সাহিত্যে আর সেলুলয়েডে সত্যজিতের নারীদের ব্যাপ্তিতে বিশাল ফারাক। সাহিত্যে যেখানে তিনি নারীত্বকে একরকম অস্বীকারই করে গেলেন, সেখানে তাঁরই হাত ধরে রুপালি পর্দায় উপস্থাপিত হলো নারীত্বের সত্যতম রূপ। বাংলার কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে নিজের লেখা ও চলচ্চিত্রে নারীদের কীভাবে দেখেছেন তিনি, তা নিয়ে এক অনবদ্য অবলোকন।
আমাদের ছোটবেলায় বাঙালি মধ্যবিত্তের বাড়িতে রবীন্দ্র-নজরুল-সত্যজিৎ বড় আপন নাম ছিল। বিশ্বকবি আর জাতীয় কবির সঙ্গে একনিশ্বাসে তৃতীয় ব্যক্তিটির নাম বলা যাবে কি না, সে নিয়ে ইদানীং দ্বিধায় পড়ে যাই। কারণ ‘লোকে কী বলবে?’ প্রশ্নটা সহজেই মাথার মধ্যে মাথাচাড়া দেয়। অবশ্য যে শৈশবের কথা বলছি, তখন এমনটা হতো না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম তখন আরও একটু ভারী নাম, তাতে ‘বড় হলে বুঝব’ ট্যাগটা প্রায় স্বপ্রণোদিত হয়েই দিয়েছিলাম। তাই সত্যজিৎ রায় দীর্ঘদিন ‘আপনার চেয়ে আপন যেজন’ হয়ে রয়ে গেলেন। অন্তত শৈশবের সমস্তটা আর কৈশোরের অর্ধেকটাজুড়ে।
কিন্তু তারপর? তারপর আসলে প্রশ্ন করতে শিখলাম। তোপসের মা কোথায়? ২১, রজনী সেন রোড। লেখক বলছেন, বিখ্যাত এই ঠিকানায় ফেলুদা তার কাকার বাড়িতে কাকার পরিবারের সঙ্গেই থাকে। তবে সে বাড়িতে কোনো নারী সদস্য নেই কেন? এমনকি লালমোহনবাবুর জীবনেও নারীর অস্তিত্ব নেই। মা, বোন, স্ত্রী—কেউ না। অন্তত তাঁর কথায় তাদের কাউকে পাওয়া যায় না। জটায়ু বাবার কথা বলছেন, ‘গোরস্থানে সাবধান’-এ ঠাকুরদা প্যারীচরণ গাঙ্গুলির কথা বলছেন, এমনকি এথিনিয়াম ইনস্টিটিউটের শিক্ষক বৈকুণ্ঠ মল্লিক ও তাঁর কাব্যপ্রতিভার প্রতি জটায়ুর মুগ্ধতার কথাও বেশ কয়েকবার প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু মাঝবয়সী এই রহস্য ঔপন্যাসিকের জীবনে কোনো নারীর প্রভাব বা অস্তিত্ব সম্পর্কে লেখক আমাদের কিছু বলেননি।
তবে কি রহস্য অনুসন্ধানে আর রহস্য কল্পনার পথে নারীকে অন্তরায় বা অপাঙক্তেয় বিবেচনা করেছিলেন লেখক? নাকি প্রিয় লেখক আর্থার কোনান ডয়েলের সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমস-ওয়াটসনের আদলে গড়তে গিয়েই ফেলুদা-তোপসে-জটায়ুকে নারীবিবর্জিত রেখেছেন তিনি? অন্যান্য বাঙালি গোয়েন্দার ক্ষেত্রে কিন্তু এমনটি হয়নি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর কেয়াতলার বাড়িতে স্ত্রী সত্যবতী স্পষ্ট, বিরাজমান হিসেবেই লক্ষণীয়। নীহাররঞ্জন গুপ্তের গোয়েন্দা চরিত্র কিরীটী রায়েরও স্ত্রীর পরিচয় পাওয়া যায়। হ্যাঁ, তবে এ কথাও সত্যি, ব্যোমকেশের স্ত্রী সত্যবতী বা কিরীটী রায়ের স্ত্রী কৃষ্ণা—কেউই মূল কাহিনির সঙ্গে খুব একটা সম্পর্কিত নয়।
সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট আরও দুই অমর চরিত্র প্রফেসর শঙ্কু আর তারিণীখুড়ো। এই নিভৃতচারী বিজ্ঞানী আর মজলিশি বৃদ্ধ—কারও অভিজ্ঞতাতেই আমরা কোনো নারী চরিত্রের আভাস পাই না। এদিক থেকে বরং ফেলুদার গল্প-উপন্যাসকে খানিকটা ব্যতিক্রম বলা যায়। ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ শিক্ষিত-রুচিশীল গৃহিণী নীলিমা দেবী, ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’-এ অভিনেত্রী শকুন্তলা দেবী, সংবেদনশীল প্যামেলা সুনীলা ও মেরি শীলা, ‘জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা’য় আবহমান সনাতন বাঙালি চরিত্র ঠাকুমার কথা উল্লেখিত হয়েছে। বইগুলোতে তারা মুখ্য না হলেও রহস্যের সঙ্গে বেশ গভীরভাবেই জড়িত।
