শুদ্ধ সুর মন শুদ্ধ করে

>লক্ষ্যাপারের উদ্যোগে দশক শাস্ত্রীয় সংগীত সম্মিলন হয়ে গেল ২৬ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি। ২০০৯ সাল থেকে এই সম্মিলন হয়ে আসছে। নারায়ণগঞ্জে এ অনুষ্ঠানটি একটা ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা হিসেবে সংস্কৃতিমহলে প্রশংসা পেয়েছে। এবারের আসরটি উৎসর্গ করা হয়েছিল সংগীতজ্ঞ সুধীন দাশকে। আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন বিদুষী অলকা দাশ। সম্মিলন বিষয়ে আমরা কিছু প্রশ্ন করেছি সম্মিলনের সমন্বয়ক অসিত কুমারকে।

কেমন হলো সম্মেলন?
অসিত কুমার: খুব ভালো হলো সম্মিলন। নানা অর্থে ভালো। আমরা সবচেয়ে বড় করে যেটা দেখেছি সেটা হলো, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছানো। আমাদের দশক উদ্‌যাপনের ফোকাল পয়েন্ট ছিল শিশু-কিশোরদের ওপর। রাতভর শাস্ত্রীয় গানবাদ্য শুনে ঢুলুঢুলু চোখে লোকজন বাড়ি ফিরবে—এটা তো হয়নি। প্রাপ্তবয়স্করা এর ভাগীদার। কিন্তু তাঁদের মধ্য দিয়ে সম্প্রসারণটা যতখানি ঘটবে তার চেয়ে বেশি ঘটবে কোমলমতি শিশুদের মধ্য দিয়ে। প্রায় এক হাজার শিশু-কিশোর শাস্ত্রীয় সংগীত চাক্ষুষ করল—এটা একটা অন্য রকমের শুরু। এর মধ্যে ১০ জন শিশুর মনের উর্বর জমিনে ফেলে আসা সুরের বীজ থেকে যদি অঙ্কুরোদ্‌ম হয়, তাহলেই সার্থক হবে আমাদের আয়োজন। সেই সার্থকতার দূরবর্তী লক্ষ্যের দিকে ছোট্ট একটা পদক্ষেপ এবারের সম্মিলন।

এ ধরনের সম্মিলনে কি আদৌ কোনো উৎসাহ জাগে?
অসিত কুমার: উৎসাহ যে জাগে, সেটা তো স্পষ্ট! বিরূপ আবহাওয়া, পৃষ্ঠপোষকতার সংকট, লোকবলের অভাব—এসব কারণে খুব বেশি প্রচার করা যায়নি। অথচ ৫০০–র বেশি মানুষের যাতায়াত ছিল রাতভর আসরে। এত আত্মবিলাস, স্বার্থপরতা, গুম, হত্যাসহ তাবৎ নিষ্ঠুরতার পরিমণ্ডলে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা একটা সমাজের ৫০০ মানুষকে যদি একটা রাত একসঙ্গে থাকার সুযোগ করে দেওয়া যায় গান শোনার অসিলায়—কম কী বলেন? মানুষকে প্রাঙ্গণে সম্মিলিত হওয়ার আহ্বান জানাই, মানুষেরা আসেন কেউ একা, কেউ সবান্ধব, কেউ সপরিবারে শিশু–কিশোর সন্তানদের নিয়ে—এটা যে কত বড় তা তো করপোরেট মানদণ্ডে ধরা পড়বে না। শিশু-কিশোরেরাও ভীষণ আনন্দ পেয়েছে। বিদ্যালয় প্রশাসন এবং শিক্ষকমণ্ডলী সত্যিই মনে করছেন যে এর খুবই দরকার। দুটি সমস্যা মানুষের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনুষ্যত্বের সম্ভাবনাকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এক হলো গ্যাজেটভিত্তিক বিনোদন, যার মধ্য দিয়ে উচ্চগতির প্রতি ঝোঁক এবং হত্যাস্পৃহা জেগে ওঠা খুব স্বাভাবিক। ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। শাস্ত্রীয় সংগীত শোনা বা নিজেই অভ্যাস করার মধ্য দিয়ে ওদের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সংবেদন বিকশিত হবে। ফলে উৎসাহের জায়গাটা তৈরি হচ্ছে। দ্বিতীয় যে বিষয়টা সেটা হলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা; কেউ কেউ এটাকে পরীক্ষাব্যবস্থা বলছেন। এটা আমাদের শিশুদের মনের গড়নটা নষ্ট করে দিচ্ছে। পুরো সমাজটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে বলে মনে হওয়ার সুযোগ আছে। অভিভাবকেরা সন্তানের ওপর চাপটা টের পাচ্ছেন। সেটা বুঝেই আমরা স্কুলমুখী হয়েছি। নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুলে যে প্রথম অধিবেশন হলো সেটার শিরোনাম থেকেই বুঝবেন: ‘সুরের বীজ বুনি।’ দ্বতীয় দিন আইডিয়াল স্কুলের আসরের নাম ছিল: ‘সুরে ছুঁই শিশুমন।’ সত্যিই ছোঁয়া লেগেছিল। বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের খুশবুর তবলা লহরা, সোহিনীর সেতার—এসব অবাক বিস্ময় নিয়ে শুনেছ বাচ্চারা। আনন্দে মন ভরে গেছে।

