বাংলা নাটকের শেকড়সন্ধানী নাট্যকার সেলিম আল দীন। আজ তাঁর ৬৯তম জন্মদিন। ১৯৪৯ সালের এই দিনে ফেনীর সেনেরখিলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
নাটক রচনায় ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের রচনারীতি এবং পরিবেশনাশৈলীর নতুন রূপ নির্মাণের মাধ্যমে নাটক লিখেছেন সেলিম আল দীন। ফলে অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা নাটকের অত্যাবশ্যক রূপ হিসেবে নির্ণীত হওয়া ইউরোপীয় সংলাপাত্মক নাটকের গড়ন-বৈশিষ্ট্য ভেঙে যায়। সেই সঙ্গে সংস্কৃত কিংবা ইউরোপীয় নাট্যরীতি চিহ্নিত হয় ‘বিজাতীয়’ বা ‘পরজীবী’ নাট্যচর্চা হিসেবে। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গীয় জনপদে পাশ্চাত্য প্রভাবিত নাট্যচর্চার বিস্তৃতি ঘটে। ‘বিজাতীয়’ তথা ‘পরজীবী’ এই নাট্যচর্চার বিপরীতে একসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শম্ভু মিত্র প্রমুখের নাট্য-আঙ্গিক বিকশিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় সেলিম আল দীন ঐতিহ্যবাহী নাট্য-আঙ্গিকের নানা শৈলীকে নতুনরূপে সৃষ্টি করেন। সেলিম আল দীন স্বীয় নাটকে ঔপনিবেশিক নাট্য-শৃঙ্খলার বিপরীতে দেশজ-নাট্যরীতির নবরূপ নির্মাণের মাধ্যমে উন্মোচন করেন আধুনিক বাংলা নাট্যের রূপ। এটি তিনি প্রমাণ করেছেন যে বাংলা ভাষায় লিখিত হলেই বাংলা নাটক হয় না; বরং হাজার বছর ধরে বাঙালির নাট্য-নন্দন ভাবনার কাঠামোর স্বতন্ত্র ও স্বকীয় ব্যবহারেই বাংলা নাটকের গড়ন-গঠন বিকশিত হওয়া প্রয়োজন। আর বাঙালির জীবনে প্রাচীনকাল থেকে পরিবাহিত হয়ে চলা কথা-নৃত্য-গীতের অপ্রয়াস যাতায়াতের মধ্য দিয়েই বিকশিত হয় বাংলা নাটক।
আধুনিক বাংলা নাটকের বিকাশ-পরিক্রমায় ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যের উপাদানগুলোর মধ্যে কথা-নৃত্য-গীতের বহুমাত্রিক ব্যবহার করেন সেলিম আল দীন। তাঁর নাটকের বর্ণনা, সংলাপ প্রভৃতির মধ্যেও ঐতিহ্যবাহী নাট্যের ‘গীতলতা’, ‘গীতময়তা’ ও ‘কাব্যময়তা’র অপরিহার্য সংযোগ বিদ্যমান। এসব কারণেই তিনি যেমন ঐতিহ্যিক বাংলা নাটকের বিনির্মাণে স্বতন্ত্র ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, একই সঙ্গে বাঙালির দ্বৈতাদ্বৈত শিল্পরীতির বিস্তৃত ভূমিও নব আলোয় আলোকিত হয়। স্বতন্ত্র শিল্পতত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’।
সেলিম আল দীনের কীত্তনখোলা নাটকের পূর্ববর্তী সময়ে কোনো নাট্যকারের রচনায় দেশজ নাট্যরীতির প্রয়োগ-সম্ভাবনা তৈরি হয়নি; বরং ১৯৪৭-এর দেশভাগ-পরবর্তী সময়ের অধিকাংশ নাট্যকার ঔপনিবেশিক নাট্যরীতিকে তাঁদের রচনায় আত্তীকরণ করার প্রয়াস পান। ফলে দেশভাগ-পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশেও ইউরোপীয় নাট্য-শৃঙ্খলার আদলে প্রবহমান থাকে নাট্যচর্চা। উপরন্তু, কীত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল ও হাত হদাই প্রভৃতি নাটকে দেশজ নাট্যরীতির প্রয়োগের ধারায় ক্রমান্বয়ে সেলিম আল দীন দেশজ নাট্যরীতির নবরূপ নির্মাণে মনোনিবেশ করেন। ফলে চাকা, হরগজ ও যৈবতী কন্যার মন প্রভৃতি নাটকে কথানাট্যের বিন্যাসে বাঙালির প্রাচীন অভিনয়রীতি পাঁচালির নবনির্মিত রূপ প্রস্ফুটিত হয়। এমনকি বনপাংশুল, প্রাচ্য ও নিমজ্জন প্রভৃতি নাটকের বিন্যাসে ধ্রুপদি নাট্য-পরিবেশনারীতির রচনাকৌশলে প্রয়োগও ঘটতে শুরু করে। তাই এই নাটকগুলো হয়ে ওঠে নব্য পাঁচালি। তদ্রূপ তাঁর স্বর্ণবোয়াল, ধাবমান ও পুত্র প্রভৃতি নাটকও পাঁচালির গঠনকৌশলকে আশ্রয় করে রচিত। এভাবেই সেলিম আল দীন তাঁর পরিণত কালের রচনাগুলোকে ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যধারার সমতলে কথানাট্য, মহাকাব্যিক নাটক, নব্য পাঁচালি কিংবা আখ্যানরূপে গণ্য করার প্রয়াস পান। ফলে ইউরোপীয় ধারার নাটকের শ্রেণি-বিভাজনও আপাতভাবে পরিত্যাগ করেন তিনি। তাঁর এই শৈল্পিক দ্রোহ বাঙালির স্বকীয় সংস্কৃতির রূপ মাধুর্যকেই উন্মোচিত করে।