ফেলুদাকে নিয়ে লেখা হয়েছে ৩৯টি গল্প-উপন্যাস। তাতে নারীত্বের এই এতটুকুন ব্যাপ্তি আমাদের ঠিক সন্তুষ্ট করে না, তবে আমরা বোধ হয় খানিকটা আশ্বস্ত হই। হাঁপ ছেড়ে বলি, যাক! সে ব্রহ্মাণ্ডে অন্তত নারীর অস্তিত্ব আছে! ১০০টির বেশি ছোটগল্প লিখেছেন সত্যজিৎ রায়। সেগুলো যে মানে-গুণে-মুগ্ধকরণে নিজেরাই নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। শুধু নারীত্বের উপস্থিতি নিয়ে যে আক্ষেপটা ফেলুদা-প্রফেসর শঙ্কু-তারিণীখুড়োর গল্প-উপন্যাসে ছিল, সেটি এখানেও রয়ে যায়। ‘পিকু’ আর ‘ময়ূরকণ্ঠী জেলী’—মাত্র দুটি গল্পে আমরা নারী চরিত্রের উপস্থিতি দেখি। উল্লেখ্য, দুটোই বড়দের জন্য লেখা ছোটগল্প।
কিন্তু ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে সত্যজিৎ রায় যেন হয়ে গেলেন ভিন্ন এক মানুষ। ভীষণ সাবলীলভাবে রুপালি পর্দায় ফুটিয়ে তুললেন নারীর অনুভব আর টানাপোড়েন, আকাঙ্ক্ষা আর অভিলাষের গল্প। নারীত্বের বোধকে খুব ভালো করে উপলব্ধি না করলে অমন সাবলীলতা অর্জন করাও অসম্ভব। ভারতীয় ও বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নারীত্বের এমন সূক্ষ্ম ও সহজাত প্রকাশ আগেও হয়নি, বর্তমানেও হচ্ছে না।
ইতিহাসের কথা যেহেতু বলছিই, তবে একটু পেছন ফিরে দেখা যাক। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন নির্বাক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এ অঞ্চলে চলচ্চিত্রশিল্পের উৎপত্তি ঘটল, তাতে নারী চরিত্রগুলো ছিল পুরোপুরি আলংকারিক। সবাক চলচ্চিত্রের যুগেও নারী হয়ে গেল সৌন্দর্যের উপাদান। অতীতে তো বটেই, এখনো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দর্শকদের কথা ভেবে চলচ্চিত্রে নারীর যে চিত্রায়ণ, তাতেও তারা বড় সীমাবদ্ধ। ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক শ্যাম বেনেগালের কথায়ও সে আভাসই পাওয়া যায়, ‘মমতাময়ী মা, পরিবারের জন্য আত্মত্যাগ করা স্ত্রী, অভিমানী প্রেমিকা বা শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক—আমাদের চলচ্চিত্রে নারীর ব্যাপ্তি ছিল এই এতটুকুই। সামাজিক ও পারিবারিক ভূমিকার বাইরে যে আমরা নারীকে মানুষ হিসেবে “দেখতে” ও “দেখাতে” ব্যর্থ হয়েছিলাম, এটাও তো নারীর প্রতি বঞ্চনা।’ এমনকি এখনো বেশির ভাগ নারীপ্রধান চলচ্চিত্রে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেড়ে ওঠা দর্শককুলের মন রাখতেই চেষ্টা করছেন পরিচালকেরা। যুগের পর যুগ ধরে নারীরা ‘টাইপকাস্ট’ হচ্ছে চলচ্চিত্রে। দেবী বা অতিমানবী হিসেবে নারীকে পর্দায় তুলে ধরছেন কেউ কেউ। কিন্তু তাতেও নারীর ক্ষমতার চেয়ে তাকে পুরুষের পছন্দনীয় করে উপস্থাপন করাই যেন বেশি জরুরি। সেই ধারা বজায় রাখতে গিয়ে এ অঞ্চলের চলচ্চিত্রে যোগ হয়েছে আরও একটি সংকীর্ণ প্রথা। ভারতীয় চলচ্চিত্র