মিলছিল অসংখ্য গণকবরের। মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসছিল মানুষের হাড়গোড়, কঙ্কাল ও মাথার খুলি। এই বাস্তবতায় তখনকার ঈদ কেমন ছিল, সেসবের বিবরণ লেখা আছে ওই সময়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও বইপত্রে।
২৭ জানুয়ারি ১৯৭২, বৃহস্পতিবার। তখন স্বাধীন দেশ। মুক্ত বাঙালি জাতি। কোথাও নেই পাকিস্তানি হানাদারদের সেই আগ্রাসী ও বর্বর হায়েনারূপীদের পদচারণ। এদিন স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ঈদ—ঈদুল আজহা (কোরবানির ঈদ) উদ্যাপন করেছিল বাঙালি জাতি।
মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া অনেকে বাড়ি ফেরেননি তখনো। গৃহবধূ জানেন না তাঁর মুক্তিযোদ্ধা স্বামী বেঁচে আছেন কি না। সে সময় অনেক মা প্রতিদিনই বসে থাকতেন পথের ধারে। মনে আশা, এই বুঝি ফিরে এল মুক্তিযোদ্ধা ছেলে। একইভাবে শহীদদের পরিবারের অনেকেই সে সময় জানতেন না, তাঁদের স্বজনদের লাশ কোথাও সমাহিত করা হয়েছে কি না; নাকি মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে, অথবা ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে কোনো নদী বা খালে।
আবার ভারত ও বাংলাদেশে চিকিৎসাধীন অনেক মুক্তিযোদ্ধাই তখন অবধি বাড়িতে খবরটি পর্যন্ত পাঠাতে পারেননি যে তিনি বেঁচে আছেন। এমন একটি সময়ে স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র ১ মাস ১০ দিন পর আসে দেশের সর্বপ্রথম ঈদ—ঈদুল আজহা।
মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাসে স্বজন হারানো পরিবারে এই ঈদ ছিল আনুষ্ঠানিকতামাত্র। ঈদের আনন্দ স্পর্শ করেনি তাদের। এ প্রসঙ্গে লেখকের নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির স্মৃতিচারণ করেন স্বাধীন বাংলাদেশের সেই পয়লা ঈদের, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম কোরবানির ঈদ হয়েছিল ২৬ বা ২৭ জানুয়ারি, এখন ঠিক মনে নেই তারিখটা। দেশের মানুষের কাছে ঈদটা আনন্দের ছিল, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের পরিবারের জন্য এটা ছিল খুবই বেদনাবহ একটা দিন। ওই দিন ঈদ কী জিনিস, আমরা জানতাম না। আমার অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন আমাদের পরিবারের প্রধান। যুদ্ধের সময় তাঁর অন্তর্ধান হয়। এই অন্তর্ধানকে কেন্দ্র করে জহির রায়হান একটি তদন্ত কমিটি করেছিলেন। শহীদুল্লা কায়সারের খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ঈদের দিন আমরা জেনারেল খালেদ মোশাররফের বাড়িতে যাই, সরকারের বিভিন্নজনের বাড়িতে গিয়েছি। এ সময় একটা খবর পাওয়া যায় যে মিরপুরে জামায়াতিরা যারা ছিল, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসররা, সেখানে তাঁদের আটকে রেখেছে; বন্দী বিনিময় করবে—এ রকম খবরও পাওয়া যায়। ফলে এদিন গোটা পরিবারের জন্য ঈদ কী জিনিস, তা অন্তত আমাদের জন্য ছিল না। আমাদের মতো হাজার হাজার শহীদ পরিবারের জন্য ওই ঈদ কোনোই তাৎপর্য বহন করেনি। সদ্য স্বাধীন দেশ। সবাই মুক্তির আনন্দে উল্লসিত। কিন্তু ৩০ লাখ শহীদ পরিবারে ঈদ আসেনি সে বছর। ১৯৭২ সালের ঈদ তো নয়ই, এর পরও খুব কমসংখ্যক শহীদ পরিবারই ঈদের প্রকৃত আনন্দ উপভোগ করতে পেরেছে। কারণ একাত্তরে স্বজন ও সর্বস্ব হারানোর ধাক্কা সামলানো অত সহজ ছিল না।’
মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যুদ্ধ-পরবর্তী প্রথম ঈদ পালন করেন টাঙ্গাইলে। মাওলানা ভাসানীর সাদামাটা ঈদ উদ্যাপন নিয়ে তাঁর নিজের পত্রিকা সাপ্তাহিক হক-কথায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেখানে লেখা হয়, ‘১৯৭২ সালের ঈদুল আজহা অনেক নতুনত্ব লইয়া আসিল। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ঈদ। মাত্র কয় দিন হইল হুজুর ভারত হইতে ফিরিয়া আসিয়াছেন। ঈদুল ফিতরে তিনি দিল্লীর শাহী মসজিদে সশস্ত্র রক্ষীবেষ্টিত অবস্থায় নামাজ আদায় করিয়াছেন। ঈদুল আজহায় আবার স্মৃতিময় সন্তোষে (টাঙ্গাইলে) স্ত্রী, মেয়ে, নাত-নাতনী লইয়া ঈদ করিলেন। এইবার অনেক ব্যতিক্রম। হুজুরের মুরিদদের হালত খুব খারাপ। অতএব হুজুরেরও। সবই তো পুড়িয়া গিয়াছে। ঘরে খাবার বাসনটি পর্যন্ত নাই। রাতের হারিকেন নাই। বিছানাপত্তর নাই। একটা চৌকিও নাই। খড় আর কাঁথা বিছাইয়া ভাসানচরের মাওলানা লাখো ভক্তের হুজুর স্ত্রী, মেয়ে, নাত-নাতনী লইয়া রাত গুজরান করিতেছেন। যাহারা ব্যক্তিগতভাবে হুজুরের জীবনযাত্রা দেখেন নাই, তাহাদের জন্য ইহা বিশ্বাস করিতে কিংবা মানিয়া লইতে কষ্টকর ব্যাপার হইবে। টাঙ্গাইলের তদানীন্তন সিভিল সার্জন ডাক্তার কফিল উদ্দিনের তাগিদে হুজুরের জন্য একটি চৌকির ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। অভাবনীয় অনাড়ম্বরে হুজুরের বাড়িতে এইবার ঈদুল আজহা গেল।’ (আমার ভালোবাসা: মওলানা ভাসানী, সৈয়দ ইরফানুল বারী, পৃষ্ঠা: ৫৯-৬১)। ভাসানীর ঈদ উদ্যাপন সম্পর্কে তো জানা গেল। কিন্তু অন্য নেতাদের ঈদ কেমন ছিল?