সেলিম আল দীনের নাটকে বাঙালির নাট্য-সংস্কৃতির কথা (বর্ণনা ও সংলাপ)-নৃত্য-গীত ও আপাত চরিত্রাভিনয়ের রূপ নতুনভাবে বিকশিত। বিশেষ করে, ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকে যেখানে গীতের শাসন প্রধান হয়ে ওঠে, সেখানে তাঁর নাটকে বর্ণনার শাসন স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী নাট্য-পরিবেশনায় শিথিলভাবে ব্যবহৃত চরিত্রাভিনয় তথা সংলাপাত্মক অভিনয়েরও বিস্তৃত ক্ষেত্র তৈরি হয় এই নাট্যকারের নাটকে। লক্ষ করার ব্যাপার হলো, কীত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই, বনপাংশুল ও পুত্র নাটকে চরিত্রাভিনয়রীতির সংযুক্তি গায়েনরূপী অভিনেতাকে শ্রীচৈতন্যদেবের সাত্ত্বিক অভিনয়-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে সমর্থ। এই চরিত্রাভিনয়রীতির বিন্যাসও সেলিম আল দীন আহরণ করেন ঐতিহ্যবাহী নাট্য-পরিবেশনারীতি পাঁচালি থেকে। পাঁচালির বহুবিস্তারী অভিনয়রীতির নব-প্রয়োগে তিনি নাটকের রচনা ও পরিবেশনাকৌশলের সৌকর্য নির্মাণ করেন। এই কৌশলের মূলে কথা-নৃত্য-গীত ও চরিত্রাভিনয়ের সম ও অদ্বৈত চলমানতা সক্রিয় থাকে, যা ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের পরিবেশনাশৈলীতে ঠ্যাটা, গিদাল, ডাইনার সঙ্গে গায়েন-দোহারের আপাত চরিত্রাভিনয় তথা ইঙ্গিতধর্মী অভিনয়ের বিবর্ধিত রূপ হিসেবে গণ্য হয়।
সেলিম আল দীন প্রবর্তিত এই নাট্যকৌশল বাংলাদেশে স্বতন্ত্র ধারার নাট্য-আন্দোলনেরও সূচনা করে। তাই দেখা যায়, বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে বর্তমান সময় (২০১৮) পর্যন্ত বাংলাদেশে দুই ধারার নাট্যচর্চা প্রবহমান। যার একদিকে ঔপনিবেশিক ও বিদেশি নাট্য-শৃঙ্খলার চর্চা প্রচলিত। অন্যদিকে সেলিম আল দীনের চর্চিত আধুনিক বাংলা নাট্যধারার চর্চাও বিদ্যমান। ফলে সেলিম আল দীন প্রবর্তিত আধুনিক বাংলা নাটকের চর্চায় তরুণ নাট্যকারেরাও নাট্যচর্চায় লিপ্ত আছেন। বস্তুত কথা-নৃত্য-গীতের ত্রয়ী বন্ধনে বাংলা নাটকের আধুনিক রূপের কথানাট্য, আখ্যান, নব্য পাঁচালি প্রভৃতি অভিধায় স্বীকৃত নাট্যের চর্চা বর্তমান বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে বিশেষ নান্দনিক শৃঙ্খলা হিসেবেই প্রবহমান।
সেলিম আল দীনের দেশজ ধারার নাটকগুলো পাঠ করলে সহজেই অনুধাবন করা যায়, এ দেশীয় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যে জীবন পরিক্রমা। নাটকে অসংখ্য চরিত্রের অবয়ব নির্মাণ করেছেন তিনি। সেই সব বিচিত্রনামা চরিত্রের মধ্যে কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, গাড়োয়ান, জেলে, রিকশাওয়ালা, পালকি নৃত্যক, বেহারা বা কাহার, কবিয়াল, ডোম, কসবি, যাত্রাশিল্পী, কাঠমিস্ত্রি, মাইটাল, খেতমজুর, সারেং, মাঝি, মাল্লা, মুচি, গৃহিণী, বায়েন, হাড়-কুড়ানো, বয়াতি, তাঁতি প্রভৃতি কর্মে লিপ্ত মানুষের উপস্থিতি আছে। নাট্যকাহিনিতে এই বিচিত্র চরিত্রগুলোর অধিকাংশের বিকাশ ঘটেছে ‘সামাজিক রূপান্তর’-এর ধারাবাহিকতায়, অর্থাৎ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থাকে