গবেষক ও সমালোচক সোমা চ্যাটার্জির কলামে উঠে এল সে কথাই, ‘একটু খেয়াল করে দেখবেন, উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রে নারীরা প্রধানত দুরকম। এক, নম্র-ভদ্র, স্নিগ্ধ-সুন্দর, আত্মত্যাগী নারী। তার চরিত্রে ভুল বা দোষের কোনো অস্তিত্ব নেই। দুই, রুক্ষ, কর্কশ ও বাহ্যিকভাবে অসুন্দর নারী। তার চরিত্রে ভুল বা দোষের শেষ নেই। এ চরিত্রগুলো নিজে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং ভুল করছে এমনটা দেখানোর প্রবণতাও আছে।’ অর্থাৎ নারী চরিত্রের গভীরতা ও তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারটি আবারও উপেক্ষিত হলো। তাকে বেঁধে ফেলা হলো ‘ভালো’ ও ‘খারাপ’-এর বেড়াজালে।
উপমহাদেশীয় সিনেমায় নারী চরিত্রকে এই সংকীর্ণভাবে উপস্থাপনের রীতিকে দুর্দান্তভাবে অতিক্রম করেছে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা। প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’(১৯৫৫) থেকেই নারীকে তিনি উপস্থাপন করলেন রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে। দর্শক বিস্ময় নিয়ে দেখল ব্রাহ্মণ গৃহিণী সর্বজয়া মমতাময়ী মা বটে, তবে তার চরিত্রেও স্বার্থপরতা আছে। আমরা অভাবের তাড়নায় জর্জরিত সর্বজয়াকে যেমন দেখলাম, তেমনি দেখলাম তার দৃঢ়তাকেও। সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তাই তাঁরই সিনেমা দিয়ে চলচ্চিত্রজগতে যাত্রা শুরু করা বিশিষ্ট অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর লেখেন, ‘“মেলোড্রামা”কে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে তাঁর নারী চরিত্ররা সে যুগের হিন্দি ছবির নারীদের মতোই “মাতৃরূপী দেবী” হয়ে উঠত। মানিকদার (সত্যজিতের ডাকনাম) সঙ্গে এখানেই তফাতটা স্পষ্ট—সর্বজয়াকে তিনি না দিলেন কোনো উচ্চকিত সংলাপ, না দিলেন নাটকীয় ভঙ্গিমায় “সেলফ-পিটি” বা নিজের ওপর করুণা করার অবকাশ। এমনকি তার অবিচলতার গুণগানও হলো না। তবু তার চাহনি, মুখভঙ্গি দেখে দর্শক বুঝে গেল তার যন্ত্রণা ও আক্ষেপের কথা।’
সত্যিই, সত্যজিতের নারী চরিত্রেরা বিচিত্র সাজপোশাকে হাজির হয়ে, বড় বড় বক্তৃতার মতো মনোলগ দিয়ে নারীমুক্তির কথা বলে না। তাই হয়তো নারীর বঞ্চনা, তীব্র দুঃখবোধের বাস্তবিক প্রকাশ দর্শকমনে পৌঁছায় সহজেই। শর্মিলা ঠাকুর অভিনীত তাঁর ‘দেবী’ সিনেমাটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা হয়তো ব্যাপারটি আরও ভালো করে বুঝতে পারবেন। জমিদার কালীকিঙ্কর রায় স্বপ্নে তাঁর ছোট বউমা দয়াময়ীর মধ্যে দেবী দর্শন লাভ করলেন। পরদিন সকালে কালীভক্ত শ্বশুর প্রণাম করতে যখন তার সামনে ঝুঁকে পড়লেন, দয়াময়ী মুখে কোনো শব্দই করল না। আমরা শুধু দেখলাম প্রণামোদ্যত শ্বশুরের সামনে তার পায়ের আঙুলগুলো কুঁকড়ে আসার দৃশ্য, সহসা দেয়ালের দিকে ঘুরে গিয়ে নখ দিয়ে দেয়াল আঁচড়ে দেওয়ার দৃশ্য আর শর্মিলা ঠাকুরের চেহারাজুড়ে গভীর শূন্যতা। এই এক মিনিটের দৃশ্যেই একদম বিনা বাক্যব্যয়ে দয়াময়ী বলে দিল তার হতাশা ও ক্ষোভের কথা, বুঝিয়ে দিল পুরুষতান্ত্রিকতা আর ধর্মান্ধতার আরোপিত নিয়মের সামনে সে কী ভীষণ অসহায়!
বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে বলতে পারি, বিমলা, চারুলতা থেকে শুরু করে আরতি, অদিতি—এদের সবাই আজও বড় বেশি প্রাসঙ্গিক। ব্যক্তিগত মতাদর্শের অমিল থাকায় বিমলার মতো অনেককেই ভুগতে হয় চরম সিদ্ধান্তহীনতায়। আজও অনেক বাড়িতেই গৃহকর্তার ভূমিকায় আটকে থাকেন স্বামীরা আর নারীদের বিচরণক্ষেত্র ঘর থেকে উঠান, উঠান হয়ে ঘর। ফলে একাকিত্ব আজও উপমহাদেশের নারীদের সঙ্গী।
সত্যজিৎ রায় দীর্ঘদিন মনোক্রোমাটিক ছবি বানিয়েছেন সত্যি, তবে মানুষ যে মনোক্রোমাটিক নয়, সে সত্য তিনি ভালোভাবেই জানতেন। অন্যদের মতো তিনি পরিচালক বা চিত্রনাট্যকার হিসেবে নারী চরিত্রের ওপর ভুল বা ঠিকের ‘লেবেল’ বসিয়ে দেননি। তিনি নারীকে দেখেছেন মানুষ হিসেবে আর সাদরে গ্রহণ করেছেন মানবমনের ধূসর অঞ্চলকে। তাই একদিকে ‘অপুর সংসার’(১৯৫৯)-এ তিনি স্বামীর প্রতি অপর্ণার নিখাদ ভালোবাসাকে সুনিপুণভাবে উপস্থাপন করেছেন। আবার স্বামী-সন্তানের প্রতি অগাধ ভালোবাসা নিয়েও সীমাবদ্ধ (১৯৭১) সিনেমার দোলনকে যখন আমরা উচ্চ জীবনমানের স্বপ্নে বিভোর হতে দেখি, তার প্রতি আমাদের নেতিবাচক মনোভাব জন্মায় না। বরং দোলনের এই উচ্চাভিলাষিতাকে স্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই মনে হয়। অথচ অন্য কোনো পরিচালকের হাতে পড়লে এই দোলন চরিত্রটি হয়তো লোভী, কুচক্রী নারীর অভিধা নিয়ে উপস্থাপিত হতো। মানবচরিত্রের যেকোনো দিককে এমন সহজ, স্বাভাবিকভাবে তুলে ধরার গুণটি নিঃসন্দেহে সত্যজিৎ রায়ের নির্মাণশৈলীর ‘মাস্টারস্ট্রোক’।
উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে বেশির ভাগ সময়েই নারীর চাওয়া-পাওয়া ঢাকা পড়ে যায় লজ্জাবনত চোখে বা আত্মত্যাগের মহিমায়। আর সাম্প্রতিক সময়ে যখন কেউ কেউ প্রথা ভেঙে নারীর চাহিদার কথা, বিশেষত যৌন আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরেছেন, তখন সেখানে শিল্পসম্মত উপস্থাপন পাওয়া যায় কি না, সে নিয়ে প্রচুর বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। অথচ ১৯৭০ সালে নির্মিত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তেও সত্যজিতের নারী চরিত্রেরা তাদের ইচ্ছা ও বাসনার প্রকাশে কী দারুণ স্পষ্ট। সেখানে আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখি, মাত্র তিন মিনিটের দৃশ্যে কোনো লাস্যময়তা ছাড়াই যুবতী, বিধবা অপর্ণা বুঝিয়ে দিচ্ছে তার একাকিত্ব ও কামনার কথা। অপর্ণা মা ও পুত্রবধূ, বুদ্ধিমান ও রহস্যময়ী। কিন্তু তার যৌন আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট হওয়ার পরও সে চরিত্রে নেতিবাচকতার লেশমাত্র পাওয়া যায় না। যাঁরা বলবেন শিক্ষিত, মার্জিত নারী চরিত্র বলেই অপর্ণার চরিত্রে অমন অশিষ্টতা পাওয়া যায় না, তাঁদের বলি, একই চলচ্চিত্রের দুলি চরিত্রটিকে দেখুন। সাঁওতালকন্যা দুলি সদ্য পরিচিত অতিথির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে সম্মতি দিয়েছে বলেই পরিচালক তাকে অকারণ অশ্লীলতার মোড়কে মুড়ে দেননি। বরং সত্যজিৎ রায়ের শিল্পবোধের সূক্ষ্মতা ও পরিমিতিবোধের চমৎকার প্রমাণ হয়ে থাকে হরি-দুলির ঘনিষ্ঠ দৃশ্যটিই। সত্যজিৎ-অনুরাগী ঋতুপর্ণ ঘোষ তাই তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে লেখেন, ‘নগ্ন দেহ আর নগ্নীকরণের মধ্যে যৌন অনুষঙ্গের ঘনত্বের মাত্রার যে তফাত, তা যেন সচেতনভাবে বুঝে, অনুভব করে তবেই হরি তার পোশাক খোলে—দুলি বরাবরই অনাবৃতা স্কন্ধ, তার পোশাক উন্মোচনের উত্তেজনা দর্শকের চোখে পৌঁছতে দেন না পরিচালক।’
অনেকগুলো নির্দিষ্ট সময়কালনির্ভর সিনেমা বানিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘ঘরে-বাইরে’র পটভূমিকায় দেখা যায় ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ‘চারুলতা’র প্রেক্ষাপটও সেই ব্রিটিশশাসিত ভারত। আবার ‘মহানগর’ নির্মিত হয়েছে ষাটের দশকের এক নারী ও নাগরিক জীবনকে কেন্দ্র করে। তবু এখনো ঠিক কতটা প্রাসঙ্গিক সত্যজিতের নারী চরিত্রেরা?
বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে বলতে পারি, বিমলা, চারুলতা থেকে শুরু করে আরতি, অদিতি—এদের সবাই আজও বড় বেশি প্রাসঙ্গিক।
ব্যক্তিগত মতাদর্শের অমিল থাকায় বিমলার মতো অনেককেই ভুগতে হয় চরম সিদ্ধান্তহীনতায়। আজও অনেক বাড়িতেই গৃহকর্তার ভূমিকায় আটকে থাকেন স্বামীরা আর নারীদের বিচরণক্ষেত্র ঘর থেকে উঠান, উঠান হয়ে ঘর। ফলে একাকিত্ব আজও উপমহাদেশের নারীদের সঙ্গী। চারুলতার মতো অপেরাগ্লাস হাতে হয়তো তারা বাইরের পৃথিবী দেখেন না, তবে পৃথিবী দেখবার সুযোগ তাঁদের জন্যও সামান্যই! আরতি যে দৃশ্যে প্রথম উপার্জনের টাকাগুলো নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন, সে দৃশ্যটার কথাও একটু মনে করুন। সংসার না কর্মক্ষেত্র—এ নিয়ে আরতির মনে যে সংঘাত, সে তো আজকের কর্মজীবী নারীদের প্রত্যেকের টানাপোড়েন। উপার্জন শুরু করার পর থেকে যে নিজের সংসারেই বদলে গেল আরতির অবস্থান, প্রথমবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হলো তার সিদ্ধান্ত—এ দৃশ্য আজকের নারীরা ভুলে যাবেন কী করে? পরনির্ভরশীলতার শিকল ভাঙাই যে প্রকৃত ক্ষমতায়ন, তা তো উপমহাদেশীয় সমাজে এক স্পষ্ট সত্য। একইভাবে সত্য হয়ে ফিরে আসে অদিতিরা। তারা শিক্ষিত, আধুনিক, বুদ্ধিমতী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের যতই অভিমান আর প্রেমের গোলাপি আতশ কাচের নিচে রেখেই দেখুক না কেন, এই নারীরা তাঁদের সীমা জানেন, মিষ্টতা বা শিষ্টতা কোনোটাই তাঁদের বোধবুদ্ধিহীন করে দেয়নি। এ যুগের অদিতিরাও হয়তো ‘মনে রেখে দেব’ বলে নেমে যায় ট্রেনের কামরা থেকে।
সাহিত্যে আর সেলুলয়েডে সত্যজিতের নারীদের ব্যাপ্তিতে বিশাল ফারাক। সাহিত্যে যেখানে তিনি নারীত্বকে একরকম অস্বীকারই করে গেলেন, সেখানে তাঁরই হাত ধরে রুপালি পর্দায় উপস্থাপিত হলো নারীত্বের সত্যতম রূপ। ব্যক্তিজীবনে মা ও স্ত্রী, অর্থাৎ খুব কাছের দুই নারীকেই পেয়েছেন সংগ্রামী ও সাহসী সঙ্গিনী হিসেবে। তাই হয়তো একজন সত্যজিৎ বিনা দ্বিধায় বলতে পারেন, ‘দৈহিক দিক দিয়ে পুরুষদের মতো শক্তিশালী না হলেও প্রকৃতি নারীদের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়েছে, যার মাধ্যমে তারা এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে। তারা অপেক্ষাকৃত বেশি সৎ, অকপট এবং অনেক দিক দিয়েই বেশি শক্তিশালী।’
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com