দৈনিক পূর্বদেশ-এর ভাষ্য অনুযায়ী, ২৭ জানুয়ারি ১৯৭২ আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ঈদের প্রধান জামাতে অংশ নেন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। এখানে ইমামতি করেন আওয়ামী লীগের নেতা মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ এমসিএ। বলা দরকার, এই জামাতে এবারই প্রথমবারের মতো বাংলায় খুতবা পাঠ করা হয়। আর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঈদের নামাজ পড়েন ধানমন্ডি ক্লাব মাঠে অনুষ্ঠিত জামাতে। সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব ধানমন্ডির ৩২ নম্বরস্থ তাঁর বাসভবনের নিকটবর্তী ধানমন্ডি ক্লাব ময়দানে অনুষ্ঠিত ঈদের জামাতে যোগ দেন। নামাজ শেষে ঐতিহ্য অনুযায়ী বিভিন্নজনের সঙ্গে কোলাকুলি করেন তিনি। এরপর তাঁর সরকারি বাসভবনে অপেক্ষমান বিশিষ্ট মেহমানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিনিময় করেন ঈদের শুভেচ্ছা।
এদিন সব ঈদের জামাতেই নামাজ শেষে মোনাজাতে সদ্য সমাপ্ত স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদের জন্য দোয়া করা হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ঈদে আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও যুদ্ধে স্বজন হারানো পরিবার এবং পাশবিক নির্যাতনের শিকার অসংখ্য মা-বোনদের কাছে ঈদ ধরা দেয়নি তার স্বরূপে—বর্তমান লেখায় এ প্রসঙ্গটি আগেও এসেছে। আর সে সময়ের পত্র–পত্রিকাতেও বিষয়টিকে বিশদ গুরুত্ব ও প্রাধান্য দিয়ে একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, ২৭ জানুয়ারি ১৯৭২, বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ঈদের জামাত নিয়ে ২৯ জানুয়ারি খবর প্রকাশ করে দৈনিক পূর্বদেশ। সেখানে লেখা হয়, ‘ঢাকাসহ বাংলাদেশের সর্বত্র গত বৃহস্পতিবার যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে অনাড়ম্বরভাবে ঈদুল আজহা উদ্যাপিত হয়েছে। মুক্ত মাতৃভূমিতে এটাই প্রথম ঈদ উদ্যাপন। ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঢাকার আউটার স্টেডিয়াম, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, গেন্ডারিয়া, ইস্ট এন্ড মাঠ, ধানমন্ডি ক্লাব ময়দান, আর্মানিটোলা (...দু-একটি জায়গার নাম মুছে যাওয়ায় বোঝা যায় না), আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টার...বিভিন্ন মসজিদ ও মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।’
স্বাধীন দেশের প্রথম ঈদের দিন সর্বত্রই ঈদ জামাতের পর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত ব্যক্তিদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়। এ ছাড়া কামনা করা হয় বাংলাদেশের সমৃদ্ধি।
এই ঈদ উদ্যাপনে সরকারিভাবে কিছু আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও সবখানেই ছিল একটা শোকের ছাপ। এ প্রসঙ্গে পূর্বদেশ-এর ২৯ জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত ঈদ-উদ্যাপনবিষয়ক প্রতিবেদন থেকে আবারও উদ্ধৃতি দেওয়া যায়, ‘বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত মা-বোন ও অসংখ্য পরিবারের দুঃখ–দুর্দশা স্মরণ করে এবারের ঈদ বাংলার মানুষ অনাড়ম্বর ও আনন্দের পরিবর্তে শোকাকুল পরিবেশে উদ্যাপন করেছে।’
স্বাধীন বাংলাদেশে যখন প্রথমবারের মতো ঈদ উদ্যাপিত হচ্ছে, একই সময়ে বিধ্বস্ত দেশে সচল করা হচ্ছে অর্থনীতির চাকা। ঘরে ঘরে বেকার যুবক। যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধারাও বেকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেষ্টা করছিলেন, কীভাবে স্বাধীন বাংলাকে দাঁড় করানো যায়; সে লক্ষ্যে নেওয়া হচ্ছিল নানাবিধ পরিকল্পনা। অপর দিকে পাকিস্তানি সৈন্য ও এদেশীয় দোসর-রাজাকাররা গ্রামে গ্রামে যেসব বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল, সেগুলো মেরামতের চেষ্টা করছিলেন ক্ষতিগ্রস্তরা। বাস্তবতাটি ছিল বিপর্যস্ত। হ্যাঁ, এখনকার ঈদের মতো প্রবল উচ্ছলতায় নয়, ধ্বংসপ্রায় অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিক দুর্দিনেই স্বাধীন দেশের প্রথম ঈদ উদ্যাপন করেছিল বাঙালি মুসলমানরা।