অসিত কুমার

১০ বছরে আপনাদের অর্জন কী?
অসিত কুমার: অর্জনটা মেপে ফেলা সহজ নয়। তবে যেটা আপনি চাক্ষুষ করতে পারবেন, সেটা হলো মানুষের উৎসাহ। বেঙ্গলের শাস্ত্রীয় সংগীতের আয়োজনটাকে বাইরে রেখে বলতে হয়, কারণ ওটা কোনো তুলনার মধ্যে পড়ে না; ওটা গ্লোবালি ইনকম্পেয়ারেবল। লক্ষ্যাপার ২০০৯ থেকে যে কারণে বিশিষ্টতা অর্জন করেছে সেটা হলো, শ্রোতার সমাগম। এখানকার সংস্কৃতিকর্মী থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ঢাকার আর্ট থিয়েটারের তরুণদের উপস্থিতি... অনেক উৎসাহ জোগায়। এটা আমরা ধরে রাখতে পেরেছি। অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গেছি। কিন্তু মানুষ ভিড় করছে। রাত পার করছে গান শুনে। সহজ–সুন্দর জীবনের প্রতি মানুষের যে আকর্ষণ তার একটা ধারণা যেন তৈরি হয়, এখানে লক্ষ্যাপারের সন্ধ্যা রাতগুলোতে।

এটা বাজার অর্থনীতির যুগ। কীভাবে টিকে থাকেন? যুদ্ধটা কত বড়?
অসিত কুমার: বিষয়টা যদি নিতান্তই চিত্তবিনোদনের হতো, তাহলে একভাবে ধরা পড়ত। এটা সত্যিই একটা লড়াই। এটা একাধারে সুদূরপ্রসারী সমাজ সংস্কার আন্দোলন এবং প্রকারান্তরে শিল্প আন্দোলন। যেটা প্রকাশ পেয়েছে এবারের স্লোগানে ‘সুরে সুরে মন গড়ি, মন দিয়ে দেশ’! মনগুলো ভালো না হলে দেশটা ভালো হতে পারে না। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা কাসেম জামালের কথাটা গুরুত্বপূর্ণ, ‘শুদ্ধ সুর মন শুদ্ধ করে।’ ফলে লড়াইটা বুঝে–শুনেই করছি। করতেই হবে বলে করছি। ওই যে অতুলের ‘মোষ তাড়ানো সহজ নয়’... সত্যিই তাই। মানুষের মনের জমিনে আবাদ যিনি করবেনই তিনি সর্বস্ব বিলিয়েই করবেন। ডুবতে রাজি আছি... হা হা হা