‘যুবতী, ক্যানবা করো মন ভারী,
পাবনা থ্যাহ্যা আন্যে দেব টাকা
দামের মটরি।’
(লোকসংগীত)
যুবক মাঝি তার অভিমানিনী যুবতী বউকে যে ‘মটরি’ কিনে দিতে চেয়েছে—সেই ‘মটরি’ যে পাবনা অঞ্চলের তাঁতে তৈরি হওয়া এক বাহারি শাড়ির নাম, বহু বহু দিন পর সেটা জানতে পেরে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ যখন বিরহী হরিপদর মানসলোকে উঁকি দিয়ে সেখানে নিত্য যাওয়া–আসা করা এক অধরা নারীর ছবি এঁকে দিলেন, অন্য অনেক যুবকের মতোই আমার মনেও চিরস্থায়ী হয়ে গেল সে চিত্রকল্প। প্রথম বিরহের ধাক্কায় কণ্ঠস্থ হয়ে গেল ‘বাঁশি’ কবিতার সেই দুই পঙ্ক্তি—
‘ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া—
পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর।’
আমাদের মৌখিক ও লিখিত সাহিত্যে এই ঢাকাই শাড়ির বহুল উল্লেখের পরেও ‘ঢাকাই শাড়ি’ বস্তুখানা প্রকৃতপক্ষে কী, তা আজও জানা হয়নি—কেনা তো দূরের কথা।
চর্যাপদ-এর বিভিন্ন চর্যায় তাঁত ও তাঁতির কথা উল্লেখ থাকলেও শাড়ির কথা নেই। চর্যাপদ–এ না থাকলেও শাড়ির কথা বলেছেন চৌদ্দ শতকের বৈষ্ণব পদাবলির রচয়িতা বাঙালি কবি চণ্ডীদাস। সদ্যস্নাত রাধা নীল শাড়ি পরে বাড়ির দিকে চলেছেন—এ অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে আবেগমথিত কৃষ্ণ বলে ওঠেন, ‘চলে নীল শাড়ি, নিঙাড়ি নিঙাড়ি—পরান সহিত মোর…।’ চলমান নীল শাড়ি আমার পরান নিঙড়ে নিচ্ছে! চণ্ডীদাস যখন নীল শাড়ির প্রেমে ধরাশায়ী কৃষ্ণের করুণ মানসিক অবস্থার কথা লিখছেন, তখন কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে ছবি আঁকছেন বিয়ের অনুষ্ঠানের। বিয়েতে আগত অতিথিরা উপহারের তালিকায় অন্য দ্রব্যাদির সঙ্গে পাটের শাড়িও নিয়ে এসেছেন। কবিকঙ্কণ লিখেছেন—
‘কেহ নেত কেহ সেত
কেহ পাট সাড়ি
চন্দন-কুসুম কেহ বাটাভরা কড়ি।’
পাটের তন্তু দিয়ে শাড়ি তৈরি সম্ভব কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকলেও এ বিষয়ে কোন সন্দেই নেই যে ‘অগ্নি-পাটের শাড়ি’ পরা কমলাকে দেখে আকাশের তারারাও লজ্জা পেত। দ্বিজ ঈশান লিখছেন—
‘অগ্নি-পাটের শাড়ি কন্যা
যখন নাকি পরে
স্বর্গের তারা লাজ পায়
দেখিয়া কন্যারে।’
‘অগ্নি-পাটের শাড়ি’ পরা যুবতী কমলা দেখতে কেমন, সে ভাবনায় না গিয়ে বরং ‘লক্ষ্মীবিলাস’ শাড়ির কথা শোনা যাক। ‘গোপীচন্দ্রের গান’-এ এই লক্ষ্মীবিলাস শাড়ির নকশার যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, বাংলা সাহিত্য ও সংগীতের ইতিহাসে তা বিরল—
‘…দরিয়ার জাত মাছ মগ্র দ্যাছে
কাপড়াএ নেখিয়া।
পৃথিবীর যত পক্ষি দ্যাছে
কাপড়াএ নেখিয়া।’
দরিয়ার যত মাছ আর পৃথিবীর যত পাখি, সবই ছিল সেই শাড়ির নকশায়। রাজহাঁস, বালিহাঁস, সরালি, চকোর, বুলবুলের নকশা তোলা সে শাড়ি গায়ে গোপীচন্দ্রের বড় স্ত্রী ‘রদুনা রানি’ (অদুনা) চলেছেন পরীক্ষায়! প্রাত্যহিক জীবনে তো বটেই, নিজের সতীত্ব আর জীবনের গূঢ় পরীক্ষায়ও বাঙালি নারী নকশাদার শাড়ি গায়ে মহিমাময়ী।
আমাদের এই ভূখণ্ডের সূক্ষ্ম বস্ত্র তৈরির প্রামাণ্য ইতিহাস রয়েছে। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, সেসব বস্ত্র এতই সূক্ষ্ম ছিল যে ভোরের শিশির পড়লে তাকে দেখাই যেত না। সোনাইবিবির পালার অজ্ঞাতনামা কবিও জানাচ্ছেন, তাঁর নায়িকা গঙ্গার জল, গুয়ার ফুল, উনী, হিয়া, ধ্যাতি ইত্যাদি নামে যে শাড়ি পরে পরে পরখ করছিল, সেসব শাড়িও ছিল আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের। যেমন—গঙ্গার জল নামে যে শাড়ি, জলের ওপর রাখলে সেটিও জলের মতোই টলমল করত। সে শাড়ি এতই পাতলা ছিল যে শুকনা জায়গায় রাখলে তাকে পিঁপড়ায় টেনে নিয়ে যেত।