স্বীকার করে উত্থান-পতনের ধারায় গ্রামীণ মানুষের মধ্যে নিরন্তর যে পেশা বদল-প্রক্রিয়া চলে, সেটি নাট্যচর্চার প্রথম পর্যায় থেকে বিশেষভাবে তুলে এনেছেন সেলিম আল দীন। এ কারণেই কীত্তনখোলা নাটকের সোনাই চাষি থেকে পরিবর্তিত হয়ে দিনমজুর পরিচয়ে বেড়ে ওঠে। আবার ডালিমন যাযাবর লাউয়া জীবন থেকে স্বপ্ন দেখে সুন্দর গৃহকোণের। সেলিম আল দীনের একাধিক নাটকে শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের এই পেশা বদল-প্রক্রিয়ার কারণে ওই সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের সংস্কৃতিতেও বদল ঘটেছে। দেখা যায়, সামাজিক অবস্থান তথা শ্রেণিবৈষম্যের প্রেক্ষাপটে শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের মনস্তাত্ত্বিক চেতনার নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে তাদের বৈচিত্র্যময় পেশা। ফলে এই পেশাজীবী তথা শ্রমজীবী সম্প্রদায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তাঁর নাটকে। বলা ভালো, তাঁর নাট্যের প্রধানতম উপাদানরূপে বঙ্গভূমির সংস্কৃতি ও মানুষের জীবন এবং জীবিকা অবলম্বিত হয়। যেখানে বহুমাত্রিক পেশাজীবী মানুষের কর্ম ও মনস্তত্ত্ব প্রকাশ পায়।
সেলিম আল দীনের আতর আলীদের নীলাভ পাট, কীত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, বাসন, হাত হদাই, প্রাচ্য, যৈবতী কন্যার মন, বনপাংশুল, চাকা, ধাবমান, স্বর্ণবোয়াল ও পুত্র প্রভৃতি নাটকে বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র জীবনদর্শন কিংবা নৃ-আচরণ ও বিশ্বাসের প্রতিফলন পাওয়া যায়। শুধু তা-ই নয়, এসব নাটকের প্রায় প্রতিটি চরিত্রই অন্তরে আদি-অকৃত্রিম বংশীয় কর্মকে লালন করেও পণ্যসভ্যতার পেষণে নিয়ত রূপান্তরের ক্ষরণ লালন করে চলে। সর্বদাই তারা অত্যাচারীর অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জীবনসংগ্রামে রত। এই চরিত্রগুলোর মধ্যে ‘মানুষতা’র স্ফুরণ যেন অনন্যরূপে অভিষিক্ত। তদুপরি সম্প্রদায় বা কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠী তাঁর নাটকের বিষয় হলেও মানবতাবোধ ও জীবনবোধের গভীরতায় এই নাট্যচরিত্রগুলো আধুনিক মানুষের জীবন অভিজ্ঞতায়ও উপনীত হয়। বলতে পারি, সেলিম আল দীনের চরিত্ররা মানুষ হিসেবে বিশাল আকার ধারণ করে প্রায় প্রতিটি নাটকেই, যেখানে তাঁর একেকটি চরিত্র কোনো না কোনো সমাজ, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী কিংবা একটি সময়ের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত হয়। এ প্রসঙ্গে পুত্র নাটকের কথা বলা যায়। এখানে আধুনিক মানুষের চিন্তা-চেতনাজাত দরিদ্র নারী আবছার মানবিক অভিঘাতে ঋদ্ধ দ্রোহের প্রতিরূপ নির্মিত হয়। আবছা নামী নারী সন্তানলাভের তাগিদে সংসারত্যাগী, সমকালীন ও প্রথাগত জীবনব্যবস্থার বিপরীতগামী। ভারতীয় তথা বাঙালি নারীর নিত্যকালের মাতৃত্বের যে আর্তনাদ, সেই আর্তনাদেই আবছা বার্ধক্যজনিত কারণে সন্তান জন্মদানে অক্ষম সিরাজকে ত্যাগ করে চলে যায় নতুন গর্ভের সন্ধানে। পুরুষপ্রধান সমাজব্যবস্থায় নিত্য অভাব আর দারিদ্র্যের সঙ্গে বাসরত আবছার এমন দ্রোহ একদিকে যেমন মানবিকতায় উন্মীলিত, অন্যদিকে সমাজের বঞ্চিত নারীর আকাঙ্ক্ষার প্রকাশও এতে পাওয়া যাবে। এভাবেই সেলিম আল দীন বাংলা নাটকের আঙ্গিক এবং চরিত্রগুলোকে নির্মাণ করেন বিশালতায়। তাঁর এই প্রয়াসই মূলত আধুনিক বাংলা নাটকের চর্চাকে স্বতন্ত্র মহিমায় প্রবাহিত করে চলেছে, কথাটি না বললেও চলে।