‘পানিতে থইলে গো শাড়ি
শাড়ি পানিতেই মিলায়
শুখেনায় থইলে শাড়ি ভাইরে
পিঁপড়ায় টাইন্যা লইয়া যায়রে।’
গুয়ার ফুল শাড়ি বুনতে ‘বিশকরম ঠাকুর’-এর ছয় মাস সময় লেগেছিল। সে শাড়ি হাতের মুষ্ঠিতে ভরে ফেলা যেত। ধ্যাতি নামের শাড়ির পাড়ে ছিল হরেক পাখির নকশা। তারপরও এসব শাড়ি ছিল সোনাইবিবির না–পছন্দের তালিকায়। একটার পর একটা শাড়ি বাতিল করে বেনারসি শাড়ি বেছে নিয়ে তবেই ‘কন্যা’ শান্ত হলো।
বেনারসি শাড়ির কথায় মনে পড়ে গেল, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘শিল্পী’র তাঁতি সম্প্রদায়ের কথা। তারা যখন মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া না–নেওয়ার দোলাচলে দুলছে, তখন তাদেরই একজনের মনে পড়ে যায় এক ভিন্ন গল্প, ‘বাবুদের বাপের আমলে বেনারসি বুনে দেবার বায়না পেয়েছিল মদনের বাপ।’ বাপের সার্থক উত্তরাধিকারী শিল্পী মদন কি বাবুদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কাপড় বুনবে? মনোহর বসাকের উপন্যাস নীলাম্বরীর নকশাতেও আমরা একই রকম দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা চরিত্র পঞ্চাননের দেখা পাই, যে ‘বুটিদার নীলাম্বরী’ শাড়ি বানিয়ে জেলার তাঁতশিল্প প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছিল। পাপড়ি রহমানের বয়ন উপন্যাসেও মসলিনের উত্তরসূরি জামদানি শাড়ির কারিগরদের এক বেদনাবিধূর চিত্র ধরা পড়ে।
উপন্যাসের কঠিন বাস্তবতার পটভূমিতে শাড়ির মতো রোমান্টিক আর প্রত্নতাত্বিক পোশাকের সঙ্গে বেদনার ধূসর জগৎ ঠিক মেলে না। বরং জীবনানন্দ দাশের মায়াবী জগৎ বাংলার নারী আর শাড়ির মধ্যে যে পরাবাস্তব ভাব তৈরি করে রেখেছে সুদীর্ঘ সময়, শাড়ির আলোচনায় তারই গুরুত্ব বেশি।—
‘যেইখানে কল্কাপেড়ে শাড়ি প’রে কোনো এক সুন্দরীর শব
চন্দন চিতায় চড়ে—আমের শাখায় শুক ভুলে যায় কথা;
সেইখানে সবচেয়ে বেশি রূপ—সবচেয়ে গাঢ় বিষণ্নতা;’
(‘যতদিন বেঁচে আছি’, রূপসী বাংলা)
এ ছাড়া জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা কাব্যের ‘পাড়াগাঁর দু’পহর’ কবিতায়ও পাওয়া যায় ‘নক্সাপেড়ে’ শাড়ির কথা।
হাতে–পায়ে যতই আলতার দাগ টানো মেয়ে, জামদানিই হোক কিংবা নীলাম্বরী অথবা কেলী-কদম্ব-শাড়ি না হলে তোমার রূপ খোলতাই হবে না, পূর্ণ হবে না অভিসার অথবা প্রতীক্ষা। সোজন বাদিয়ার ঘাট কাব্যে শাড়ির বর্ণনায় জসীমউদ্দীন রোমান্টিক কিন্তু বাস্তব—
‘তবুও আবার রজনী আসিল,
জামদানি শাড়িখানি
পেটেরা খুলিয়া সযতনে দুলী
অঙ্গে লইল টানি।’
আবার এই জসীমউদ্দীনের বালুচর কাব্যে ‘আসমান তারা’, সোজন বাদিয়ার ঘাট–এ ‘মধুমালা’, ‘কলমীলতা’, ‘বালুচর’, ‘জলে-ভাসা’, ‘কেলী-কদম্ব’, ধানখেত কাব্যে ‘হলদি-কোটার’ শাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। পাওয়া যায় প্রেম-প্রতীক্ষা-বিরহ-বেদনাময় যাপিত জীবনে পুরুষ, নারী ও শাড়ির এক জটিল রহস্যময় মিথস্ক্রিয়া।
প্রেমিক বিম্বিসার আর নির্বাণের আঁধার মহামতি বুদ্ধ—‘সর্বাঙ্গসুন্দরী’ গণভোগ্যা সংগীতপটিয়সী আম্রপালীর কাছে এই দুই পুরুষের গুরুত্ব ছিল দুই রকম। ষাটের দশকের কবি আবুল হাসানের ‘নর্তকী ও মুদ্রাসঙ্কট’ কবিতার নর্তকীর সে সংকট না থাকলেও শরীরে সিফন শাড়ির শোভা তারও প্রয়োজন হয়। তাই কবি বলেন—
‘তুমি তো নও আম্রপালী,
বর্তমানের নারী
তোমার লাগে লিনোলিয়াম
সিফনঘেরা শাড়ি’।
তবে শেষ কথা হলো, উপন্যাসের চেয়ে কবিতায়ই শাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায় বেশি। কিন্তু রাশি রাশি কবিতার মধ্য থেকে শাড়ির কথা খুঁজে বের করা ‘সিন্ধুর মধ্যে বিন্দু’ খোঁজারই সামিল।
সূত্র: শাওন আকন্দের বাংলাদেশের তাঁতশিল্প